ভুয়া আমন্ত্রণপত্রের কারণে ভিসা পেয়েও কানাডা যাওয়া হলো না সিলেটের ৪২ যাত্রীর। শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে বিষয়টি ধরা পড়ার পর তাদের ফিরিয়ে দেওয়া হয়। গত ৬ নভেম্বর শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে তাদের ফিরিয়ে দেওয়া হলেও বিষয়টি আলোচিত হয় গতকাল।
জানা যায়, ট্যুরিস্ট ভিসার আবেদন করে কানাডার ভিসা পেয়েছিলেন তারা। পরিবার ও আত্মীয়-স্বজনের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে রওয়ানাও হয়েছিলেন। সিলেট ওসমানী আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে তারা ইমিগ্রেশনও সম্পন্ন করেন। তবে কানেকটিং ফ্লাইটে ঢাকায় যাওয়ার পর কানাডাগামী বাংলাদেশ বিমানে উঠার সময় ধরা পড়ে জালিয়াতির ঘটনা। ফলে বিমানবন্দর থেকে ফিরতে হয় ৪২ জনকে।
যে আমন্ত্রণপত্র (ইনভাইটেশন) দিয়ে তারা ভিসা করিয়েছিলেন সেটা পুরোই ভুয়া। এরপর বিমান বাংলাদেশ কর্তৃপক্ষ কানাডাগামী ৪২ যাত্রীকে অফলোড করে। অফলোড হওয়া ৪২ যাত্রীর সবাই কানাডায় একটি বিয়ের অনুষ্ঠানে অংশ নেওয়ার আমন্ত্রণে যাচ্ছিলেন।
এর আগে ওই একই বিয়ের আমন্ত্রণপত্র দিয়ে সিলেট থেকে আরও বেশ কয়েকজনকে ভিসা করিয়ে কানাডায় পাঠায় একটি সিন্ডিকেট।
বিমান কর্তৃপক্ষ খোঁজ নিয়ে নিশ্চিত হয়েছে- যে মেয়ের বিয়ের আমন্ত্রণ দিয়ে ভিসা করানো হয়েছিল, আসলে ওই মেয়ের বিয়ের কোনো অনুষ্ঠানই হচ্ছে না সেখানে।
সূত্র জানায়, কানাডার টরন্টো ও সিলেটের কতিপয় এজেন্সি মিলে ভুয়া কাগজপত্র দিয়ে ভিসা করানোর একটি সিন্ডিকেট তৈরি করেছে। ওই সিন্ডিকেটের সদস্যরা কানাডা থেকে বিভিন্ন ব্যক্তির কাছ থেকে ভুয়া আমন্ত্রণপত্র (ইনভাইটেশন) তৈরি করে ভুয়া কাগজপত্র দিয়ে ভিসা করিয়ে থাকে। এক্ষেত্রে তারা প্যাসেঞ্জারদের কাছ থেকে ১০-১৫ লাখ টাকার চুক্তি করে। ভিসা হলে তারা প্যাসেঞ্জারের কাছ থেকে এই টাকা আদায় করে।
সূত্র আরও জানায়, ওই সিন্ডিকেটের সদস্যরা কানাডার টরেন্টোতে একটি ‘কাল্পনিক বিয়ের’ অনুষ্ঠান দেখিয়ে আমন্ত্রণপত্র তৈরি করে। বিয়েতে অংশ নেওয়ার জন্য কাল্পনিক কনে, কনের মা, বাবা, ভাই ও চাচা শতাধিক ব্যক্তিকে আমন্ত্রণপত্র পাঠান। সিন্ডিকেটের সদস্যরা ওই আমন্ত্রণপত্র দিয়ে তাদের চুক্তিকৃত প্যাসেঞ্জারের কানাডার ভিসার জন্য আবেদন করেন। কাকতালীয়ভাবে বেশিরভাগ আবেদনকারীর ভিসাও হয়ে যায়। যাদের ভিসা হয়েছে তাদের বেশিরভাগই এর আগে দেশের বাইরে কোথাও বেড়াতে যাননি। অর্থাৎ তারা সাদাপাসপোর্টধারী ছিলেন।
জানা গেছে, ওই সিন্ডিকেটের সদস্যরা অক্টোবরের মাঝামাঝি ২৫ জনকে কানাডায় পাঠায়। অক্টোবরের শেষ সপ্তাহে যান আরও ৮ জন। কোনো ধরণের ঝামেলা ছাড়াই তারা কানাডায় পৌঁছান। কানাডায় পৌঁছেই তারা শরণার্থী দাবি করে কানাডা সরকারের কাছে আশ্রয় প্রার্থনা করেন।
