কবর খুঁড়ে মিলল কম্বল, ‘জঙ্গির’ লাশ উধাও!

আমিনুল ও জোহায়ের

জঙ্গিবাদে জড়িয়ে কথিত হিজরতের উদ্দেশ্যে কুমিল্লা থেকে ঘরছাড়া সাত তরুণের একজন আমিনুল ইসলাম ওরফে আল আমিন (২৩)। তিনি ছিলেন ভিক্টোরিয়া কলেজের ছাত্র। উগ্রবাদের ভুল পথ বুঝতে পেরে বাড়ি ফেরত আসার চেষ্টা করছিলেন ওই তরুণ। তবে নতুন জঙ্গি সংগঠন ‘জামাতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারকস্ফীয়া’র ফাঁদে পা দেওয়ায় আর ফেরা হলো না আমিনুলের। তাঁর সঙ্গে থাকা কয়েকজন পথভ্রষ্ট তরুণ ও বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠন কুকি-চিন ন্যাশনাল ফ্রন্ট (কেএনএফ) সদস্যরা মিলে আমিনুলকে পাহাড়েই পুঁতে রাখে। সম্প্রতি ঘরছাড়া কয়েকজন তরুণকে গ্রেপ্তারের পর জিজ্ঞাসাবাদের পর লোমহর্ষক তথ্য উঠে আসে।

তারা জানিয়েছে, গত ২৫ নভেম্বর আমিনুল মারা গেছেন। তার লাশ কম্বলে পেঁচিয়ে পুঁতে ফেলে সঙ্গীরা। তার পরিবার ও র‌্যাব জানায়, আমিনুলের বাবাকে সঙ্গে নিয়ে গত রোববার গহিন পাহাড়ে ওই কবর খোঁড়া হয়। এ সময় কবর খুঁজতে সহায়তা করে দুই জঙ্গি। তবে কবর খুঁজে পাওয়া গেলেও সেখানে লাশ পাওয়া যায়নি। শুধু মিলেছে একটি কম্বল।

আমিনুলের মৃত্যুর কারণ নিয়ে দুটি তথ্য গোয়েন্দাদের সামনে এসেছে। একটি হলো- বান্দরবানের রুমার গহিন অরণ্যে না খেয়ে, রোগে আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন আমিনুল। আরেকটি হলো- সঠিক পথে ফেরার চেষ্টা করলে নিজেদের দ্বন্দ্বে খুন হন তিনি।

আমিনুল ছাড়াও পাহাড়ে জঙ্গি আস্তানায় প্রশিক্ষণ নিতে গিয়ে জোহায়ের বিন রহমান নামে নোয়াখালীর সোনাইমুড়ীর বিজয়নগরে আরেক ব্যক্তি নিহত হন। জঙ্গিরা তার নতুন নাম দিয়েছিল ডা. আহমেদ। পল্লি চিকিৎসক হওয়ায় সঙ্গীরা তাকে ডাক্তার হিসেবে সম্বোধন করত। তার লাশও খুঁজে পাওয়া যায়নি। তবে কুকি-চিনের আস্তানায় থাকাকালে জোহায়ের অন্য বিচ্ছিন্নতাবাদীদের হামলায় নিহত হন বলে গোয়েন্দারা নিশ্চিত করেছেন।

সোমবার (১৬ জানুয়ারি) রাতে যোগাযোগ করলে জোহায়েরের স্ত্রী হাজেরা আক্তার বলেন, ২০২১ সালের ৩০ আগস্ট বাড়ি থেকে বের হয়ে আর ফেরেননি আমার স্বামী। অনেক দিন কোনো খোঁজ ছিল না। তবে ঘর ছাড়ার আগে বলেছিলেন তুরস্কে যাবেন। নিখোঁজ হওয়ার পর গত ২২ মে সর্বশেষ কথা হয়েছিল। পরে র‌্যাবের মাধ্যমে জানতে পারি, জঙ্গি সংগঠনের সঙ্গে জড়িয়ে পাহাড়ে নিহত হয়েছেন। যেসব জঙ্গি আমার স্বামীকে ওই পথে নিল, তাদের দৃষ্টান্তমূলক বিচার চাই। দুই সন্তান নিয়ে মানবেতর জীবন পার করছি। বাবা কোথায়- ওরা জানতে চায়। আসলে কী ঘটেছে, সন্তানরা জানে না। লাশটা পেলে তো সন্তানদের সান্ত্বনা দিতে পারতাম।

কুমিল্লার তরুণ আমিনুলের বাবা নুরুল ইসলাম ছেলের লাশের খোঁজে এখন বান্দরবানে। মোবাইল ফোনে তিনি জানান, আমিনুলের সঙ্গে জঙ্গি আস্তানায় যাওয়া কুমিল্লার আরেক তরুণ ইমরান বিন রহমান ওরফে শিথিল এরই মধ্যে ধরা পড়েছে। আমিনুল কীভাবে মারা গেছে জিজ্ঞাসাবাদে শিথিল র‌্যাবকে জানিয়েছে। র‌্যাবের কাছ থেকে এ তথ্য জানতে পেরে গত শুক্রবার নুরুল ইসলাম তাঁর স্ত্রী ও এক আত্মীয়কে নিয়ে বান্দরবান যান। রোববার নুরুল ইসলামকে সঙ্গে নিয়ে হেলিকপ্টারে করে র‌্যাব ঘটনাস্থলে যায়। তবে কবর খুঁড়ে লাশ পাওয়া যায়নি। নুরুল ইসলাম জানান, কবরের আশপাশে কিছু স্যান্ডেল, জামাকাপড় ও হাঁড়িপাতিল পড়ে ছিল।

