কাতারে বাজছে ফুটবল যুদ্ধের দামামা, ক্ষণগণনা চলছে

মধ্যপ্রাচ্যের দেশ কাতারে বাজছে ফুটবল যুদ্ধের দামামা। আর মাত্র কয়েক ঘণ্টা পরই উঠবে বিশ্বকাপের পর্দা। চলছে ক্ষণগণনা।

ফুটবল ঘিরেই শুরু হবে বিশ্বজয়ের উন্মাদনা, কোটি কোটি মানুষের নজর থাকবে প্রতিটি ম্যাচে। প্রিয় দলের জয় দেখতে অপেক্ষায় থাকবেন দর্শকরা মাঠে ও টেলিভিশনের পর্দায় চোখ রেখে।

এক যুগ আগে ২০১০ সালে ২০২২ বিশ্বকাপের আয়োজক হিসেবে কাতারের নাম ঘোষণা করেছিল বিশ্ব ফুটবলের নিয়ন্ত্রণ সংস্থা ফিফা। তৎকালীন ফিফা সভাপতি সেপ ব্ল্যাটার কাতারের নাম ঘোষণা করতে গিয়ে বেশ গর্ববোধ করেই বলেছিলেন প্রথম কোন আরব দেশ হিসেবে কাতারের বিশ্বকাপ ইতিহাসের পাতায় স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে।

ফিফার সভাপতি পদে সবচেয়ে লম্বা সময় ধরে ক্ষমতা আকড়ে ধরে থাকা ব্লাটার দূর্নীতির দায়ে শেষ পর্যন্ত পদ হারানোর পাশাপাশি ফুটবল থেকে আজীবন নিষিদ্ধ হন। সেই ব্লাটার কাতার বিশ্বকাপের আগে বলেছেন উল্টো কথা। তার ভাষায়, আয়োজক হিসেবে ঐ সময় কাতারকে বেছে নেয়া সম্পূর্ণ ভুল সিদ্ধান্ত ছিল।

বিশ্বের যেকোন বড় ক্রীড়াযজ্ঞ আয়োজন করতে গেলে বিতর্ক থাকবেই। কাতারও তার উর্ধ্বে নয়, কিন্তু বল মাঠে গড়ানোর আগেই কাতারকে ঘিরে মাঠের বাইরে বিস্তর সমালোচনার ঝড় বয়ে গেছে।

বিশেষ করে কাতারের ভেন্যুগুলোর অবকাঠামোগত উন্নয়নে প্রায় পুরোটাই অভিবাসী শ্রমিদের উপর নির্ভর করতে হয়েছে। ওই শ্রমিকদের মানবাধিকার লঙ্ঘন হয়েছে দাবি করে পশ্চিমা দেশগুলো বলেছে, শ্রমিকদেরকে নায্য পাওনা দেয়া হয়নি। পরবর্তীতে বিশ্বকাপে অংশগ্রহণকারী ইউরোপীয়ান দেশগুলোও সুর মিলিয়ে কথা বলতে শুরু করে।

ফুটবল বিশ্বকাপ সর্বপ্রথম হয় ১৯৩০ সালে। প্রথম বিশ্বকাপে চ্যাম্পিয়ন হয়েছিল লাতিন আমেরিকার দেশ উরুগুয়ে। এরপর থেকে প্রতি চার বছর পরপর হচ্ছে ফুটবলের এ বিশ্বযুদ্ধ, তবে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের কারণে ১৯৪২ ও ১৯৪৬ সালে বিশ্বকাপ হয়নি।

এখন পর্যন্ত সবচেয়ে বেশিবার ফুটবল বিশ্বকাপের শিরোপা জয় করেছে লাতিন আমেরিকার দেশ ব্রাজিল। পাঁচবার বিশ্বসেরার ট্রফি নিজেদের ঘরে তুলেছে সেলেসাওরা। এছাড়া চারবার করে বিশ্বচ্যাম্পিয়ন হয়েছে জার্মানি ও ইতালি।

