আধুনিক গণপরিবহনের যুগে প্রবেশ করতে যাচ্ছে বাংলাদেশ। রাজধানী ঢাকার সবচেয়ে বড় সমস্যা যানজট নিরসনে আসছে বহুল প্রতীক্ষার মেট্রোরেল। গাড়ির মতো সিগন্যালে না আটকে, সাধারণ ট্রেনের মতো ক্রসিংয়ে না পড়ে ঘড়ির কাঁটায় সময় মেনে যাত্রীরা পৌঁছে যাবেন গন্তব্যে।
বুধবার (২৮ ডিসেম্বর) প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা উদ্বোধন করবেন মেট্রোরেলের এমআরটি-৬ লাইনের দিয়াবাড়ী থেকে আগারগাঁও অংশ। উদ্বোধনের পরদিন অর্থাৎ বৃহস্পতিবার (২৯ ডিসেম্বর) থেকে ১১ দশমিক ৭৩ কিলোমিটার দীর্ঘ এ পথে যাত্রী নিয়ে চলবে শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত আধুনিক ট্রেন।
মঙ্গলবার (২৭ ডিসেম্বর) আগারগাঁও স্টেশনে সংবাদ সম্মেলন করে সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের উদ্বোধন অনুষ্ঠানের বিস্তারিত ও মেট্রোরেলের সময়সূচি জানাবেন। তবে মেট্রোরেলের নির্মাণকারী ও রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্বে থাকা সরকারি কোম্পানি ডিএমটিসিএল সূত্রে জানা গেছে, আপাতত অনেকটা পরীক্ষামূলকভাবে যাত্রী নিয়ে চলবে মেট্রোরেলের ট্রেন।
এ নিয়ে কোনো কর্মকর্তা নাম প্রকাশ করে বক্তব্য দিতে চাননি। তবে সূত্র জানিয়েছে, প্রথম দিকে সকাল ৮টা থেকে চার ঘণ্টা চলবে ট্রেন। আগে সিদ্ধান্ত ছিল, দিয়াবাড়ী-আগারগাঁও অংশে সাতটি স্টেশনের শুধু পল্লবীতে যাত্রী ওঠানামা করবে। তবে এ সিদ্ধান্তও বদল হয়েছে। দিয়াবাড়ী স্টেশন থেকে যাত্রী নিয়ে যাত্রা শুরু করে সরাসরি আগারগাঁও স্টেশনে যাবে ট্রেন। আগারগাঁও থেকে একইভাবে দিয়াবাড়ীতে যাবে। এ পথের স্টেশনগুলো ধাপে ধাপে চালু হবে।
এমআরটি-৬ লাইনের জন্য ২৪ সেট ট্রেন কেনা হচ্ছে জাপান থেকে। এরই মধ্যে ১৯টি ট্রেন এসেছে। ১৯ ধরনের পরীক্ষা চলছে সেগুলোর। পারফরম্যান্স টেস্ট, ট্রায়াল রান ও ইন্টিগ্রেটেড টেস্ট শেষ হওয়া ১০টি ট্রেন চলবে দিয়াবাড়ী-আগারগাঁও অংশে। আর দুটি রিজার্ভ রাখার পরিকল্পনা রয়েছে। তবে শুরুতে পাঁচটি ট্রেন চলবে।
পরিকল্পনা অনুযায়ী, সাড়ে তিন মিনিট অন্তর ট্রেন চলবে। তবে শুরুর দিকে ১০ মিনিট অন্তর চলবে। দিয়াবাড়ী এবং আগারগাঁও স্টেশনের প্ল্যাটফর্মে ১০ মিনিট করে অপেক্ষা করবে যাত্রী ওঠানামার সুবিধার্থে। পরবর্তী সময়ে যেসব স্টেশন চালু হবে, সেখানেও ১০ মিনিট করে যাত্রাবিরতি করবে। তবে আগামী মার্চ বা এপ্রিলে মেট্রোরেল পুরোপুরি বাণিজ্যিক কার্যক্রমে যাওয়ার পর স্টেশনে মাত্র ৩০ সেকেন্ড যাত্রাবিরতি করবে। ডিএমটিসিএলের ভাষ্য, যাত্রীদের অভ্যস্ত হতে শুরুর দিকে বাড়তি সময় দেওয়া হবে। দিয়াবাড়ী থেকে আগারগাঁওয়ের ভাড়া ৬০ টাকা।
উদ্বোধন অনুষ্ঠানের সময়সূচি অনুযায়ী, বুধবার সড়কপথে গণভবন থেকে দিয়াবাড়ী যাবেন প্রধানমন্ত্রী। স্টেশনের পাশে খেলার মাঠে হবে সুধী সমাবেশ। সকাল ১১টার দিকে শেখ হাসিনা মেট্রোরেলের উদ্বোধন ফলক উন্মোচন করবেন। হবে আতশবাজি।
