রোজা শুরু হতে বাকি মাত্র সাড়ে তিন মাস। আগামী মার্চে শবে বরাত, এর ১৫দিন পর শুরু হবে রমজান মাস। এ হিসাবে রোজা-নির্ভর পণ্যের আমদানি বাড়ানোর উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।
ডলার সংকটে যাতে আমদানি ব্যাহত না হয় সে ব্যাপারে ইতোমধ্যে ব্যাংকগুলোকে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।
রেমিট্যান্স ও রপ্তানির খাতের যে ডলার ব্যাংকের হাতে থাকবে তা দিয়ে এসব পণ্যের আমদানির এলসি খুলতে হবে। একই সঙ্গে এ খাতে আরও ডলারের প্রয়োজন হলে কেন্দ্রীয় ব্যাংক রিজার্ভ থেকে জোগান দেবে।
রোজা-নির্ভর পণ্যের মধ্যে ডাল, ছোলা, পেঁয়াজ, ফল, চিনি, দুধ, ভোজ্যতেল বেশি আমদানি করতে হয়। অন্য সময়ের তুলনায় রোজা উপলক্ষ্যে এসব পণ্যের চাহিদা বেড়ে যায়। যে কারণে সরবরাহও বাড়াতে হয়।
এ লক্ষ্যে রমজান মাস শুরুর কমপক্ষে ৪ মাস আগে থেকেই এ ধরনের পণ্য আমদানির এলসি খুলতে হয়। সেগুলো আমদানি হয়ে পরিশোধনের মাধ্যমে বাজারে যেতে কমপক্ষে ৩ থেকে চার মাস সময় লাগে।
রোজা শুরুর আগেই বিশেষ করে শবে বরাতের সময় থেকে এসব পণ্যের চাহিদা বেড়ে যায়। এ হিসাবে হাতে সময় তিন মাস।
ইতোমধ্যে দুগ্ধ জাতীয় পণ্য ও ভোজ্যতেলের এলসি এবং আমদানি দুটোই বেড়েছে। ডালের এলসি বেড়েছে, আমদানি কমেছে। চিনির এলসি কমেছে, আমদানি বেড়েছে। ফল ও পেয়াজের এলসি ও আমদানি দুটোই কমেছে।
বৈশ্বিক মন্দার মধ্যেই এবার রমজান আসছে। ডলারের সংকটের কারণে একদিকে কেন্দ্রীয় ব্যাংক আমদানি নিয়ন্ত্রণ করছে, অন্যদিকে রোজা-নির্ভর পণ্যের আমদানি বাড়াতে হচ্ছে। ফলে এ খাতে এবার বিশেষ নজর দিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
ইতোমধ্যে প্রধানমন্ত্রীও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নরকে নির্দেশ দিয়েছেন, খাদ্যপণ্যের এলসি খোলা যাতে বাধাগ্রস্ত না হয় সেদিকে নজর দিতে।
এসব পণ্যের এলসি খুলতে ডলারের জোগান বাড়ানোরও নির্দেশ দেন তিনি। তার ওই নির্দেশ পেয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংক বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোকে এ বিষয়ে সতর্ক করেছে।
চলতি অর্থবছরের জুলাই থেকে গত বৃহস্পতিবার পর্যন্ত ৬০০ কোটি ডলারের বেশি কেন্দ্রীয় ব্যাংক রিজার্ভ থেকে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোকে জোগান দিয়েছে। এতে রিজার্ভ কমে ৩৩ বিলিয়ন ডলারের ঘরে নেমে গেছে।
কনজ্যুমার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সভাপতি গোলাম রহমান বলেন, প্রতি বছর রোজা ঘিরে অসাধুদের কারসাজির কারণেই মূলত পণ্যের দাম বাড়ে। বিভিন্ন সময় পণ্য নিয়ে কারসাজির দায়ে একাধিক দফায় সিন্ডিকেট চক্রটি চিহ্নিত হলেও কঠোর শাস্তির আওতায় আনা হয়নি।
ফলে তারা নানা ইস্যুতে সুযোগ পেলেই নিত্যপণ্যের বাজার অস্থিতিশীল করে তুলছে। এবারও আগের ধারাবাহিকতায় নতুনভাবে রোজাকে টার্গেট করে বাজার বেসামালের পায়তারা করেছে।
সঙ্গে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ ও আন্তর্জাতিক বাজারে পণ্যের দাম বাড়ার অজুহাত, ডলার সংকটকে কাজে লাগাচ্ছে। তাই এসব নির্মূলে ভোক্তার অধিকার সংরক্ষণে আইনের যথাযথ প্রয়োগ করতে হবে।
