একটি গল্প নিজের হবে, যে গল্পের প্রতিটা শব্দ হবে একজন সফল মানুষের। বিশ্ববিদ্যালয়ের উচ্চতর শিক্ষা অর্জন শেষে তাই নিজের একটি গল্প তৈরীতে উদ্যোগী হোন নাহিদ আক্তার স্বাতী।
স্বাতী স্বপ্ন দেখতেন তাঁর নিজস্ব একটা পরিচয় থাকবে, যা দিয়ে সবাই তাঁকে চিনবে। স্বাতীর এ স্বপ্নই তাঁকে উদ্যোক্তা হওয়ার প্রেরণা দিয়েছে। ছোটবেলা থেকে দাদি-নানির গল্প শুনতে শুনতে বড় হয়েছেন স্বাতী।
বেশি নয় মাত্র ৫ বছর আগে- সময়টা ছিল করোনাকাল। পুরো পৃথিবী মহামারীর কবলে, সবকিছু স্থবির। মানুষের হাতে ছিল অফুরন্ত সময়। নিজের অস্থিরতা দূর করতে স্বাতী ২০২০ সালের জুন মাসে অনলাইনে শুরু করেন ব্যবসার কাজ। এটাই স্বাতী’র “গল্পের শুরু”, অনলাইনভিত্তিক ব্যবসায়িক উদ্যোগের নাম।
নামকরণ নিয়ে স্বাতীর ভাষ্যে, ‘আমার ইচ্ছা নিজের একটা গল্প থাকবে, বলার মতো। যে গল্পে আমাকে সবাই চিনবে। তাই ‘গল্পের শুরু’ নাম দিয়ে শুরু করলাম কাজ। এটা অনলাইনভিত্তিক দেশীয় পোশাক এবং খাদ্যসামগ্রীর প্রতিষ্ঠান হলেও আমি এটাকে আমার জীবনের গল্পের অংশ বলে মনে করি। তাই এই নাম।’
স্বাতী; পুরো নাম নাহিদ আক্তার স্বাতী। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে লোক প্রশাসনে স্নাতকোত্তর। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় থেকেই সুবিধাবঞ্চিত মানুষদের সঙ্গে কাজ করতেন। আর সে থেকেই কিছু একটা করার স্বপ্ন দেখেন। সেই স্বপ্নই তাঁকে নিয়ে যায় ‘গল্পের শুরু’-র কাছে।
যাত্রা শুরু হলো কিভাবে এমন প্রশ্নের উত্তরে নাহিদা বলেন – বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ চুকিয়ে টানা ১৫ বছর চাকুরী করেছেন ডেভেলাপমেন্ট সেক্টরে। আর চাকুরীর সুত্রেই তার সিলেটে আসা। কিন্তু চাকুরীতে অর্থনৈতিক সক্ষমতা অর্জন করলেও মানসিক শান্তির কিছুটা ঘাটতি ছিল। তাই নিজের চিন্তা ভাবনা থেকেই একসময় চাকুরী ছেড়ে দিয়ে তিনি উদ্যোক্তা হওয়ার স্বপ্ন দেখেন । যেই ভাবনা সেই কাজ; মায়ের দেওয়া ১০ হাজার টাকা দিয়ে শুরু করলেন ‘গল্পের শুরু’।
মাত্র দশ হাজার টাকা দিয়ে শুরু করা সেই প্রতিষ্ঠান থেকে এখন মাস শেষে তার আয় ৮০ হাজার থেকে লক্ষ টাকা। উদ্যোক্তা হওয়ার পেছনে পরিবারের সহযোগিতা পেয়েছেন কি-না জানতে চাইলে স্বাতী বলেন, ‘আমার পরিবারের সহযোগিতায় আমি এত দূর এসেছি। পরিবারের সার্বিক সহযোগিতা না পেলে হয়তো এত দূর আসতে পারতাম না। পরিবারের পাশাপাশি পরিচিত বন্ধুরাও উৎসাহ দিয়েছেন। তাঁদের সকলের নাম আমার হৃদয়ের মণিকোঠায় শ্রদ্ধাভরে খচিত থাকবে।’
কি আছে “গল্পের শুরু”-তে? এই প্রশ্নের চেয়ে যদি বলা হয় ‘কি নেই?’ তবেই যথার্থ হয়। গাওয়া ঘি, মিক্সড ফ্রুট ও শীত মৌসুমে খেজুরের রসের ঝোলাগুড় এবং পাটালি গুড় পাওয়া যায়। আরও পাওয়া যায়, সুন্দরবনের খাঁটি মধু। প্রাকৃতিক চাকের মধু সংগ্রহ করা হয় সুন্দরবনের বিশ্বস্ত মৌয়ালের কাছ থেকে। আর চা-পাতা, ক্লোন-টি, গ্রিণ-টি সংগ্রহ করা হয় চায়ের রাজধানী শ্রীমঙ্গল থেকে।
