‘শুধু শ্লোগান আর মিছিলের সংগ্রাম নয়। যত সত্বর পারো ইমার্জেন্সি মেডিকেল ফার্স্ট এইড স্কোয়াড তৈরী কর। ব্যাপক রক্তক্ষরণের জন্য প্রস্তুত থাক।’
১৯৭১ সালের ২১শে মার্চ যখন বাংলাদেশের পথে-প্রান্তরে স্বাধীনতা যুদ্ধের প্রস্তুতি শুরু হয়েছে, তখন সিলেট চিকিৎসা মহাবিদ্যালয়ের ছাত্রদের উদ্দেশ্য করে যে কথাগুলো বলেছিলেন মানবতার সেবায় আত্মোৎস্বর্গকৃত নির্ভীক মহৎপ্রাণ সিলেট চিকিৎসা মহাবিদ্যালয়ের প্রধান শল্য চিকিৎসক অধ্যাপক ডা. শামসুদ্দীন আহমদ।
এ অংশটুকু ১৯৭২ সালে শেখ ফজলুল হক মনি সম্পাদিত বাংলার বাণী পত্রিকার বিশেষ সংখ্যা ‘বাংলাদেশের গণহত্যা’য় প্রকাশিত একটি নিবন্ধের শুরুর দুটি লাইন যা পরবর্তীতে ‘বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের দলিলপত্র’র অষ্টম খণ্ডেও প্রকাশিত হয়েছে।
নিবন্ধটির শিরোনাম ছিল ‘ওরা ডাক্তার মেরেছে’। এই ডাক্তাররা হচ্ছেন তৎকালীন সিলেট মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের (বর্তমান এমএজি ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল) প্রধান সার্জারি চিকিৎসক অধ্যাপক ডা. শামসুদ্দীন আহমদ ও শিক্ষানবিশ চিকিৎসক শ্যামল কান্তি লালা।
শুধু ডাক্তারই নয়, তাদের সঙ্গে শহীদ হয়েছেন এই হাসপাতালের অ্যাম্বুলেন্সচালক কোরবান আলী ও অপারেশন থিয়েটারের নার্স মাহমুদুর রহমান।
১৯৭১ সালের ৯ এপ্রিল, মহান মুক্তিযুদ্ধ শুরুর মাত্র ১৫ দিনের মাথায় সিলেট মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে যুদ্ধাহতদের চিকিৎসাসেবা দেওয়ার অপরাধে তাদের হত্যা করে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী।
এ হত্যাকাণ্ডের পরপর ১৪ এপ্রিল এ মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষ ও হাসপাতালের সুপারিনটেনডেন্ট লেফটেন্যান্ট কর্নেল ডা. আবুল ফজল জীয়াউর রহমানকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য তুলে নিয়ে যায় পাকিস্তানি বাহিনী। এরপর তার আর কোনো খোঁজ পাওয়া যায়নি।
মুক্তিযুদ্ধের আগে যখন প্রতিরোধ সংগ্রামে উত্তাল সারাদেশ, তখন ডা. শামসুদ্দীন তার ছাত্র-ছাত্রীদের ডেকে ফার্স্ট এইড স্কোয়াড গঠন করে প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি সংগ্রহ করে বিভিন্ন স্থানে তা মজুদ করে রাখেন, যাতে প্রয়োজনে সেবা নিশ্চিত করা যায়।
পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর ‘অপারেশন সার্চলাইট’ ঢাকা ছাড়াও যেসব জেলা শহরে আক্রমণ ও গণহত্যা চালানো হয় তার মধ্যে সিলেট শহর অন্যতম। এ অবস্থায় হাসপাতালে সাধারণ রোগীদের সঙ্গে যুদ্ধাহতরাও আসেন চিকিৎসার জন্য আর তাদের সেবায় ঝাঁপিয়ে পড়েন ডা. শামসুদ্দীন ও অন্যান্যরা।
