টাঙ্গুয়ার হাওরপাড়ের শিক্ষাজীবন

ওরা স্কুলে না গিয়ে পর্যটকদের গান শোনায়!

প্রাথমিকেই ছেদ পড়ছে টাঙ্গুয়ার পাড়ের শিশু-কিশোরদের শিক্ষাজীবন

সুনামগঞ্জের তাহিরপুরের টাঙ্গুয়ার হাওর দেশের অন্যতম বৃহৎ জলাভূমি ও দর্শনীয় স্থান। গত এক দশক ধরে এটি ভ্রমণপিয়াসু পর্যটকদের কাছে হয়ে উঠেছে অবকাশযাপনের অন্যতম স্থান। তবে এখানে পর্যটকদের বেশিরভাগই রাত্রিযাপনের উদ্দেশ্যে ঘুরতে আসেন। পর্যটকদের ঘুরে বেড়ানো ও রাত্রিযাপনের জন্য টাঙ্গুয়ার হাওরে দেখা মিলবে বাহারি রঙের নৌকা, রয়েছে বিলাসবহুল কিছু প্রমোদতরী। সেখানে পর্যটকরা রাতভর গান-বাজনা করে সময় কাটান। দিনের বেলায় পর্যটকরা টাঙ্গুয়ার হাওরের ওয়াচটাওয়ারকে ঘিরে আনন্দ-ভ্রমনে মেতে উঠেন। পর্যটকদের এমন ভ্রমন-আনন্দে বাড়তি মাত্রা যুক্ত করে হাওরতীরবর্তী জয়পুর, নতুনহাটি ও গোলাবাড়ি গ্রামের স্কুলপড়ুয়া ছেলে-মেয়েরা। এতে করে প্রাথমিকের গণ্ডি পেরোতে পারছে না হাওর এলাকার অধিকাংশ শিশু-কিশোর।

সরেজমিনে দুপুর ২টায় টাঙ্গুয়ার হাওরের ওয়াচটাওরের কাছাকাছি পৌছলে কানে ভেসে আসে শিশু-কিশোরদের গলায় গানের আওয়াজ। সেখানে কয়েকজন শিশু-কিশোর ডিঙি নৌকা করে ওয়াচটাওয়ারের পাশে অবস্থান করা পর্যটকদের নৌ-যানকে কেন্দ্র করে ঘুরে বেড়াচ্ছে। এসব শিশু-কিশোরেরা পর্যটকদের আহবান জানাচ্ছে তাদের গলায় গান শুনতে, ডিঙি নৌকা করে হাওরে ঘুরে বেড়াতে। কেউ আবার তাদের ডিঙি নৌকায় চা-কেটলিও সাথে রেখেছে। গানের পাশাপাশি চলছে চা বিক্রি। পর্যটকরা হাওরের পানিতে ভেসে এই চা পান করে অন্যরকম ভালোলাগা বোধ করে।

জয়পুর ও গোলাবাড়ি গ্রামের বাসিন্দাদের সাথে কথা বলে জানা যায়, জয়পুর ও গোলাবাড়ি গ্রামের প্রায় শতাধিক শিক্ষার্থী রয়েছে যারা জয়পুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়ালেখা করে। টাঙ্গুয়ার হাওর যখন পানিতে টইটম্বুর থাকে তখন এসব শিক্ষার্থীদের বেশিরভাগই স্কুলে না গিয়ে ডিঙি নৌকা নিয়ে ওয়াচটাওয়ারে ভিড় করে। সেখানে সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত পর্যটকদের টাকার বিনিময়ে গান গেয়ে শোনায়, ডিঙি নৌকা দিয়ে ওয়াচটাওয়ারের চারপাশে থাকা হিজল করচ গাছগুলো ঘুরে ঘুরে দেখাই, সেইসাথে সুরেলা গলায় ভাটিয়ালি আর বাউল গান ধরে। এভাবেই হাওরের ভরা পানিতে ডর ভয়হীন মনে দিন পার করে এসব স্কুলপড়ুয়া শিশু-কিশোরেরা।