খাবারের পাশাপাশি রয়েছে নানা ডিজাইনের পোশাক, শাড়ি। এখানকার জামদানি, মণিপুরী, ব্লক-বাটিক এবং টাঙ্গাইল পোশাকগুলো সরাসরি সংগ্রহ করা হয় তাঁতীদের কাছ থেকে। স্বাতীর মতে, এভাবে সংগ্রহ করা হয় বলেই ‘গল্পের শুরু’-এর পণ্যের গুণগত মান নিয়ে নিশ্চিন্ত থাকা যায়।
উদ্যোক্তা জীবনের প্রত্যেকের নিজস্ব একটা ছন্দ থাকে। সে ছন্দের সঙ্গে তাল মিলিয়ে নিজেকে এগিয়ে নেওয়াটাই হলো জীবন।
অনেক ঝড়-ঝাপটা সামলিয়ে উদ্যোক্তা জীবন কেমন লাগছে জানতে চাইলে স্বাতী বলেন, ‘কেমন লাগছে, সেটা এক বাক্যে প্রকাশের মতো না। মিশ্র একটা অনুভূতি। অনেক ভালো লাগে, যখন নিজের কাজ সম্পর্কে ভালো কোনো কথা শুনি। কখনো কাজের চাপে হাঁপিয়ে উঠি, হতাশা চলে আসে। তার পর আবার একটা ভালো খবর শুনে উৎফুল্ল হয়ে উঠি। এই তো, এভাবেই কেটে যাচ্ছে উদ্যোক্তা জীবনের দিনগুলি।’
উদ্যোক্তা জীবন মানেই ভালো-মন্দের সঙ্গে মানিয়ে সামনের দিকে এগিয়ে চলা। সমাজে ঠিকে থাকতে হলে একজন নারী উদ্যোক্তাকে সামাজিকভাবে বহু সমস্যার মুখোমুখি হতে হয়। সময়ে-অসময়ে অনলাইনে বিড়ম্বনার সম্মুখীন হতে হয়। অনেকের ক্ষেত্রে উদ্যোক্তার জীবন মোটেও সুখকর বিষয় হয় না। প্রতিনিয়ত লড়াই করে ব্যবসার কাজকে টিকিয়ে রাখতে হয়।
স্বাতীর কাছে উদ্যোক্তা জীবনে প্রতিবন্ধকতার মুখোমুখি হয়েছেন কি-না জানতে চাইলে বলেন, ‘একজন নারী উদ্যোক্তার লড়াইয়ের গল্প বলতে গেলে আসলে ঠিকঠাক বলা যায় না। কারণ, কেবল লড়াইয়ের সময়গুলোতে সমস্যার মুখোমুখি হলে অনুভূতিগুলো অনুভব করা যায়। আমার সামাজিক অবস্থান থেকে তাঁতি, চাষি ভাইদের সঙ্গে কাজ করা কতটুকু মানানসই, মেয়েদের খাদ্যপণ্য নিয়ে কাজ করা চাট্টিখানি কথা না, চাকরি আছে তো আবার ব্যবসার উদ্যোগ নেওয়া কি বাড়াবাড়ি হয়ে যায় না, আমি বেশি দূর আগাতে পারব না, মজুত করা পোশাকগুলো বিক্রি করা যাবে কিনা—এ রকম অসংখ্য কথা শুনতে হয়। কখনো কখনো হাসিমুখে উড়িয়ে দিয়েছি এসব কথা। আবার অনেক সময় খারাপ লাগতো কারও কারও বলার ভঙ্গিতে। মন খারাপ হতো, আবার কাটিয়ে উঠতাম।
“গল্পের শুরু” পেজ থেকে বিক্রি বেশি হওয়ায় এখন অন্যদের হিংসাত্মক আক্রমণের মুখোমুখি হতে হচ্ছে। সবকিছুর পরও নিজের স্বপ্নটাকে হারিয়ে ফেলিনি। “গল্পের শুরু”-কে এখন পর্যন্ত শক্ত হাতে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছি। বড় ধরনের কোনো প্রতিবন্ধকতার সম্মুখীন হইনি। ছোটখাটো যেসব প্রতিবন্ধকতা তৈরি হয়েছিল, সেসব কাটিয়ে উঠতে পেরেছি। যোগ করেন স্বাতী।
সব শেষে তিনি বলেন – নিজের কাজের পরিধি বৃদ্ধি করতে নানান পরিকল্পনা রয়েছে তার । তার প্রতিষ্ঠান গল্পের শুরুকে তিনি নিজ সন্তানের সাথে তুলনা করে বলেন –আমার জন্য আমার কাজটা, আমার স্বপ্নটা, আমার উদ্যোগটা কেবল আমারই।
গল্পের শুরুর ভবিষ্যৎ স্বপ্নের বিষয়ে স্বাতী বলেন, ‘আমি সব সময় চিন্তা করি আমি সৎ পথে থাকব। মানুষের জন্য কাজ করবো। আমি এখন ইউনিসেফের একটি প্রকল্পে কর্মরত। আগামী ১০ এপ্রিল আমার প্রকল্পের কাজ শেষ হয়ে যাবে। প্রকল্প শেষ হলে আমি বেকার হয়ে যাব। কিন্তু আমি মোটেও হতাশ না। আমি “গল্পের শুরু” নিয়ে সামনের দিকে এগিয়ে যেতে চাই। আমি আমার স্বপ্নের হাত ধরে বহু দূর হেঁটে যেতে চাই।’