আদালত প্রাঙ্গণে সৃষ্টি হয় জঙ্গি সংগঠন ‘জামাতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্বিয়া’

ঢাকার বিচারিক আদালত প্রাঙ্গণেই কারাগারে ও এর বাইরে থাকা জঙ্গিদের এক সংক্ষিপ্ত আলোচনায় সৃষ্টি হয় নতুন জঙ্গি সংগঠন ‘জামাতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্কিয়া’ বা ‘পূর্বাঞ্চলীয় হিন্দের জামাতুল আনসার’। আর এই সংগঠনের অধীনে সংঘবদ্ধ হয়ে নতুন সদস্য ও অর্থ সংগ্রহের কাজ শুরু করেছিল জঙ্গিরা। কারাগারে থাকা কয়েকজনকে নেতৃত্বে রেখে বাইরের কয়েকজনকে দায়িত্ব দেওয়া হয়। সম্প্রতি এই দলের মধ্যম সারির দুই নেতা গ্রেফতার হলেও একজন এখনও পলাতক। পলাতক ওই ব্যক্তি রেডিক্যালাইজড তরুণদের ঘর ছাড়ার ছাড়পত্র দিতো।

জঙ্গি দমন ও জঙ্গিদের পুনর্বাসন নিয়ে কাজ করে এমন একাধিক সংস্থার সঙ্গে কথা বলে এমন তথ্য জানা গেছে। কর্মকর্তারা জানান, হুজি, জেএমবি ও আনসার আল ইসলামের কারাগারে থাকা নেতা ও বাইরে থাকা কর্মীরা দীর্ঘদিন ধরে একটি প্ল্যাটফর্মে আসার চেষ্টা করছে। এই সংগঠনগুলো নিষিদ্ধ হওয়ায় এর কর্মীরা সরাসরি প্রচারণা ও সাংগঠনিক কার্যক্রম পরিচালনা করতে পারছিল না। এছাড়া তারা অতীতের অনেক কর্মকাণ্ডকে ভুল বলে মনে করছে। তাই নতুন করে একটি সংগঠন করে সমমনাদের নিয়ে নতুন করে শুরু করার পরিকল্পনায় ছিল তারা।

আদালত প্রাঙ্গণে জন্ম নতুন জঙ্গি সংগঠনের

কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, ২০১৭ সাল থেকে হুজি, জেএমবি ও আনসার আল ইসলামের সদস্যরা নতুন সংগঠন করার জন্য চেষ্টা করে আসছে। এই তিন জঙ্গি সংগঠনের কারাগারে থাকা নেতারা এবং বাইরে থাকা কর্মীরা নিজেদের মধ্যে যোগাযোগ শুরু করে। এসব সংগঠনের নেতারা যখন কারাগার থেকে আদালতে হাজিরা দিতে আসতো, তখন তাদের অনুসারীরাও সেখানে আসে। এদের কেউ কেউ সাদা পোশাক পরে আইনজীবীদের জুনিয়ার সেজে আসতো।

২০১৯ সালের শুরুর দিকে আদালত প্রাঙ্গণে বসেই সংগঠনটির নাম রাখা হয় ‘জামাতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্কিয়া’। নতুন এই সংগঠনে জঙ্গি নেতা মুহাম্মদ জসিমউদ্দিন রাহমানির অনুসারীদের আধিপত্য রয়েছে। জসিমউদ্দিন বর্তমানে কারাগারে রয়েছে। অনুসারীরা তাকে ‘বাংলার সিংহ পুরুষ’ উপাধি দিয়েছে।

গোয়েন্দা কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, আদালতের আলোচনায় যারা ছিল, তারা জঙ্গি সংগঠনের অপারেশনাল ইউনিটে কাজ করে না। তারা কেবল আদালতে ও কারাগার থাকা জঙ্গিদের সঙ্গে বাইরে থাকা জঙ্গিদের যোগাযোগ মাধ্যম হিসেবে কাজ করে। বার্তা পৌঁছে দেয়।

