এমপিদের ‘ট্রাম্পকার্ড’ ইউপি চেয়ারম্যানরা

আগামী ২১ মে অনুষ্ঠেয় দ্বিতীয় ধাপের উপজেলা নির্বাচনে লক্ষ্মীপুরের রায়পুরে প্রার্থী হয়েছেন অধ্যক্ষ মামুনুর রশিদ। তিনি স্থানীয় এমপি অ্যাডভোকেট নুরউদ্দিন চৌধুরী নয়নের ভগ্নিপতি। এ উপজেলার ১০টি ইউনিয়নের মধ্যে প্রায় সবকটির চেয়ারম্যানকে নিজের ভগ্নিপতির পক্ষে ঐক্যবদ্ধ করেছেন এমপি। মাত্র দুজন চেয়ারম্যান এমপির নির্দেশনার বাইরে গিয়ে অন্য প্রার্থীর হয়ে কাজ করছেন।

এভাবে সারা দেশে নিজেদের আত্মীয়স্বজন ও অনুগত প্রার্থীদের জয় নিশ্চিত করতে ইউনিয়ন পরিষদ (ইউপি) চেয়ারম্যানদের ‘ট্রাম্পকার্ড’ হিসেবে ব্যবহার করছেন মন্ত্রী ও স্থানীয় এমপিরা। এসব ক্ষেত্রে ইউপি চেয়ারম্যানদের টিআর, কাবিখা, কাবিটা, বিভিন্ন ভাতাসহ স্থানীয় নানা উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের অঙ্গীকার ও প্রলোভন দিচ্ছেন মন্ত্রী-এমপিরা। তাদের কথার বাইরে গেলে সরকারি এসব সুযোগ-সুবিধা বন্ধের হুমকিও দিয়েছেন অনেকে। ফলে ইউপি চেয়ারম্যানরা পছন্দের বাইরে হলেও একরকম চাপের মুখেই মন্ত্রী-এমপিদের সিদ্ধান্ত মেনে নিতে বাধ্য হচ্ছেন। তবে কোথাও কোথাও মন্ত্রী-এমপিদের চাপিয়ে দেওয়া সিদ্ধান্ত ও হুমকি উপেক্ষা করে প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীর পক্ষে কাজ করছেন কোনো কোনো ইউপি চেয়ারম্যান।

নির্বাচন বিশেষজ্ঞদের মতে, নির্বাচনী বিধি অনুযায়ী উপজেলা নির্বাচনে মন্ত্রী-এমপিদের নির্বাচনী প্রচার ও হস্তক্ষেপের সুযোগ নেই। কিন্তু তারা সেটির কোনো তোয়াক্কা করছেন না। নির্বাচন কমিশন ও দলের শীর্ষ পর্যায় থেকে এ ব্যাপারে বারবার নিষেধ করা হলেও, তারা এ নির্বাচনে সরাসরি এবং কোনো কোনো ক্ষেত্রে অন্তরালে হস্তক্ষেপ করে চলেছেন। নির্বাচন কমিশন সব কিছু জানলেও তারা কঠিন কোনো পদক্ষেপ নিচ্ছে না। এতে মন্ত্রী-এমপিরা আরও বেপরোয়া হয়ে উঠেছেন। ভোটারদের পাশাপাশি তারা উন্নয়ন বরাদ্দের প্রলোভন ও ভয়ভীতি দেখিয়ে স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যানদেরও জিম্মি করে রাখছেন। এ ব্যাপারে কমিশনকে শক্ত পদক্ষেপ নিতে হবে।

স্থানীয় সরকার (উপজেলা) নির্বাচনী আচরণবিধি অনুযায়ী, ইউপি চেয়ারম্যানদের নির্বাচনী প্রচার-প্রচারণায় কোনো বাধানিষেধ নেই। ফলে চেয়ারম্যানরা এমপির প্রার্থীর পক্ষে সংশ্লিষ্ট ইউপিগুলোয় ব্যাপক প্রভাব বিস্তার করে থাকেন। তা ছাড়া ইউপি চেয়ারম্যানদের এমপির বাইরে যাওয়ারও তেমন সুযোগ নেই। কারণ, সংশ্লিষ্ট সংসদীয় আসনের অভিভাবক এবং সবকিছুর নিয়ন্ত্রকের ভূমিকায় থাকেন এমপিরাই। নির্বাচন কমিশনের তথ্য অনুযায়ী, আগামী বছরের শেষে অথবা ২০২৬ সালে ইউপি নির্বাচন শুরু হবে। ওই নির্বাচনে ইউপি চেয়ারম্যানদের ভাগ্য নির্ধারণের দায়িত্বেও থাকবেন এসব এমপি। দলীয় মনোনয়ন না থাকলেও প্রভাব প্রতিপত্তির কারণে বেশিরভাগ ইউপি চেয়ারম্যান প্রার্থী এমপিদের শরণাপন্ন হবেন। এমন সুযোগে এমপি-মন্ত্রীদের ভোটের প্রচারে নিষেধাজ্ঞা থাকলেও তারা সুকৌশলে ইউপি চেয়ারম্যানদের ভোটের মাঠে নামিয়েছেন। ওই ইউপি চেয়ারম্যানরা আবার মেম্বারদের সঙ্গে নিয়ে এমপির প্রার্থীর পক্ষের হয়ে কাজ করছেন বা করবেন।

