গত ১০ অক্টোবর থেকে নতুন করে শুরু হওয়া রাশিয়ার বিমান হামলাগুলোর টার্গেট ইউক্রেনের জ্বালানি স্থাপনাগুলো। এমন বাস্তবতায় নতুন করে বিপর্যস্ত ইউক্রেন।
ইউক্রেন সরকার বলছে, রুশ হামলার কারণে রাজধানী কিয়েভের একাংশসহ বিভিন্ন শহর পানি ও বিদ্যুৎহীন হয়ে পড়েছে। এমনকি ইউক্রেনের পরিস্থিতি এখন সংকটজনক বলেও জানিয়েছেন প্রেসিডেন্ট জেলেনস্কির এক সহকারী।
প্রসিকিউটররা বলছেন, রাজধানীতে হামলায় দুজন নিহত হয়েছেন। ডিনিপ্রো নদীর কাছে একটি পাওয়ার স্টেশনের চারপাশ থেকে ধোঁয়া উড়তে দেখা গেছে।
কিয়েভের পশ্চিমে জাইটোমিরে বিদ্যুৎ ও পানি সংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে। ডিনিপ্রো শহরের জ্বালানি স্থাপনা হামলার ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
প্রেসিডেন্ট কার্যালয়ের উপপ্রধান কিরিলো টিমোশেঙ্কো বলেন, ‘প্রথমত, বিদ্যুত সংরক্ষণের জন্য সবাইকে প্রস্তুত থাকতে হবে। দ্বিতীয়ত, হামলা অব্যাহত থাকলে দীর্ঘ মেয়াদে ব্ল্যাকআউটের আশঙ্কা উড়িয়ে দেয়া যাচ্ছে না। আসন্ন শীতে কঠিন পরীক্ষার জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে ইউক্রেনবাসীকে।’
প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি মঙ্গলবার টুইটারে বলেছেন, গত আট দিনে ইউক্রেনের ৩০ শতাংশ পাওয়ার স্টেশন ধ্বংস হয়ে গেছে। এতে সারা দেশে ব্যাপক ব্ল্যাকআউট দেখা দিয়েছে।
ইউক্রেনের জ্বালানি সংস্থা ডিটিইকে বলছে, রাশিয়ার গোলাবর্ষণে তাদের দুটি তাপবিদ্যুৎকেন্দ্র উল্লেখযোগ্যভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। হামলায় এক শ্রমিক নিহত এবং ছয়জন আহত হয়েছেন।
রাশিয়া সম্প্রতি ফ্রন্টলাইন থেকে দূরের শহরগুলোর বিদ্যুৎ অবকাঠামোতে হামলা জোরদার করেছে। কর্মকর্তারা ক্ষয়ক্ষতি মেরামতে ছুটে আসলেও, শীতের আগে সেগুলো চালু করতে বেগ পোহাতে হতে পারে তাদের।
গত ২৪ ঘণ্টায় ইউক্রেনের বিভিন্ন শহরে ‘কামিকাজে’ ড্রোন দিয়ে হামলা চালাচ্ছে রাশিয়া। ইউক্রেনের দাবি, এই ড্রোনগুলো মস্কোকে সরবরাহ করেছে তেহরান। ইউক্রেন সরকারের দাবি, ‘কামিকাজে’ ড্রোন হামলায় কিয়েভ এবং সুমি শহরে গত ২৪ ঘণ্টায় কমপক্ষে ৯ জন নিহত হয়েছেন। জ্বালানি অবকাঠামোতে হামলার কারণে শত শত শহর ও গ্রামে বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে।
মঙ্গলবারের হামলার কতগুলো ড্রোন ব্যবহার হয়েছে তা স্পষ্ট নয়। ইউক্রেন সরকার বলছে, রাশিয়ান বোমারু বিমান মিসাইল নিক্ষেপ করছে। দক্ষিণাঞ্চলীয় শহর মাইকোলাইভের একটি আবাসিক ভবনে গত রাতে একটি এস-৩০০ বিমান বিধ্বংসী মিসাইল আঘাত হেনেছে। এতে একজন নিহত হয়েছেন। নগরীর একটি ফুলের বাজারও ধ্বংস হয়ে গেছে।
মঙ্গলবার যে শহরগুলো আক্রান্ত হয়েছে :
জাইটোমাইরের মেয়র জানিয়েছেন, শহরে কোথাও কোনো বিদ্যুৎ বা পানি নেই। হাসপাতালগুলো কাজ করছে ব্যাক-আপ পাওয়ারে। জাইটোমাই অঞ্চলের ১১টি গ্রাম বিদ্যুৎবিহীন হয়ে আছে।
ডিনিপ্রোতে বিদ্যুৎ এবং পানি সরবরাহ ব্যাহত হচ্ছে। শহরের বড় জ্বালানি স্থাপনায় রুশ মিসাইলে ধ্বংস হয়ে গেছে। শহর কর্তৃপক্ষ বলছে, বাধ্য হয়ে রাস্তার সব বাতি বন্ধ রাখা আছে। গোলাগুলির খবর পাওয়া গেছে উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় শহর খারকিভে।