তবে আদালত চত্বর এলাকায় ‘এমন সাংগঠনিক আলোচনার সুযোগ নেই’ বলে জানিয়েছেন ঢাকা সন্ত্রাস দমন ট্রাইব্যুনালের এপিপি গোলাম সারোয়ার খান জাকির। জঙ্গি মামলাগুলোতে রাষ্ট্রপক্ষের হয়ে অংশ নেন এই আইনজীবী। তিনি বলেন, ‘শীর্ষ জঙ্গিরা কারাগার থেকে আসার পর তাদের কড়া পাহারায় হাজতখানায় নেওয়া হয়। সেখান থেকে আবার পুলিশ পাহারায় নির্ধারিত কোর্টের কাঠগড়ায় তোলা হয়। এসময় তাদের নিযুক্ত আইনজীবীরা আইনি সেবা দিতে যেসব কথা বলা দরকার, তা বলেন। আর কোর্ট প্রাঙ্গণে আসামি আনা হলে তার স্বজনরাও আসেন। তবে তারা বারান্দায় থাকেন। ভেতরে আসার সুযোগ নেই। কোর্ট থেকে নেওয়ার সময় স্বজনরা বারান্দায় বসে কথা বলার চেষ্টা করেন, তবে জঙ্গি কোনও কার্যক্রমের আলোচনা করার সুযোগ নেই।’

গোয়েন্দা সংস্থার কর্মকর্তারা জানান, কারাগারে থাকা জ্যেষ্ঠ জঙ্গি নেতাদের নতুন এই সংগঠনের শীর্ষ পদে রাখা হয়েছে। আর মধ্যম সারির নেতারা বর্তমানে বাইরে আছে। তারা সাংগঠনিক কার্যক্রম পরিচালনা করছে। নতুন সদস্য সংগ্রহ, ইউটিউব চ্যানেল পরিচালনা, ফেসবুক পেজে প্রচারণা, অর্থ সংগ্রহ, দাওয়াতি কার্যক্রম পরিচালনা, প্রশিক্ষণ, বায়াত দেওয়া ও প্রকাশনা তৈরি করে তা প্রচার করে যাচ্ছে।

আইনশৃঙ্খলা বাহিনীগুলোর দাবি, নতুন এই জঙ্গি সংগঠনের কার্যক্রমেই সারাদেশে অন্তত অর্ধশত তরুণ ঘর ছেড়েছে। এই সংখ্যা আরও বেশিও হতে পারে বলে র‌্যাব ও পুলিশের ধারণা। ‘জামাতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্কিয়া’ জঙ্গি সংগঠনের একটি ইউনিটের সাত জনকে গত ৬ অক্টোবর গ্রেফতার করেছে র‌্যাব। যাদের মধ্যে সম্প্রতি কুমিল্লা থেকে নিখোঁজ চার তরুণও ছিল।
কুমিল্লায় বাড়ি থেকে নিখোঁজ চার তরুণসহ সাত জনকে জঙ্গি সম্পৃক্ততার অভিযোগে গ্রেফতার করা হয়কুমিল্লায় বাড়ি থেকে নিখোঁজ চার তরুণসহ সাত জনকে জঙ্গি সম্পৃক্ততার অভিযোগে গ্রেফতার করা হয়

নতুন এই জঙ্গি সংগঠনের মধ্যম সারির নেতা হলো কুমিল্লার মসজিদে কোবার ইমাম শাহ মোহাম্মদ হাবিবুল্লাহ, বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের (বারি) এর বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা নেছার উদ্দিন উমায়ের ও পটুয়াখালীর একটি মাদ্রাসার শিক্ষক হোসাইন আহম্মদ। তিন জনের মধ্যে নেছার ও হোসাইন র‌্যাবের হাতে গ্রেফতার হলেও পলাতক রয়েছেন ইমাম হাবিবুল্লাহ।