নুরুল ইসলাম বলেন, ‘এখন বাড়ি ফিরব? ওরা আমার ছেলেকে হত্যা করেছে। ছেলের লাশটি নিয়েও যদি বাড়ি ফিরতে পারতাম, মনকে সান্ত্বনা দিতে পারতাম। আমার ছেলে হয়তো ভুল বুঝতে পেরে ফিরে আসতে চেয়েছিল। সেজন্য অন্য জঙ্গিরা তাকে হত্যা করেছে।’ এ ঘটনায় আমিনুলের বাবা বান্দরবানে মামলা করতে যাচ্ছেন বলে জানিয়েছেন।

আমিনুল কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া সরকারি কলেজের ইসলাম শিক্ষা বিষয়ে স্নাতকের চতুর্থ বর্ষের শিক্ষার্থী ছিলেন। তাঁর বাড়ি আদর্শ সদর উপজেলার বড় আলমপুর গ্রামে। তারা কুমিল্লা শহরের ঝাউতলায় থাকতেন। তার বাবা গত ১ সেপ্টেম্বর কোতোয়ালি মডেল থানায় ছেলে নিখোঁজ হওয়ার জিডি করেছিলেন।

র‌্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন বলেন, হিজরতের নামে ঘরছাড়া আল আমিনের কবরে লাশ মেলেনি। ধারণা করা হচ্ছে, পুঁতে রাখা জায়গা থেকে কেউ লাশ সরিয়ে ফেলেছে। জঙ্গিরা, না কি পাহাড়ি বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠনের লোকজন তার লাশ সরিয়েছে, সেটা তদন্ত করে দেখা হচ্ছে।

র‌্যাব কর্মকর্তারা জানান, এর আগে পাঁচ জঙ্গিকে জিজ্ঞাসাবাদের পর বেরিয়ে আসে রুমার দুর্গম লুয়াংমুয়ালপাড়া এলাকায় কুকি-চিন ও জঙ্গিদের একটি গোপন আস্তানা রয়েছে। ওই আস্তানার পাশে এক জঙ্গিকে পুঁতে রাখা হয়েছে। লুয়াংমুয়ালপাড়াটি রুমা থেকে ৫০ কিলোমিটার দূরে। সোমবার আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সঙ্গে গণমাধ্যমকর্মীরাও গহীন ওই এলাকায় যান। লুয়াংমুয়ালপাড়া এমনিতেই জনমানবশূন্য। বম জনগোষ্ঠীর কয়েকজনকে সেখানে দেখা যায়। পাশের তামলাওপাড়ার বাসিন্দারা জানিয়েছেন, কুকি-চিন ও জঙ্গিরা গোপন আস্তানা তৈরির পর থেকে লুয়াংমুয়ালপাড়া ও পাশের পাইনুয়ামপাড়ার বাসিন্দারা আতঙ্কে রয়েছেন। ভয়ে বেশ কিছু পরিবার গত ডিসেম্বরে এলাকা ছেড়ে পালিয়ে গেছে।

লুয়াংমুয়ালপাড়া থেকে কিছুটা দূরে দেড় হাজার ফুট গভীর পাহাড়ি খাদের ঝিরির তীরে আস্তানাটির খোঁজ মেলে। সোমবার অভিযানের সময় সঙ্গে থাকা জঙ্গিরা বলেছে, তারা ওই আস্তানায় ৯ দিন ছিল। আমিনুলকে অসুস্থ অবস্থায় কাঁধে করে নিয়ে এসেছিল। কয়েকদিন পর মারা গেলে তাকে পাহাড়ে পুঁতে ফেলা হয়। অভিযানে স্থানীয় প্রশাসনের কয়েকজন কর্মকর্তা গভীর খাদে রশি ধরে ঝুলে নামতে না পারায় সবাই ওই গোপন আস্তানা পর্যন্ত পৌঁছাতে পারেননি।

গত ২৩ আগস্ট কুমিল্লার সাত তরুণ একযোগে নিখোঁজ হন। নিখোঁজ তরুণরা হলেন- মো. ইমতিয়াজ আহম্মেদ ওরফে রিফাত, নিহাল আবদুল্লাহ, মো. আমিনুল ইসলাম ওরফে আল আমিন, সরতাজ ইসলাম ওরফে নিলয়, ইমরান বিন রহমান ওরফে শিথিল, মো. হাসিবুল ইসলাম ও আস সামী। শেষ তিনজন উচ্চ মাধ্যমিক (এইচএসসি) পরীক্ষার্থী ছিলেন। এ ঘটনায় কুমিল্লার কোতোয়ালি মডেল থানায় সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করেন কয়েকজনের অভিভাবক।