দক্ষিণাঞ্চলীয় শহর জাপোরিঝিয়ায় অনেক অবকাঠামো ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। যদিও স্থানীয় কর্মকর্তারা বলেছেন, হামলায় কেউ আহত হয়নি।
রুশ হামলায় জ্বালানি স্থাপনাগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায়, ইউক্রেন সরকার জনগণকে জ্বালানি ব্যবহারে সাশ্রয়ী হওয়ার পরামর্শ দিয়েছে। এই অবস্থায় দেশটির অনেক শহরের পাওয়ার জেনারেটর এবং গ্যাস বার্নার কেনার হিড়িক পড়েছে। কিছু শহর ইতোমধ্যে ব্ল্যাকআউটের সঙ্গে লড়াই করছে।
এদিকে, ইউক্রেনের রাষ্ট্রীয় পারমাণবিক শক্তি কোম্পানি ভিযোগ তুলেছে যে জাপোরিঝিয়ার বিদ্যুৎ কেন্দ্রের দুই কর্মকর্তাকে অপহরণ করেছে মস্কো। বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি রুশ বাহিনীর দখলে থাকায়, কঠিন পরিস্থিতিতে সেখানে ইউক্রেনীয় কর্মীরা কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন।
ইউক্রেনের সাংসদ লেসিয়া ভ্যাসিলেনকো বিবিসিকে বলেন, আশঙ্কা করছিলাম রাশিয়া জ্বালানি স্থাপনা এবং বেসামরিক অবকাঠামোর ওপর আক্রমণ জোরদার করবে এবং শরতের দিকে শহুরে এলাকায় আরও শক্তি প্রয়োগ করবে। সেই আশঙ্কায় সত্যি হলো। আমরা এখন ঠিক সেই পরিস্থিতিতেই রয়েছি।’
রাশিয়ার বিমান ও ড্রোন হামলা শুরুর পর থেকেই বিমান প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার জন্য পশ্চিমের দিকে চেয়ে আছে ইউক্রেন সরকার। কিয়েভ এবং সুমিতে ভয়াবহ হামলায় ব্যবহৃত ড্রোনকে শাহেদ-১৩৬ হিসেবে চিহ্নিত করেছে ইউক্রেন।
যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তরের বেদান্ত প্যাটেল বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্র নিষেধাজ্ঞা ব্যবহার করতে দ্বিধা করবে না। অন্যদিকে, ইইউ জানিয়েছে তারা প্রমাণ সংগ্রহ করছে।
রাশিয়া ও ইরান দুই দেশই ইরানের ড্রোন মোতায়েন করার বিষয়টি অস্বীকার করেছে। তবে ইউক্রেনের পশ্চিমা কর্মকর্তারা বলছেন, এগুলো যে ইরানের তৈরি ড্রোন সে বিষয়ে তাদের কোন সন্দেহ নেই। বিদ্যুৎ নেটওয়ার্কে হামলার জন্য এই ড্রোনগুলো আমদানি করেছে রাশিয়া।
ইউক্রেনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী দিমিত্রো কুলেবা বলেছেন, প্রেসিডেন্ট জেলেনস্কিকে তিনি তেহরানের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন করতে বলবেন। অবিলম্বে বিমান প্রতিরক্ষা সরবরাহের জন্য ইসরায়েলকে একটি অফিসিয়াল নোট পাঠানো হবে।
ইসরায়েলি কর্মকর্তারা কিয়েভে অস্ত্র পাঠানো বন্ধ করে দিয়েছে। রাশিয়ার শীর্ষ কূটনীতিক দিমিত্রি মেদভেদেভ অবশ্য আগেই সতর্ক করেছেন যে তেল আবিব যদি কিয়েভকে অস্ত্র দেয় তবে তাদের সঙ্গে মস্কোর সম্পর্ক পুরোপুরি শেষ হয়ে যাবে।
এদিকে ফেব্রুয়ারিতে যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকে সবচেয়ে বড় বন্দি অদলবদলের হয়েছে মস্কো-কিয়েভের মধ্যে। জানা গেছে, দুই দেশের মধ্যে ২১৮ জন বন্দী বিনিময় করা হয়েছে; যার মধ্যে আছেন ১০৮ জন ইউক্রেনীয় নারী।