গ্রামবাসি আরো জানান, শিশুদের এমন কাজে পুরোপুরি সমর্থন যোগায় তাদের অভিভাবকরা। কারণ দিনশেষে এসব শিশুদের মাধ্যমে তাদের হাতে ভালো অংকের টাকা আসে। যা দিয়ে সংসারের অভাব ঘুচে। যেজন্য অভিভাবকরা পর্যটকদের ভরা মৌসুমে আনন্দচিত্তেই ডিঙি নৌকা দিয়ে তাদের শিশুদেরকে টাঙ্গুয়ার হাওরে পাঠান।

জয়পুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রাক্তন শিক্ষার্থী ও লাকমা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মাফিকুল ইসলাম বলেন, এ অঞ্চলের অভিভাবকরা অসচেতন একই সাথে নিম্নআয়ের মানুষ। যে কারণে ছেলে-মেয়েদের লেখাপড়ার বিষয়ে তারা উদাসীন। তবে হাওরপাড়ের এসব শিক্ষার্থীদের স্কুলমুখী করা জরুরি। নয়তো এরা দ্রুতই ঝরে পড়বে। আর স্কুল টাইমে ওয়াচটাওয়ার সংলগ্ন এলাকায় শিশুরা যেন নৌকা নিয়ে বের হতে না পারে এ ব্যাপারে প্রশাসনের হস্তক্ষেপ কামনা করছি।

জয়পুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মো. হাদিউজ্জামান বলেন, গোলাবাড়ি, জয়পুর ও নতুনহাটি গ্রামের শতাধিক ছেলে-মেয়ে এখানে ভর্তি হয়েছে। কিন্তু এদের অনেকেই স্কুলবিমুখ। স্কুলটাইমে ওয়াচটাওয়ারে গিয়ে পর্যটকদের গান গেয়ে শুনাই, চা বিক্রি করে থাকে। তাদেরকে স্কুলে ফেরাতে অনেকবার অভিভাবক ও মা সমাবেশ করেছি, গ্রামে গ্রামে মাইক করেছি, স্থানীয় জনপ্রতিনিধিকে জানিয়েছি কিন্তু কাজ হয়না।

পরিবেশ ও হাওর উন্নয়ন সংস্থার সভাপতি কাসমির রেজা জানান, এটা শিশু শ্রমের আওতায় পড়ে। সচেতনতার অভাব ও দরিদ্রতার কারনে এমনটি হচ্ছে। শিক্ষার্থীদের স্কুলমুখী করতে স্থানীয় প্রশাসন, জনপ্রতিনিধি ও শিক্ষকদের এগিয়ে আসতে হবে। আমরা চাই টাঙ্গুয়ার হাওরে আগত পর্যটকরা শিশু-কিশোরকে গানের কাজে নিরুৎসাহিত করবেন। তাছাড়া হাওরপাড়ের প্রতিটি স্কুলে শিক্ষার্থীদের যাতায়াতের জন্য নৌকার ব্যবস্থা করাও জরুরি।

শ্রীপুর উত্তর ইউনিয়ন পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান খসরুল আলম জানান, শিক্ষার্থীদের স্কুলমুখী করতে একটি নৌকা নির্মাণের জন্য ৩লাখ টাকা বরাদ্দ পেয়েছিলাম। কিন্তু এ টাকায় চাহিদামত নৌকা নির্মাণ করা যায়নি। পরে বরাদ্দের টাকা ফেরত গেছে।

শ্রীপুর উত্তর ইউনিয়ন পরিষদের বর্তমান চেয়ারম্যান আলী হায়দার জানান, শিশুদের স্কুলমুখী করতে বিষয়টি নিয়ে অভিভাবকদের সাথে কথা বলব। তিনি আরও জানান, স্কুলের আসা-যাওয়ার কাজে একটা নৌকার ব্যবস্থা করতে উদ্যোগ নেওয়া হবে।

তাহিরপুর উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তা মো. আবুল খায়ের বলেন, অভিভাবকরা সচেতন না হলে কি করার আছে? শিক্ষকদের আগেও বলেছি এসব শিক্ষার্থীদের স্কুলে ফেরাতে অভিভাবক সমাবেশে যেন জোর দেওয়া হয়। বিষয়টি নিয়ে কাজ করতে সহকারি শিক্ষা কর্মকর্তাকে বলে দিব।

তাহিরপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. রায়হান কবির বলেন, বিষয়টি আমাদের নজরে এসেছে। হাওরপাড়ের এসব শিশু-কিশোরদের স্কুলমুখী করতে দ্রুতই করণীয় ঠিক করা হবে।