ইমাম হাবিবুল্লাহ জঙ্গিদের বাড়ি ছাড়ার ছাড়পত্র দেয়

দীর্ঘ সময়ে তরুণদের কাউন্সিলিং করে জঙ্গিবাদে উদ্বুদ্ধ করার অভিযোগ উঠেছে কুমিল্লার মসজিদে কোবার ইমাম শাহ মোহাম্মত হাবিবুল্লাহ’র বিরুদ্ধে। তার বাড়ি কুমিল্লা নগরীর ২৫ নম্বর ওয়ার্ডের লইপুরা এলাকায়। কোবার মসজিদে তিনি বিভিন্ন ওয়াক্তের নামাজ পড়াতেন। ইমামতি করার পাশাপাশি পদুয়ার বাজার মাদ্রাসায় শিক্ষকতা করতেন। কুমিল্লা থেকে নিখোঁজ তরুণরাও ওই মসজিদে নামাজ আদায় করতো। গত ১২ সেপ্টেম্বর থেকে হাবিবুল্লাহও নিখোঁজ।

তার নিখোঁজের ঘটনাতেও তার বড় ভাই ও কুমিল্লার চৌয়ারা ইসলামিয়া ফাজিল মাদ্রাসার প্রভাষক শাহ মো. অলিউল্লাহ ১৬ সেপ্টেম্বর কুমিল্লার সদর দক্ষিণ থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করেন।

র‌্যাব জানিয়েছে, ইমাম হাবিবুল্লাহর নির্দেশেই ওই তরুণরা বাড়ি ছাড়ে। এর আগে তাদের জঙ্গিবাদে উদ্বুদ্ধ করা হয়। তাদের ব্রেইন পুরোপুরি ওয়াশ হওয়ার পর তাদের জিহাদের জন্য হিজরতে পাঠানো হয়। তবে তারা প্রস্তুত কিনা পুরোপুরি জঙ্গিবাদে রূপান্তরিত হয়েছে কিনা, এর আগে কয়েক ধাপে তাদের পরীক্ষা করা হতো। কেবল পুরোপুরি প্রস্তুত করা তরুণদের বাড়ি ছাড়ার জন্য নির্দেশ দিতো।

র‌্যাবের আরও জানায়, মূলত হাবিবুল্লাহর নির্দেশেই কুমিল্লার সাত তরুণ বাড়ি ছাড়ে। এর মধ্যে চার জনকে গ্রেফতার করেছে র‌্যাব। গ্রেফতার চার জন হলো- ইমতিয়াজ আহমেদ রিফাত (১৯), মো. হাসিবুল ইসলাম (২০), রোমান শিকদার (২৪) ও মো. সাবিত (১৯)। তাদের কাছ থেকে নব্য জঙ্গি সংগঠনের কর্মপদ্ধতির উগ্রবাদী বই ও ভিডিও উদ্ধার করা হয়।

হাবিবুল্লাহর কথায় এক বছর আগেও কুমিল্লা থেকে দু্ই তরুণ ঘর ছেড়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে। তবে তার ভাই অলিউল্লাহ জানান, হাবিবুল্লাহ কোনও জঙ্গি সংগঠনের সঙ্গে সম্পৃক্ত আছে, তা বিশ্বাস হয় না।

নতুন জঙ্গি সংগঠনের প্রশিক্ষক ও হিজরতে যাওয়াদের আশ্রয়দাতা নেছার

নেছার উদ্দিন উমায়ের ভোলার কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা। ২০১৯ সালে নতুন এই জঙ্গি সংগঠনের সঙ্গে তিনি যুক্ত হন। জঙ্গি সংগঠনে তার দায়িত্ব হলো হিজরতকৃত সদস্যদের প্রশিক্ষক ও তাদের গোপনে আশ্রয় দেওয়া। এছাড়াও সদস্যদের বিভিন্ন তাত্ত্বিক জ্ঞান ও প্রশিক্ষণ প্রদানের মাধ্যমে সদস্যদের সশস্ত্র হামলার বিষয়ে প্রস্তুত করে তুলতেন। ৯-১০ জন সদস্যের তত্ত্বাবধান ও প্রশিক্ষণের সঙ্গে তিনি যুক্ত বলে অভিযোগ উঠেছে।

