আরণ্যক: অরণ্য প্রকৃতির অনন্য উপাখ্যান

১৯৩৯ সালে প্রকাশিত বিখ্যাত কথাসাহিত্যিক বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের চতুর্থ উপন্যাস।

প্রবীণ সাহিত্যিক বিভূতিভূষণ মুখোপাধ্যায় ‘আরণ্যক’ সম্পর্কে বলেছেন- “অরণ্যকে পটভূমি করে যে কোনো রকমের উপন্যাস হতে পারে, তা ‘আরণ্যক’ রচনার আগে বাঙালি পাঠকসমাজ উপলব্ধি করেননি।” সম্প্রতি কিংবদন্তি শিল্পী অঞ্জন দত্তের সাথে কথোপকথনের এক পর্যায়ে আরেক গুণী শিল্পী কবির সুমন মন্তব্য করেছেন- “আরণ্যক উপন্যাসের জন্য খানপাঁচেক নোবেল পুরস্কার পাওয়ার যোগ্যতা ছিল বিভূতিভূষণের।”

বাংলা সাহিত্যের এই অনন্যসাধারণ উপন্যাসটি তাই পাঠ না করলে পাঠকরা বঞ্চিত হন মানুষ ও প্রকৃতির এক নিবিড় আখ্যান থেকে। উপন্যাসটির দুটি মাত্র বিষয়বস্তুকে আশ্রয় করে গড়ে উঠেছে- প্রকৃতি ও মানুষ। প্রথমেই বলে রাখা প্রয়োজন, আরণ্যক উপন্যাসটি উত্তম পুরুষে রচিত এবং উপন্যাসের একটি বিশেষ চরিত্র সত্যচরণ নামক কলকাতার জনৈক যুবক যে চাকরি সূত্রে উপন্যাসে বর্ণিত অরণ্য উপদ্রুত অঞ্চলে সমাগত- তারই জবানিতে।

একই সাথে বলে রাখি, আরণ্যক উপন্যাসের কোনো কেন্দ্রীয় চরিত্র সহজ কথায় নায়ক নেই। কিন্তু একজন নায়িকা আছেন- আর তিনি স্বয়ং প্রকৃতি দেবী। প্রকৃতপক্ষে এই উপন্যাসের কাহিনী এটি একটি দ্বিতল কাহিনীরূপে পরিকল্পিত হয়েছে- একটি সৌন্দর্য  উপভোগের আর অন্যটি সৌন্দর্য স্মৃতির।

বেশিরভাগ উপন্যাসেই ঔপন্যাসিকগণ মানুষের মনোজগতের চিন্তা-চেতনা বর্ণনা করতে গিয়ে প্রকৃতির দ্বারস্থ হয়েছেন। এদিক বিবেচনায় আরণ্যক সম্পূর্ণ ব্যতিক্রমধর্মী একটি উপন্যাস যেখানে লেখক প্রকৃতির অমৃতসুধা পান করে সেই অকৃত্রিম আস্বাদের বর্ণনা পাঠকসমাজের কাছে জীবন্ত করে তুলতে মানুষের শরণাপন্ন হয়েছেন।

গল্পের সুত্রধার সত্যচরণ চাকরির সুবাদে আরণ্য ভূখণ্ডে কয়েকবছর অবস্থান করায় তিনি বাইরের তথাকথিত সভ্য জগতের সঙ্গে জঙ্গলাকীর্ণ স্থানের সংযোগ সাধন করেন। বস্তুত এই দুই জগতের সাথে যে বিস্তর ফারাক যা উপন্যাসের থরে-বিথরে আত্মগোপন করেছে তা সত্যচরণের উপস্থিতি ভিন্ন অনুধাবন করা দুষ্কর। একজন পুরোদস্তুর শহুরে মানুষ অরণ্যভূমিতে পদার্পণ করে কিছুতেই  প্রকৃতির সাথে নিজে একাত্ম হতে পারছে না। কারণ একটাই- সে অরণ্যের নয়; সভ্য জগতের লোক। অরণ্যের প্রতি তাই এক ধরনের মন উদাসীনতা থাকলেও ধীরে ধীরে সে অরণ্যের নেশাময় সবুজের আবেশে বিভোর হয়ে উঠে।

অরণ্য প্রকৃতির এইরূপ নেশাময় প্রভাবে সে দেখতে শিখে কবির চোখে। অরণ্যে বসবাসের সময়টায় সে সেখানকার বিচিত্র কিছু চরিত্রের মুখোমুখি হয়। যদিও এই উপন্যাসে কোন লাগোয়া গল্পের পশরা নেই। যা আছে তা খণ্ডবিখণ্ড মানবকূলের দৈন্য দারিদ্রের সাথে অরণ্যের যোগসাজশে পরিস্ফুট আখ্যান। রাজু পাঁড়ে- অতি দরিদ্র নিরীহ ধর্মপ্রাণ কবিরাজ,  নাটুয়া বালক- ধাতুরিয়া, সুদে টাকা খাটানো মহাজন- ধাওতাল সাহু, টোলে ছাত্র পড়ানো এক খায়েশী চরিত্র-মটুকনাথ পাঁড়ে, কিংবা উদ্ভিদ প্রেমিক- যুগল প্রসাদ, পোড়াকপালি- মোসাম্মৎ কুন্তা, মঞ্চী- নামক কাটুনী মজুরের এক তরুণী স্ত্রী, সাঁওতাল রাজা দোবরো পান্নার নাতনীর মেয়ে -ভানুমতী- কী বিচিত্র একেকজন জীবন্ত চরিত্র!