সূত্র জানায়, চলতি অর্থবছরের জুলাই-সেপ্টেম্বর এই তিন মাসে পরিশোধিত ভোজ্যতেলের এলসি ১৭০ শতাংশ ও আমদানি ২১৩ শতাংশ বেড়েছে। এগুলো আমদানির পর সরাসরি বাজারে দেওয়া যাবে। অপরিশোধিত ভোজ্যতেলের এলসি ১৮৯ শতাংশ ও আমদানি ৩১০ শতাংশ বেড়েছে। এগুলো পরিশোধন করে বাজারজাত করা হবে। আন্তর্জাতিক বাজারে এসব পণ্যের দাম বাড়ার কারণে এলসিও বেড়েছে। একই সঙ্গে পরিমাণেও এলসি ও আমদানিও বাড়ানো হয়েছে। এছাড়া গত অর্থবছরেও শুধু ফল ছাড়া রোজা নির্ভর অন্য সব পণ্যের আমদানি বেড়েছে। ওইসব পণ্য এখনো বাজারে সরবরাহ ও মজুতের প্রক্রিয়ায় রয়েছে। গত অর্থবছরে ভোজ্যতেলের আমদানি বেড়েছিল ৪৩৩ শতাংশ।
বছরে ভোজ্যতেলের চাহিদা প্রায় ২০-২২ লাখ টন। শুধু রোজার মাসে চাহিদা আড়াই থেকে ৩ লাখ টন। স্থানীয়ভাবে দুই লাখ ৩ হাজার টন উৎপাদিত হয়। বাকি ১৮ লাখ টন আমদানি করতে হয়।
চলতি অর্থবছরের আলোচ্য সময়ে চিনির এলসি কমেছে ৫২ শতাংশ। তবে আমদানি বেড়েছে ২৫ শতাংশ। গত অর্থবছরেও চিনি আমদানি বেড়েছিল ২৫ শতাংশ।
এ প্রসঙ্গে গত ২৬ নভেম্বর শিল্পমন্ত্রী নুরুল মজিদ মাহমুদ হুমায়ূন বলেছেন, দেশে পর্যাপ্ত চিনি মজুত রয়েছে। চিনির কোনো ঘাটতি নেই। তারপরও রোজা উপলক্ষ্যে আরও এক লাখ টন চিনি আমদানির উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।
বাজার তদারকি সংস্থা জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের পরিচালক মনজুর মোহাম্মদ শাহরিয়ার বলেন, রোজা উপলক্ষ্যে তিন স্তরে অভিযান পরিচালনার রোডম্যাপ তৈরি হচ্ছে। অধিদপ্তরের তদারকি টিমের সঙ্গে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়সহ অন্যান্য মন্ত্রণালয় ও অধিদপ্তর এবং আইনশৃঙ্খলা বাহিনী অভিযান পরিচালনা করবে। রোজা শুরুর আগেই এই টিম মাঠে নামবে। এবার রোজা উপলক্ষ্যে কোনো অসাধু ব্যবসায়ীকে পণ্যের দাম বাড়াতে দেওয়া হবে না। যদি কেউ কারসাজি করে, কঠোর শাস্তির আওতায় আনা হবে।
জানা গেছে, রোজায় ফলের চাহিদা বাড়ে। কিন্তু ডলার সংকটের কারণে ফলের আমদানি কমেছে। চলতি অর্থবছরের জুলাই-সেপ্টেম্বরে ফলের এলসি ৪৩ শতাংশ ও আমদানি ২৫ শতাংশ কমেছে। গত অর্থবছরেও আমদানি কমেছিল ২৫ শতাংশ। তবে এখন ফলের মধ্যে খেজুরের এলসি খোলা বাড়ছে। সেগুলো রোজার আগেই বাজারে চলে আসবে।
চলতি অর্থবছরের জুলাই সেপ্টেম্বরে ডালের এলসি বেড়েছে ৪০ শতাংশ, আমদানি কমেছে ২ শতাংশ। গত অর্থবছরেও এর আমদানি ২ শতাংশের বেশি কমেছিল। তবে রোজার সময়ে দেশি ডাল বাজারে পাওয়া যাবে।
এবার রোজা শুরু সময়ে দেশি পেঁয়াজের সরবরাহ থাকবে বেশ। মৌসুম শেষ হওয়ার পরই শুরু হবে রোজা। এ কারণে রোজায় পেঁয়াজ নিয়ে এবার কোনো সংকট হবে না বলে ব্যবসায়ীরা মনে করছেন।
এদিকে রাজধানীর খুচরা বাজার ঘুরে ও বিক্রেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, শুক্রবার প্রতি কেজি চিনি বিক্রি হয়েছে ১১৫-১২০ টাকায়। মসুর ডাল বিক্রি হয়েছে ১৪০ টাকা কেজি। ছোলা ৮৫ টাকা কেজি। প্রতি লিটার বোতলজাত সয়াবিন তেল বিক্রি হয়েছে ১৯০ টাকায়। পেঁয়াজের কেজি ৫০-৫৫ টাকা। প্রতি কেজি মাঝারি মানের খেজুর বিক্রি হয়েছে ৪৫০-৫০০ টাকায়।
সূত্র : যুগান্তর