আত্মহত্যা মানেই নিজে শেষ নয়, স্বজনদের জন্যও গভীর ক্ষত

পৃথিবী সুন্দর। অসংখ্য ভাললাগার, ভালবাসার স্মৃতিতে ঘেরা এই পৃথিবীতে পুনরায় ফিরে আসার প্রত্যাশাই বার বার ফিরে এসেছে কবি সাহিত্যিকদের লেখায়, গল্পে এবং না ফিরতে পারার হাহাকারে। অথচ এতো সাধের জীবন আর পরিবার-পরিজন, সুখের পৃথিবী রেখে যারা আত্মহত্যার পথ বেছে নিচ্ছেন তারা কি স্বাভাবিক?

বর্তমান সমাজে আত্মহত্যা হলো এক গভীর সংকট। আত্মহত্যা মানে শুধুমাত্র নিজের জীবনাবসান নয়, অন্য পরিবার-পরিজনের জন্যেও এটি একটি গভীর ক্ষত। এতো বার বার করে কবি জীবনানন্দ আবার আসিব ফিরে বললেও কেন কিছু মানুষের ফিরে যাওয়ার এতো তাড়া তা নিয়ে বিজ্ঞান কাজ করছে দীর্ঘদিন ধরে।

ইন্টারন্যাশনাল অ্যাসোসিয়েশন অব সুইসাইড প্রিভেনশনের তথ্যমতে, বিশ্বজুড়ে বছরে সাত লাখের বেশি মানুষ আত্মহত্যা করেন। এই সংগঠনটি প্রথম আত্মহত্যা প্রতিরোধ দিবস শুরু করে। পরবর্তীতে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা তাদেরকে স্বীকৃতি দিয়ে এটি বিশ্বজুড়ে পালনের আহ্বান জানায়। গবেষণায় দেখা যায় প্রতি ১ হাজার মৃত্যুর মধ্যে ১৩ জনই আত্মহত্যার মধ্য দিয়ে পৃথিবী থেকে বিদায় নেয়। আবার প্রতি ১০০টি আত্মহত্যার মধ্যে ৫৮ জনের বয়সই ৫০ বছরের নিচে। যাঁদের বিষণ্ণতা রোগ রয়েছে, অন্যদের চেয়ে তাঁরা ২০ গুণ বেশি আত্মহত্যার ঝুঁকিতে রয়েছেন এমন তথ্যও উঠে এসেছে।

এবছর ১০ই সেপ্টেম্বর প্রতিবছরের মতো আত্মহত্যা প্রতিরোধ দিবস পালন করা হবে এবং এবারের প্রতিপাদ্য হচ্ছে ‘কাজের মাঝে জাগাই আশা’ (ক্রিয়েটিং হোপ থ্রু অ্যাকশন)। মানুষ আশায় বাঁচে। কাজেই আশা জাগানিয়া কর্মকাণ্ড ছাড়া ভালভাবে বেঁচে থাকার সুতীব্র বাসনা মানুষের মাঝে থাকে না।

আত্মহত্যা প্রতিরোধ আমাদের যে সকল করণীয় হতে পারে তার একটা সক্ষিপ্ত বিবরণী দেওয়া যেতে পারে নিম্নরূপভাবে-

১.আমাদের সবার আত্নীয় স্বজন আপনজন পরিবার পরিজনের প্রতি বিশেষভাবে খেয়াল রাখা প্রয়োজন তাদের মানসিক স্বাস্থ্যের ব্যাপারে।মানসিক স্বাস্থ্যের কোন অবনতি হলে সঠিক পরামর্শ নেওয়া প্রয়োজন।

২.তরুণ, তরুণী এবং যুবক-যুবতীদের মাঝে আত্মহত্যার প্রবণতা বেশি। আমাদের উচিত বিদ্যালয় মহাবিদ্যালয়গুলোতে মানসিক স্বাস্থ্যের ব্যাপারে সচেতনতা কার্যক্রম চালানো।