২২তম আসর কাতারে :

২০২২ সালের ফিফা বিশ্বকাপ ইতিহাসের ২২তম বিশ্ব ফুটবলের আসর। ২০ নভেম্বর থেকে ১৮ ডিসেম্বর পর্যন্ত কাতারে চলবে ফুটবলের এ মহারন। প্রথমবারের মত মধ্যপ্রাচ্যের কোন দেশে এবং এশিয়ায় দ্বিতীয়বারের মত বিশ্বকাপ আয়োজিত হচ্ছে। এর আগে ২০০২ সালে সাউথ কোরিয়া ও জাপান যৌথভাবে আয়োজন করেছিল বিশ্বকাপ।

৩২টি দেশের অংশগ্রহণে বিশ্বকাপ এবারই হবে শেষ। এরপর ২০২৬ সালে যুক্তরাষ্ট্র, মেক্সিকো ও কানাডায় আয়োজন করা টুর্নামেন্টে অংশ নেবে ৪৮টি দেশ।

খেলা হবে ৮ স্টেডিয়ামে :

বিশ্বকাপের স্বত্ব পাবার পর থেকেই পুরো কাতার জুড়ে আটটি নতুন স্টেডিয়াম নির্মাণ হয়েছে। স্টেডিয়ামগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বড় লুসাইল আইকনিক স্টেডিয়াম।

দোহার ১৫ কিলোমিটার উত্তরে দুই লাখ জনসংখ্যার পরিকল্পিত একটি শহর লুসাইল। সেখানেই গড়ে তোলা হয়েছে ৮০ হাজার ধারণক্ষমতার আইকনিক স্টেডিয়াম। সেখানে আগামী ১৮ ডিসেম্বর টুর্নামেন্টের ফাইনাল হবে।

রোববার কাতার বনাম ইকুয়েডরের মধ্যকার উদ্বোধনী ম্যাচটি হবে আল-খোরের আল-বায়াত স্টেডিয়ামে। এছাড়া অন্যান্য ভেন্যুগুলো হলো- এডুকেশন সিটি স্টেডিয়াম, আহমাদ বিন আলি স্টেডিয়াম, খালিফা ইন্টারন্যাশনাল স্টেডিয়াম, আল থুমামা স্টেডিয়াম, স্টেডিয়াম ৯৭৪ ও আল-জানুব স্টেডিয়াম।

যে ট্রফি পেতে লড়াই :

ফুটবল বিশ্বকাপ শুরুর সময়ে ট্রফির নাম ছিল ‘জুলেরিমে ট্রফি’। ১৯৪৬ সালে প্রথম ফিফা প্রেসিডেন্ট জুলেরিমেকে সম্মান জানিয়ে তার নামে ট্রফির নামকরণ করা হয়। তবে ১৯৬৬ সালে বিশ্বকাপের ৪ মাস আগে ইংল্যান্ডে এক প্রদর্শনী থেকে ট্রফিটি চুরি হয়ে যায়। সাতদিন পর ট্রফিটি উদ্ধার করা হয়। এরপর থেকে চুরি ঠেকাতে প্রদর্শনীতে রেপ্লিকা ট্রফি ব্যবহার করা হয়।

১৯৭০ সালে মেক্সিকোতে অনুষ্ঠিত বিশ্বকাপের নবম আসরে চ্যাম্পিয়ন ব্রাজিল তৃতীয়বার বিশ্বসেরা হওয়ার পর স্থায়ীভাবে জুলেরিমে ট্রফি তাদেরকে দিয়ে দেয়া হয়। যদিও সেলেসাওদের কাছে থেকে ১৯৮৩ সালে ফের এই ট্রফি খোয়া যায়।