কর্মস্থল ভোলায় হওয়া তিনি ভোলাতেই থাকতেন। তবে প্রতি বৃহস্পতিবার বিকালে তিনি পটুয়াখালীতে তার বাড়িতে চলে যেতেন। সেখানে তার স্ত্রী ও সন্তান থাকে বলে প্রতি সপ্তাহের শুক্র ও শনিবার বাড়িতে কাটাতেন। নতুন জঙ্গি সংগঠনের তিনি আঞ্চলিক ও মধ্যম সারির নেতা বলে র‌্যাব দাবি করছে। তাকে গ্রেফতার করা হয়েছে।

দক্ষিণাঞ্চলের অন্যতম সদস্য হোসাইন আহম্মদ ও বণি আমিন

নতুন জঙ্গি সংগঠন ‘জামাতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্বিয়া’ দক্ষিণাঞ্চলের অন্যতম দায়িত্বপ্রাপ্ত সদস্য হোসাইন আহম্মদ। তিনি পটুয়াখালীর একটি মাদ্রাসায় শিক্ষকতা করেন। বাংলাদেশের নিষিদ্ধ সংগঠন, বিশেষত জেএমবি, আনসার আল ইসলাম এবং হুজি’র বিভিন্ন পর্যায়ের কতিপয় নেতা ও কর্মীরা একত্রিত হয়ে যে উগ্রবাদী জঙ্গি সংগঠনের কার্যক্রম শুরু করে, গ্রেফতার হোসাইন সেই সংগঠনের জন্য সদস্য সংগ্রহ ও তত্ত্বাবধানের দায়িত্বে ছিলেন। এছাড়াও তিনি সদস্যদের বিভিন্ন তাত্ত্বিক জ্ঞান ও প্রশিক্ষণ প্রদানের মাধ্যমে সদস্যদের সশস্ত্র হামলার বিষয়ে প্রস্তুত করে তুলতেন। তিনি ২০১৪-১৫ সালে চট্টগ্রামের হাটহাজারী মাদ্রাসায় লেখাপড়া করার সময় সিরাজ নামে এক ব্যক্তির মাধ্যমে উগ্রবাদে উৎসাহিত হন। এখন পর্যন্ত ১৫-২০ জন সদস্য সংগ্রহ ও প্রশিক্ষণ দিয়েছেন বলে জানান গোয়েন্দারা।

বণি আমিন উচ্চ মাধ্যমিক সম্পন্ন করে পটুয়াখালী এলাকায় কম্পিউটার সেলস অ্যান্ড সার্ভিসের ব্যবসা করেন। তিনি সদস্যদের আশ্রয় প্রদান ও তত্ত্বাবধানে নিয়োজিত ছিল। সে ২০২০ সালে হোসাইনের মাধ্যমে জঙ্গিবাদে জড়িয়ে পড়ে। এখন পর্যন্ত ২২-২৫ জন সদস্যকে আশ্রয় দেওয়া ও তত্ত্বাবধানের সঙ্গে তিনি জড়িত।

হিজরতে থাকা তরুণরা নির্মাণ শ্রমিক হিসেবেও কাজ করছিল

কুমিল্লা থেকে গত ২৩ আগস্ট যে সাত তরুণ হিজরত করেছিল, তাদের চার জনকে গ্রেফতার করেছে র‌্যাব। তাদের দুজন ঢাকায় এসে নির্মাণ শ্রমিক হিসেবে কাজও করেছে। এরা হলো রোমান ও সাবিত। তারা উত্তরা এলাকায় রাজমিস্ত্রির সহযোগী হিসেবে কাজ করেছে। ‘ঢাকা সিরাজ’ নামে এই জঙ্গি সংগঠনের অন্যতম এক সদস্য তাদের এই কাজে দিয়েছিল।

র‌্যাবের বক্তব্য

র‌্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক খন্দকার আল মঈন বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘আমরা হাবিবুল্লাহকে খুঁজছি। তাকে পেলেই অনেক রহস্য উদঘাটন হবে। কারণ তার কথায় কুমিল্লা থেকে তরুণরা নিখোঁজ হয়।’

সূত্র: বাংলা ট্রিবিউন