এদের সাথে অন্তরঙ্গতার সূত্র ধরেই সত্যচরণ জঙ্গলের ম্যানেজারের দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি অবলোকন করেন এক অন্যরকম পরিবেশকে, সমাজকে, জীবনদর্শনকে। সর্বোপরি দৈন্য দুঃখে এবং জঙ্গলের সাপখোপ, বুনো হাতি, বাঘ, হায়েনা; প্রাকৃতিক বিপর্যয়, ঝড়-ঝঞ্ঝা, খরা, অতিবৃষ্টিসহ নানাবিধ বিষয়াবলীকে।

গল্প কথক বারবার অনুধাবন করেন যে, এই অরণ্যের জীবন আর কলকাতার সভ্য সমাজের মধ্যে পুরো শতাব্দীর দূরত্ব। তিনি দেখেন সেখানকার বাসিন্দারা কদাচিৎ ভাত খেতে পায়। কেননা তাদের প্রধান খাদ্য কলাইয়ের ছাতু, বাথুয়া শাক, মকাইয়ের ছাতু প্রভৃতি। এতেই তারা তুষ্ট। কারণ ভদ্রসমাজে সভ্যতার উৎকর্ষ সাধন হলেও এ-সব আরণ্য ভূখণ্ডে কথিত সভ্যতার ছিটেফোঁটাও পৌঁছায় নি।

সত্যচরণ তার ঘোড়া ছুটিয়ে ফুলকিয়া বইহার, নাড়া বইহার কিংবা মহালিখারূপের জংলা দিয়ে যাওয়া আসার সুবাদে দেখেন সৃষ্টিজগতের এক অপূর্ব সৌন্দর্যরূপ। কখনো তিনি ফুটফুটে জোছনায় নেশাতুর, কখনো জানা অজানা লতাপাতার অবর্ণনীয় রূপসুধায় বিমোহিত। এমনও হয়েছে, বুনো জানেয়ারকে হাতের নাগালে পেয়েও বন্দুক দিয়ে শিকার করতে পিছপা হয়েছেন তিনি। কখনো করেছেন জঙ্গলের কিনারায় কাশের খুপরিতে যাযাবর জীবনযাপন।

তিনি প্রজাদের সাথে বন্ধুবাৎসল। শিক্ষা দীক্ষাহীন জনমানবের অকৃত্রিম ভালবাসা ও শ্রদ্ধায় তার বোধ হয় এমন যে, “এইসব ব্যবহার মানুষের সাথে মানুষের মত ব্যবহারের মতই স্বাভাবিক।”

এছাড়া উল্লিখিত সবকয়টি চরিত্রের জীবনবোধ, জীবিকা সম্পর্কে সবিস্তারে এই স্বল্প বর্ণনায় বলা সম্ভবপর নয়। এক্ষেত্রে আগ্রহী শ্রোতা ও জাত পাঠকদের পুরো উপন্যাসটি পড়ে ফেলবার অপেক্ষা রাখে না।

যাহোক, জীবিকার অন্বেষনে যে সত্যচরণ একসময় কলকাতার সভ্য জগতের নাগপাশ ছাড়িয়ে অচেনালোকে, বন্য জীবনযাত্রার সাথে অভ্যস্ত হতে হয়েছিল সে ম্যানেজারবাবু একসময় প্রকৃতির অমোঘ বিধানে চাকরি চুকিয়ে ফিরে আসতে হয় কলকাতায়, তথাকথিত সভ্য সমাজে। কিন্তু তা স্বত্তেও যে জঙ্গল তাকে একবার আপন করে নিয়েছিল, তার উদরে ঠাঁই দিয়েছিল এবং জঙ্গলাকীর্ণ স্থানের জনমানব যাদের সাথে তার এক অকৃত্রিম হৃদ্যতা তৈরি হয়েছিল তা তার অবচেতন মনে বহুকাল স্থায়ী হয়।

তার ফিরে আসার কিছুদিন পূর্বেই প্রজা বিলি করতে করতে আরণ্য বিধৃত লবটুলিয়া আর ফুলকিয়া বইহার হারায় তাদের আপন সত্তা। সেখানে আর জংলার সেই শ্রী নেই, হয়ে উঠে একঝাঁক উটকো, অশিক্ষায় ভরা কিছু অসচেতন লোকের অভয়ারণ্য। তবুও এই স্বস্তি যে, মহালিখারূপ ও ভানুমতিদের বনঝরি পাহাড় অক্ষত রইল।

জঙ্গল কারো মুখাপেক্ষী না হলেও মানুষের বেঁচে থাকার প্রয়োজনে আর জমিদারদের খাজনার লোভে বন্য প্রকৃতি ধ্বংসের এই হোলিখেলায় সত্যচরণ কিংবা যুগলপ্রসাদদের সায় থাকে না। কিন্তু তারা যে অপারগ!

তাইতো কথক সত্যচরণের আক্ষেপ যেন প্রকৃত মানুষেরই বিশুদ্ধ প্রকৃতি প্রেমের অমোঘ প্রকাশ।