হাসপাতালটির তখনকার অবস্থান ছিল নগরীর চৌহাট্টা এলাকায় যা পরবর্তীতে শহীদ ডা. শামসুদ্দীন আহমদ হাসপাতাল হিসেবে কোভিড-১৯ বিশেষায়িত চিকিৎসায় নিবেদিত হয়।
সেসময় নিরাপত্তার ভয়ে অনেক চিকিৎসক-নার্স হাসপাতাল ছেড়ে চলে গেলেও রোগীদের কথা চিন্তা করে থেকে যান ডা. শামুসদ্দীন আহমদ, শ্যামল কান্তি লালা, অ্যাম্বুলেন্সচালক কোরবান আলী ও নার্স মাহমুদুর রহমান।
যেসব ডাক্তার-নার্স ও প্যারামেডিকরা তখন হাসপাতাল ছেড়ে যান, তাদের সবার হাতে ওষুধ ও চিকিৎসার সরঞ্জাম তুলে দেন ডা. শামসুদ্দীন, যাতে তারা যেকোনো জায়গা থেকেও সেবা দিতে পারেন।
এদিকে এপ্রিলের প্রথম থেকেই মুক্তিযুদ্ধে চার নম্বর সেক্টর কমান্ডার মেজর জেনারেল বীর উত্তম সিআর দত্তের নেতৃত্বে সিলেটে প্রতিরোধযুদ্ধ শুরু হয়। সিলেট শহর ছাড়া সিলেট জেলা (বর্তমানের পুরো সিলেট বিভাগ) শত্রুমুক্ত হয় এপ্রিলের ৭ তারিখের মধ্যেই।
এ প্রতিরোধযুদ্ধ যত তীব্র হচ্ছিল, সিলেটে পাকিস্তানি বাহিনীর নির্যাতনও তত বাড়ছিল। সে সময় শহরের কোথাও গুলির শব্দ শুনলেই অ্যাম্বুলেন্স নিয়ে ছুটে যাচ্ছিলেন কোরবান আলী। আহতদের অ্যাম্বুলেন্সে তুলে নিয়ে আসছিলেন হাসপাতালে যেখানে তাদের চিকিৎসা দিতে দিনরাত পরিশ্রম করছিলেন ডা. শামসুদ্দীন, ডা. শ্যামল ও নার্স মাহমুদুর।
এ ছাড়াও, তীব্র প্রতিরোধযুদ্ধে আহত প্রতিরোধযোদ্ধা, এমনকি পাকিস্তানি সেনাদেরও চিকিৎসাসেবা দিতে দিনরাত কাজ করছিলেন তারা।
পাক দস্যুরা স্থল ও বিমান বাহিনী নিয়ে সর্বশক্তি দিয়ে মুক্তি বাহিনীর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। সমস্ত শহর তখন জনশূন্য। প্রাণপণ বাঁচার আদিম উগ্রতায় শহরবাসী চলছে গ্রামের আশ্রয়ে। দুর্গত শহরের সাক্ষী ডা. শামসুদ্দীন আর তার রোগী।
ছাত্রদের প্রতি ডা. শামসুদ্দীন— ‘আমরা প্রবীণ। আহত বাঙালিদের সেবায় আমাদের থাকতে দাও। তোমরা নবীন যুবক, নিজেদের বুদ্ধি খাটিয়ে কাজ কর। এখানে থেকে বর্বর পশুদের শিকার হয়ে কোনো লাভ নেই।’
ডাক্তারদের প্রতি— ‘কোথায় যাবেন আপনারা? আমরা ডাক্তার। রোগী ফেলে আহত মানুষ ফেলে আমরা তো কোথাও যেতে পারি না।’
—(ওরা ডাক্তার মেরেছে)
৯ এপ্রিল সিলেট শহরে তখন যুদ্ধ চলছে। সিলেটের লাক্কাতুরা চা-বাগান ও বিমানবন্দরে পাকিস্তানি বাহিনীর ঘাঁটিতে প্রতিরোধযোদ্ধারা তীব্র আক্রমণ চালাতে থাকেন। এদিন সেই হাসপাতাল থেকে অদূরে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর একটি গাড়িবহরে হামলা চালান প্রতিরোধযোদ্ধারা।