ব্রাজিলকে জুলেরিমে ট্রফি পাকাপাকিভাবে দিয়ে দেয়ার পর ১৯৭৪ সালে বিশ্বকাপের নতুন ট্রফি উন্মোচন করা হয়। সিলভিও গানজানিগা এই ট্রফির ডিজাইন করেন। বর্তমান এই ট্রফির উচ্চতা ৩৬.৮ সেন্টিমিটার। ১৮ ক্যারেট সোনা দিয়ে বানানো হয়েছে বিশ্বকাপ ট্রফিটি। ৬.১৪২ কেজির মধ্যে রয়েছে ৫ কেজি স্বর্ণ।

বিশ্বকাপ ট্রফির ডিজাইন এমনভাবে তৈরি করা, দেখলে মনে হবে দু’জন মানুষ হাত দিয়ে পুরো পৃথিবীকে স্বাগত জানাচ্ছে। ১৯৭৪ সালে নতুন বিশ্বকাপ ট্রফির প্রথম ব্যবহার হয়। সেবার বিশ্বকাপ চ্যাম্পিয়ন হয়েছিল জার্মানি। এরপর থেকে পাকাপাকিভাবে কোনও দেশকেই বিশ্বকাপ ট্রফি দেয়া হয় না। চার বছর কেবল বিশ্বকাপ ট্রফি নিজেদের কাছে রাখতে পারে কোনো দেশ। এরপর শিরোপাজয়ী দলকে দেয়া হয় একটি রেপ্লিকা।

কাতারের সৌভাগ্য :

১৯৩৪ সালে ইতালির পর আয়োজক দেশ হিসেবে একমাত্র কাতার প্রথমবারের মতো বিশ্বকাপে খেলার সুযোগ পেয়েছে।

রাশিয়ায় বিশ্বকাপ খেলতে ব্যর্থ হবার পর নেদারল্যান্ডস, ইকুয়েডর, ঘানা ও ক্যামেরুন আবারও বিশ্বমঞ্চে ফিরেছে। ১৯৮৬ সালে একবার বিশ্বকাপ খেলা কানাডাও ৩৬ বছর পর ফিরে এসেছে।

অন্যদিকে ইউরোপীয়ান দল হিসেবে ১৯৫৮ সালে খেলার ৬৪ বছর পর দ্বিতীয়বার বিশ্বকাপ খেলতে যাচ্ছে ওয়েলস।

ফিফা র‌্যাঙ্কিংয়ের শীর্ষ ১০ দলের মধ্যে একমাত্র বাদ পড়েছে ষষ্ঠ স্থানে থাকা ইতালি। এ নিয়ে দ্বিতীয়বারের মত বিশ্বকাপে খেলতে ব্যর্থ হলো দলটি।

ম্যাচ পরিচালনায় ৬ নারী :

এবারের বিশ্বকাপ পরিচালনার জন্য ৩৬ জন রেফারি, ৬৯ জন সহকারী রেফারি ও ২৪ জন ভিডিও এ্যাসিসটেন্ট রেফারির নাম ঘোষণা করেছে ফিফা। এই ৩৬জন রেফারির মধ্যে প্রথমবারের মতো তিনজন নারী রেফারি ম্যাচ পরিচালনা করবেন। তারা হলেন ফ্রান্সের স্টিফেনি ফ্র্যাপার্ট, রুয়ান্ডার সালিম মুকানসানগা ও জাপানের ইউশিমি ইয়ামাশিতা। তাদে সঙ্গে যোগ দিবেন আরও তিনজন সহকারী নারী রেফারি।

এ নিয়ে সর্বোচ্চ তৃতীয়বারের মত বিশ্বকাপে ম্যাচ পরিচালনা করতে যাচ্ছেন গাম্বিয়ান রেফারি বাকারি গাসামা ও আর্জেন্টিনার সহকারী রেফারি হুয়ান পাবলো বেলাত্তি। ২০১৮ সালের ফাইনালে বেলাত্তি সহকারী রেফারি ছিলেন।

সূত্র : নিউজবাংলা