দুই দফায় ৩৩ জন নিরাপদে কানাডায় পৌঁছার পর গত ৬ নভেম্বর ওই সিন্ডিকেট ভিসাপ্রাপ্ত আরও ৪২ জনকে কানাডায় পাঠানোর চেষ্টা করে। সহজে ইমিগ্রেশন পার হতে তারা বাংলাদেশ বিমানের সিলেট-ঢাকা-টরেন্টো ফ্লাইটের টিকেট কাটেন। যথারীতি তারা সিলেট ওসমানী বিমানবন্দরে ইমিগ্রেশন সম্পন্ন করে কানেকটিং ফ্লাইটে ঢাকায় পৌঁছান।
ঢাকাস্থ হযরত শাহজালাল (রহ.) বিমানবন্দরের একটি সূত্র জানায়, ৬ নভেম্বর রাতে ওই ৪২ জন ট্রানজিটে অপেক্ষা করার সময় বিমানের পাসপোর্ট চেকিং ইউনিটের সদস্যদের সন্দেহ হয়। তারা দেখতে পান, ওই যাত্রীদের প্রায় সবার সাদা পাসপোর্টে কানাডার ভিসা লাগানো। এতে তাদের সন্দেহ আরও বাড়ে। এসময় বিমান কর্মকর্তারা তাদের আমন্ত্রণপত্র ও হোটেল বুকিং দেখতে চান। তখনই চমকে যান কর্মকর্তারা। তারা দেখতে পান, ওই যাত্রীদের সবাই একটি বিয়ের অনুষ্ঠানে অংশ নিতে কানাডা যাচ্ছেন। আর হোটেল বুকিংয়ের পরিবর্তে তারা কিছু বাড়ি ভাড়ার কাগজপত্র দেখান।
বিমান কর্মকর্তাদের জিজ্ঞাসাবাদের মুখে কিছু যাত্রী জানান, তারা যেহেতু একটি বিয়ের অনুষ্ঠানে যাচ্ছেন তাই একত্রে থাকার জন্য তারা বাসা ভাড়া নিয়েছেন। আবার যাত্রীদের কেউ কেউ বিমানবন্দরে বসেই হোটেল বুকিং করেন। কানাডায় বিয়েতে অংশ নিতে একসাথে বাংলাদেশ থেকে এতো লোক যাওয়ার বিষয়টিতে খটকা লাগায় বিমান কর্মকর্তারা তাদের ভিসা যাচাইয়ের জন্য সিঙ্গাপুর ও দিল্লিস্থ কানাডার ভিসা অফিসে ইমেইল পাঠান।
যাত্রীদের জানানো হয় যে, কানাডা বর্ডার এজেন্সি নিশ্চিত করার পর তাদেরকে বিমানে উঠানো হবে। নির্ধারিত ফ্লাইট চলে গেলেও এয়ারলাইন্স কর্তৃপক্ষ তাদেরকে হোটেলে রেখে পরে পাঠাবে। কিন্তু পরদিন সকাল পর্যন্ত সিঙ্গাপর ও দিল্লি থেকে কোনো তথ্য না পাওয়ায় বিমান কর্তৃপক্ষ পাসপোর্টে ইমিগ্রেশন সিল কেটে দিয়ে লাগেজসহ তাদেরকে ফিরিয়ে দেয়।
বিমান সূত্রে জানা গেছে- টরন্টো পৌঁছানোর পর যদি এই যাত্রীরা ইমিগ্রেশনে আটকে যান, তাহলে প্রতিটি যাত্রীর জন্য বিমানকে ১৮০০ ডলার জরিমানা করা হবে। আর যেতে না পারায় প্রায় কোটি টাকা লোকসান হয়েছে বিমানের। এ নিয়ে প্রতিক্রিয়াও চলছে। এয়ারলাইন্স কর্তৃপক্ষ এর দায় যাত্রীদের উপর ছেড়ে দিতে চায়। আর যাত্রীরা বলছেন- তাদের ভিসা বৈধ, এয়ারলাইন্স কর্তৃপক্ষ তাদেরকে যেতে দেয়নি। তাই যাত্রীদের টিকিটের দায় এয়ারলাইন্সকেই মেটাতে হবে।
এই ৪২ যাত্রী কীভাবে সিলেট থেকে তাদের বোর্ডিং কার্ড পেলেন তা খতিয়ে দেখতে গত ৯ নভেম্বর বিমানের অভ্যন্তরীণ তদন্ত দল সিলেটে যায়। এসময় তারা বিমানবন্দরে কর্তব্যরত কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলেন। তদন্ত দল ফেরত যাত্রীদের সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা করলেও যাত্রীরা তাদের ডাকে সাড়া দেননি।