সড়ক পরিবহন বিভাগ সূত্র জানিয়েছে, আর্থিক কৃচ্ছ্র সাধনে মেট্রোরেলের উদ্বোধন অনুষ্ঠান হবে সাদামাটা। পদ্মা সেতু উদ্বোধনের মতো জাঁকজমক থাকবে না। সুধী সমাবেশের বক্তৃতার পর প্রধানমন্ত্রী স্মারক ডাকটিকিট এবং মেট্রোরেলের প্রথম দিনের কাভার উন্মোচন করবেন। এরপর স্মারক নোট উন্মোচন করবেন। ওবায়দুল কাদেরের সভাপতিত্বে সুধী সমাবেশে মেট্রোরেল প্রকল্পে ঋণদাতা জাপানের আন্তর্জাতিক সহযোগিতা সংস্থার (জাইকা) প্রতিনিধি এবং ঢাকায় নিযুক্ত জাপানের রাষ্ট্রদূতসহ মেট্রোরেলের সঙ্গে সম্পৃক্ত জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তারা বক্তব্য রাখবেন।
সুধী সমাবেশের পর দিয়াবাড়ী স্টেশনে যাবেন প্রধানমন্ত্রী। তিনি স্টেশনের প্রধান ফটকে তেঁতুলগাছের চারা রোপণ করবেন। এর পর এস্কেলেটর ব্যবহার করে স্টেশনের দ্বিতীয় তলা তথা কনকর্স লেভেলে যাবেন। এর পর যাবেন তৃতীয় তলা অর্থাৎ প্ল্যাটফর্মে। সেখানে সরকারপ্রধান সবুজ পতাকা উড়িয়ে ট্রেন চলাচলের উদ্বোধন করবেন। যাত্রাপথে সহযাত্রীদের সঙ্গে কুশল বিনিময় করে ট্রেনে যাবেন আগারগাঁও। সেখান থেকে গণভবনে ফিরে যাবেন। সরকারি সূচিতে জনসভার উল্লেখ না থাকলেও আওয়ামী লীগ দিয়াবাড়ীতে উদ্বোধন অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে ব্যাপক জনসমাগমের প্রস্তুতি নিয়েছে।
সর্বোচ্চ ধারণ ক্ষমতা ২ হাজার ৩০৮ জন হলেও শুরুর দিকে প্রতিটি ট্রেন ১০০ থেকে ৩৫০ যাত্রী নিয়ে চলবে। মেট্রোরেলের ছয় বগির ট্রেনের দুই দিকেই থাকবে ট্রেইলার কোচ। যেখান থেকে চালকরা ট্রেন পরিচালনা করবেন। প্রতিটি ট্রেইলার কোচের যাত্রী ধারণ ক্ষমতা ৩৭৪ জন। মাঝখানের চারটি বগির প্রতিটির যাত্রী ধারণ ক্ষমতা ৩৯০ জন করে।
কম যাত্রী পরিবহন ও মাঝপথের সাতটি স্টেশন চালু না হওয়ার বিষয়ে এমআরটি-৬-এর অতিরিক্ত প্রকল্প পরিচালক (পূর্ত) আবদুল বাকি মিয়া বলেন, কাজ সম্পন্ন হয়ে গেছে। ধীরে ধীরে খুলবে সব স্টেশন।
উদ্বোধনের পরের দিন থেকে যাত্রী পরিবহনে দিয়াবাড়ী ও আগারগাঁও স্টেশন প্রস্তুত করা হয়েছে। স্টেশনে মিলবে মেট্রো পাস। এই পাস দিয়ে কিংবা স্টেশন থেকে টিকিট কেটেও ভ্রমণ করা যাবে মেট্রোরেলে। পাস পেতে করতে হবে নিবন্ধন।
ঢাকা যানবাহন সমন্বয় কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, র্যাপিড পাসেও চড়া যাবে মেট্রোরেলে। বিনামূল্যে দেওয়া হবে পাস। তবে জামানত বাবদ দিতে হবে ২০০ টাকা। পাস ফেরত দিয়ে জামানতের টাকা ফেরত পাওয়া যাবে। স্টেশনের নির্দিষ্ট স্থান থেকে পাস ইস্যুর সময় ২০০ টাকা রিচার্জ করতে হবে। পাস বা টিকিট পাঞ্চ করলে স্টেশনের তৃতীয় তলার দরজা স্বয়ংক্রিয়ভাবে খুলবে।