৩.বিশ্বায়নের এই যুগে মানুষ নানাভাবে সামাজিক মাধ্যম এবং মিডিয়া দ্বারা পরিচালিত, প্রভাবিত। আত্মহত্যার খবর প্রচারে তাই সাবধান হওয়া প্রয়োজন। প্রয়োজন বিশেষভাবে এ ব্যাপারে সতর্ক থাকা। আত্মহননের পথ বেছে নেওয়া কাউকে যেনো আমরা সহানুভূতির বশে কিংবা আবেগের বশে বীর হিসেবে প্রকাশ না করি। আত্মহত্যার পথ বেছে নেওয়া কারো ছবি, নিউজ কিংবা ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রকাশ না করাই একান্তভাবে কাম্য। এর মাধ্যমেও অনেকে নতুন করে প্রভাবিত হতে পারে।

৪.সাম্প্রতিক সময়ে কারো ঘুমের সমস্যা হওয়া, মেজাজ খিটমিটে হয়ে যাওয়া, অস্থির হয়ে যাওয়া, অতিরিক্ত রাগ করা কিংবা অন্যদের বা নিজেকে আঘাত করার প্রবণতাসহ নানান সমস্যা দেখা দিলে দ্রুত চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া।

৫.আত্মহত্যা যিনি করেন তিনি অধিকাংশ ক্ষেত্রেই আগে থেকেই এমন কিছু কাজ করেন যা দিয়ে তার ভবিষ্যতের এই আত্মহনন সম্পর্কে ধারণা করা যায়। যেমন বন্ধুদের কাউকে এ ব্যাপারে বলা, উইল করা, সবকিছু থেকে নিজেকে গুটিয়ে নেওয়া কিংবা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে আত্মহত্যার ঘোষণা দেওয়া। এসকল ক্ষেত্রে আরও বেশি সতর্ক হওয়া প্রয়োজন।

৬.শিশু-কিশোরদের সামাজিক মানসিক বিকাশে খেলাধুলা, সৃষ্টিশীল কাজকর্ম এবং অন্যান্য পারিবারিক আয়োজনে জড়িত রাখা প্রয়োজন।তরুণ বয়সে বর্তমানে আত্মহত্যার অন্যতম কারণ হলো মাদকাসক্তি। কাজেই সে দিকে বিশেষ নজর রাখতে হবে। ব্যক্তিগত নানান ঝুটঝামেলা কিংবা পাওয়া না পাওয়ার হতাশায় কাছের মানুষদের সাথে কথা বলতে হবে এবং সময় দিতে হবে।

৭.আত্মহত্যার জন্যে যে সকল জিনিসপত্র ব্যাবহার করা হয় তার সহজলভ্যতা কমাতে হবে। হট লাইন চালু করতে হবে। সেমিনার সিম্ফোজিয়াম এর ব্যাবস্থা করতে হবে। প্রয়োজনের মানসিক স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের মতামত নিয়ে এবং তাদের মাধ্যমেই জাতীয় প্রতিরোধ কাউন্সিল বানানো যেতে পারে।

৮.বিভিন্ন কঠিন, জটিল মানসিক রোগ যেমন তীব্র বিষন্নতা, সিজোফ্রেনিয়া কিংবা মুড ডিসওর্ডার দ্রুত সনাক্ত করতে হবে এবং দ্রুত চিকিৎসার ব্যবস্থা করতে হবে। আমরা অনেক আলাপ আলোচনা করলাম কিন্তু চিকিৎসা ব্যাবস্থায় আধুনিক চিকিৎসা বিজ্ঞানকে না মেনে মানসিক স্বাস্থ্য সেবা নিলাম না, তাহলে কিন্তু কোন লাভ হবে না।

বিশ্ব আত্মহত্যা প্রতিরোধ দিবসে আমরা আরও সচেতন হই মানসিক স্বাস্থ্যের ব্যাপারে। আরও সচেতন হই ঝরে যাওয়া কাছের মানুষের ব্যাপারে।

  • ডা. মোহাম্মদ হাসান। চিকিৎসক ও পেশাজীবী সংগঠক।