এ হামলার পরই পাকিস্তানি বাহিনী ঘিরে ফেলে হাসপাতাল। হাসপাতালে কোনো প্রতিরোধযোদ্ধা না থাকলেও তারা ডা. শামসুদ্দীন, ডা. শ্যামল, চালক কোরবান ও নার্স মাহমুদুরকে টেনে-হিঁচড়ে সীমানা প্রাচীরের পাশে দাঁড় করায়।
ডা. শামসুদ্দীন নিজের পরিচয় দেওয়ার পরও তাদের লক্ষ্য করে গুলি চালায় পাকিস্তানি সেনারা। তিনটি গুলি লাগে ডা. শামসুদ্দীনের গায়ে। গুলিতে শহীদ হন বাকিরাও।
জেনেভা কনভেনশনের নীতি ভেঙে এভাবেই পাকিস্তানি হানাদাররা হত্যা করে সেবাদান কাজে নিয়োজিত দুই জন ডাক্তার, একজন সেবক এবং একজন অ্যাম্বুলেন্সচালককে।
১৩ এপ্রিল প্রতিরোধযোদ্ধারা সিলেট শহর মুক্ত করতে না পেরে পুনরায় শক্তি সঞ্চয়ের জন্য দূরে সরে যাওয়ার পর সেদিন কিছু সময়ের জন্য তুলে নেওয়া হয় কারফিউ। তখন স্বজন ও পরিচিতজনেরা হাসপাতালে এসে হাসপাতাল প্রাঙ্গণেই তাদের সমাহিত করেন।
ডা. শামসুদ্দীন আহমদ ও অন্যান্যদের হত্যার পর মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষ ও হাসপাতালের সুপারিনটেনডেন্ট লেফটেন্যান্ট কর্নেল ডা. আবুল ফজল জীয়াউর রহমান বুঝতে পারেন যে পরবর্তীতে তাকেও হয়তো হত্যা করা হতে পারে।
মুক্তিযুদ্ধ শুরুর আগে মার্চেই তাকে পশ্চিম পাকিস্তানের ইসলামাবাদে ফিরে যেতে আদেশ দেওয়া হলেও তিনি নিজভূমিতে থেকে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। এ জন্য মার্চের ১৫ তারিখ থেকেই তাকে গৃহবন্দি করে রাখা হয়। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকে ডা. শামসুদ্দীনদের হত্যার পরেও তাকে বারবার ইসলামাবাদে চলে যাওয়া জন্য জানানো হয়।
১৪ এপ্রিল সকালে জীয়াউর স্ত্রীকে একটু নাশতা বানানোর কথা বলে গোসল করে ফিরে দেখেন পাকিস্তানি বাহিনী তাকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য নিতে এসেছে। সেই যাওয়াই তার শেষ যাওয়া ছিল। এরপর তার আর কোনো সন্ধান পাওয়া যায়নি।
তৎকালীন সিলেট মেডিকেল কলেজ প্রাঙ্গণের যে স্থানে সমাহিত করা হয়েছিল শহীদ ডা. শামসুদ্দীন আহমদ, ডা. শ্যামল কান্তি লালা, অ্যাম্বুলেন্সচালক কোরবান আলী ও নার্স মাহমুদুর রহমানকে, সেখানে স্বাধীনতা পরবর্তীতে গড়ে তোলা হয় বুদ্ধিজীবী স্মৃতিস্তম্ভ। আর এ স্মৃতিস্তম্ভে তাদের সঙ্গে স্মরণ করা হচ্ছে লেফটেন্যান্ট কর্নেল ডা. আবুল ফজল জীয়াউর রহমানকেও।
নিবন্ধটি দ্য ডেইলি স্টার বাংলায় প্রথম প্রকাশিত এবং সিলেট ভয়েসে পুণঃপ্রকাশিত।