মেট্রোরেলে প্রতিটি ট্রেনে একটি করে বগি নারী যাত্রীদের জন্য সংরক্ষিত থাকবে। তবে নারী যাত্রীরা সাধারণ বগিতেও ভ্রমণ করতে পারবেন। বগিগুলো ৩৯০ জন যাত্রী ধারণক্ষম হলেও আসন মাত্র ৫৪টি করে। বাকি যাত্রীরা দাঁড়িয়ে ভ্রমণ করবেন। ঘণ্টায় ১০০ কিলোমিটার গতিতে চলাচল করা মেট্রোরেলের এক স্টেশন থেকে অন্য স্টেশনে যেতে এক থেকে দুই মিনিট সময় লাগবে। তাই উন্নত দেশেও বগিতে বসার ব্যবস্থা সীমিত।
মেট্রোরেল চলবে বিদ্যুতে। জাতীয় গ্রিড থেকে সরাসরি বিদ্যুৎ সংযোগ থাকবে মেট্রোরেলের দিয়াবাড়ী ও মতিঝিল সাব-স্টেশনে। থাকবে বিকল্প সংযোগও। বিদ্যুৎ বিভ্রাট হলে চলবে জেনারেটর। ট্রেনের প্রথম ও শেষের বগিতে থাকবে ট্রেন পরিচালনার মডিউল। ফলে ট্রেন না ঘুরিয়েই চালানো হবে। ট্রেন নিয়ন্ত্রণে চালকদের কাজ সামান্যই। ট্রেন চলবে সফটওয়্যারে।
ভবিষ্যতে মেট্রোরেলের ট্রেনগুলোতে আরও দুটি করে বগি যোগ হবে। তখন ট্রেনগুলোর সর্বোচ্চ যাত্রী ধারণ ক্ষমতা হবে ৩ হাজার ৮৮ জন, যা ৭৭টি বাসের যাত্রীর সমান। যানজটে না পড়ে একসঙ্গে কম সময়ে বেশি যাত্রী পরিবহন করতে পারায় মেট্রোরেলে কমবে যানজট।
বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) তথ্যমতে, বছরে দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) ২.৫ শতাংশ ক্ষতি করছে যানজট। টাকার অঙ্কে ৮৭ হাজার কোটি টাকা। দিয়াবাড়ী থেকে কমলাপুর পর্যন্ত নির্মাণাধীন এমআরটি-৬ লাইন যানজটের ক্ষতি কমাবে ৯ শতাংশ।
দিয়াবাড়ী থেকে কমলাপুর পর্যন্ত করিডোরে ব্যক্তিগত গাড়ি ও বাসের চলাচলও কমবে। ডিএমটিসিএলের তথ্য অনুযায়ী, দিয়াবাড়ী থেকে কমলাপুর পর্যন্ত ২১ দশমিক ২৬ কিলোমিটার পথ মেট্রোরেল পাড়ি দেবে ৪০ মিনিটে। বিশ্বব্যাংকের হিসাবে ঢাকায় গাড়ির গতি এখন ঘণ্টায় পাঁচ কিলোমিটার। অর্থাৎ দিয়াবাড়ী থেকে কমলাপুর থেকে সময় লাগে চার ঘণ্টার বেশি। মেট্রোরেলে সময় সাশ্রয় হবে ৮০ শতাংশ। ঢাকায় এসি বাসে উত্তরা থেকে মতিঝিলের ভাড়া ১০০ টাকা। মেট্রোরেলেও একই পরিমাণ ভাড়া দিতে হবে। তবে সময় লাগবে মাত্র ২০ ভাগ।
২০০৪ সালে প্রণীত কৌশলগত পরিবহন পরিকল্পনায় (এসটিপি) যানজট নিরসনে রাজধানীতে তিনটি মেট্রোরেল এবং তিনটি বাস র্যাপিড ট্রানজিট (বিআরটি) নির্মাণের সুপারিশ করা হয়। এসটিপিতে না থাকলেও ফ্লাইওভার নির্মাণ করা হয়। এতে যানজট আরও বাড়ে। ২০১৫ সালে সংশোধিত এসটিপিতে পাঁচটি মেট্রোরেল এবং দুটি বিআরটি নির্মাণের সুপারিশ করা হয়। এমআরটি-৬ প্রকল্প সরকারের অনুমোদন পায় ২০১২ সালে। ২১ হাজার ৯৮৫ কোটি টাকা ব্যয় ধরে মেট্রোরেলের নির্মাণকাজ শুরু হয়েছিল। বেড়ে হয়েছে ৩৩ হাজার ৪৭২ কোটি টাকা। জাইকা ঋণ দিচ্ছে ১৯ হাজার ৭১৮ কোটি টাকা। প্রকল্প মেয়াদ ২০২৫ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত বেড়েছে।
আগারগাঁও থেকে মতিঝিল পর্যন্ত যাত্রীদের পৌঁছে দিতে থাকছে বিআরটিসির ৫০টি দ্বিতল নন-এসি বাস। দিয়াবাড়ী থেকে উত্তরা পর্যন্ত ১০টি এবং আগারগাঁও থেকে মতিঝিল পর্যন্ত ৪০টি বাস চলবে শাটল হিসেবে।