সম্প্রতি অনুষ্ঠিত প্রথম ধাপের নির্বাচনে পাংশা উপজেলায় পরাজিত প্রার্থী অধ্যাপক ফরিদ হাসান ওদুদ অভিযোগ করে বলেছেন, ‘পাংশার ১০টি ইউনিয়ন রয়েছে। এর মধ্যে রেলমন্ত্রী জিল্লুল হাকিমের নিয়ন্ত্রণ ছিলেন আটজন চেয়ারম্যান। এই আট ইউনিয়নের মধ্যে চারটি ইউপিতেই ব্যালটে ব্যাপক সিল মেরে আমাকে পরাজিত করা হয়।’ এরকম অভিযোগ পরাজিত অন্য প্রায় সব প্রার্থীরই।

নোয়াখালীর সুবর্ণচর উপজেলায় পরাজিত প্রার্থী ও জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি অধ্যক্ষ এ এইচ এম খায়রুল আনম (সেলিম) জানান, এ উপজেলার আটটি ইউনিয়নের মধ্যে পাঁচটি ইউপি চেয়ারম্যানকেই নানা ভয়ভীতি দেখিয়ে স্থানীয় এমপি একরামুল করিম চৌধুরী তার ছেলে শাবাব চৌধুরীর পক্ষে মাঠে নামিয়েছিলেন। তাদের মধ্যে রয়েছেন ২ নম্বর চরবাটা ইউপির আমিনুল ইসলাম, ৫ নম্বর চর জুবলীর শহিদুল্লাহ খসরু, ওয়াপদা ইউপির আব্দুল মান্নান, চর আমানুল্লার বেলায়েত হোসেন ও চর ক্লার্কের আবুল বাসার। তারা সবাই এমপির পক্ষ হয়ে ভোটারদের ভয়ভীতি দেখান ও প্রভাব বিস্তার করেন।

স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, আগামী ২৯ মে অনুষ্ঠেয় সাতক্ষীরার কলারোয়া উপজেলা নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন বর্তমান উপজেলা চেয়ারম্যান আমিনুল ইসলাম লাল্টু। ২০১৯ সালের নির্বাচনে তিনি স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়ে পরাজিত করেছিলেন তৎকালীন নৌকার প্রার্থী ও বর্তমান এমপি ফিরোজ আহম্মেদ স্বপনকে। তবে সবকিছু ভুলে এই আলতাফ হোসেন লাল্টুই এবার উপজেলা নির্বাচনে বর্তমান এমপি ফিরোজের প্রার্থী। আর নিজের এই প্রার্থীকে বিজয়ী করতে স্থানীয় এমপি একাধিকবার বিভিন্ন ইউপি চেয়ারম্যানদের সঙ্গে বৈঠক করেছেন। বর্তমানে কলারোয়ার ১২টি ইউপির বেশিরভাগ চেয়ারম্যানই এমপি ফিরোজের নিয়ন্ত্রণে। তাদের মধ্যে ১ নম্বর জয়নগর ইউপির চেয়ারম্যান তপন সাহা, ২ নম্বর জালালাবাদের চেয়ারম্যান নিশান, ৩ নম্বর কয়ড়া ইউপির চেয়ারম্যান সোহেল, ৪ নম্বর লাঙ্গঝাড়া ইউপির আবুল কালাম, ৫ নম্বর কেড়াগাছি ইউপির আবজাল হোসেন হাবিল, ৬ নম্বর সোনাবাড়িয়া ইউপির বেনজির, ১১ নম্বর ইউপির চেয়ারম্যান মাহবুবুর রহমান মফে প্রকাশ্যে এমপির প্রার্থীর পক্ষে মাঠে নেমেছেন।

জানতে চাইলে সুশাসনের জন্য নাগরিক-সুজন সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার বলেন, ‘নির্বাচন কমিশন সব কিছু জানলেও তারা কঠিন কোনো পদক্ষেপ নিচ্ছে না। এতে মন্ত্রী-এমপিরা আরও বেপরোয়া হয়ে উঠেছেন। ভোটারদের পাশাপাশি তারা উন্নয়ন বরাদ্দের প্রলোভন ও ভয়ভীতি দেখিয়ে স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যানদেরও জিম্মি করে রাখছেন। এ ব্যাপারে কমিশনকে শক্ত পদক্ষেপ নিতে হবে।’

এ ব্যাপারে নির্বাচন কমিশনের অতিরিক্ত সচিব অশোক কুমার দেবনাথ বলেন, ‘উপজেলা ভোটে ইউপি চেয়ারম্যানদের জন্য কোনো বিধিনিষেধ নেই। তবে মন্ত্রী-এমপিরা প্রভাব বিস্তার করলে সুনির্দিষ্ট তথ্যের ভিত্তিতে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। আর কোনো এমপি ইউপি চেয়ারম্যানদের হুমকি-ধমকি বা ভয়ভীতি দেখিয়ে প্রভাব বিস্তার করতে চাইলে তারা স্থানীয় প্রশাসনের সহযোগিতা নিতে পারেন।’ – কালবেলা