কুড়িগ্রামের চিলমারী উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান পদের উপনির্বাচনে আওয়ামী লীগ মনোনীত নৌকা প্রতীকের প্রার্থী সোলায়মান আলী সরকারকে পরাজিত করে বিজয়ী হয়েছেন আনারস প্রতীকে প্রতিদ্বন্দ্বিতাকারী স্বতন্ত্র প্রার্থী রুকুনুজ্জামান (শাহীন)। আওয়ামী লীগ প্রার্থীর এই পরাজয়ের মাধ্যমে প্রায় আড়াই দশক ধরে একচ্ছত্র আধিপত্য বজায় রাখা এ উপজেলা পরিষদে প্রথমবারের মতো নিয়ন্ত্রণ হারালো ক্ষমতাসীন দলটি। যদিও ইভিএমে নেওয়া এ ভোটে ভোটকেন্দ্রগুলোতে ভোটার উপস্থিতি ছিল নগণ্য, শতকরা ৩৭ দশমিক ২ ভাগ।
বুধবার সন্ধ্যার পর বেসরকারি ফল ঘোষণার মাধ্যমে ‘আওয়ামী লীগের দুর্গ’ খ্যাত চিলমারী উপজেলা পরিষদের নতুন চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন স্বতন্ত্র প্রার্থী রুকুনুজ্জামান শাহীন। তিনি জাতীয় পার্টির রাজনীতির সঙ্গে জড়িত বলে জানা গেছে। আর পরাজিত প্রার্থী মো. সোলায়মান আলী সরকার (৭৫) উপজেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি পদে রয়েছেন। তিনি সদ্যপ্রয়াত উপজেলা চেয়ারম্যান শওকত আলী সরকারের বড় ভাই এবং প্রাথমিক ও গণশিক্ষা প্রতিমন্ত্রী জাকির হোসেনের শ্বশুর বলে জানা গেছে।
নির্বাচনে বিজয়ী রুকুনুজ্জামান আনারস প্রতীক নিয়ে পেয়েছেন ১৬ হাজার ২০৬ ভোট। তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী আওয়ামী লীগ প্রার্থী নৌকা প্রতীকে পেয়েছেন ১৪ হাজার ৩৬২ ভোট।
এর আগে বুধবার সকাল ৮টা থেকে বিকাল ৪টা পর্যন্ত উপজেলার ৪৫টি ভোটকেন্দ্রে ইভিএমে ভোটগ্রহণ অনুষ্ঠিত হয়। বিভিন্ন ভোটকেন্দ্র ঘুরে দেখা গেছে, ভোটার উপস্থিতি ছিল নগণ্য। ভোটারদের মধ্যে ভোট নিয়ে তেমন আগ্রহও দেখা যায়নি। দু-একটি কেন্দ্র ছাড়া সব ভোটকেন্দ্র ছিল ভোটার লাইনবিহীন।
স্থানীয়রা বলছেন, উপজেলা পরিষদ সৃষ্টির পর থেকে চিলমারী উপজেলা পরিষদের পাঁচ পাঁচ বারের নির্বাচিত চেয়ারম্যান ছিলেন উপজেলা আওয়ামী লীগের প্রয়াত সভাপতি শওকত আলী সরকার (বীরবিক্রম)। প্রথমে জাতীয় পার্টির রাজনীতি করলেও পরবর্তীতে আওয়ামী লীগে যোগ দেওয়া এই যুদ্ধাহত বীর মুক্তিযোদ্ধা টানা ৩৫ বছর উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ছিলেন। গত ২২ আগস্ট তিনি মারা যান। বুধবার অনুষ্ঠিত উপনির্বাচনে আওয়ামী লীগ প্রার্থী সোলায়মান আলী সরকারের পরাজয়ের মাধ্যমে এই উপজেলা পরিষদে আওয়ামী লীগের একচ্ছত্র ক্ষমতার অবসান হলো বলে মনে করছেন বিজয়ী প্রার্থী রুকুনুজ্জামানের সমর্থকরা।
এদিকে নৌকা প্রতীকের এমন ভরাডুবির পেছনে বয়স্ক ও অসুস্থ প্রার্থীকে মনোনয়ন দেওয়াকে দায়ী করছেন আওয়ামী লীগ দলীয় নেতাকর্মীরা।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে নেতাকর্মীরা বলছেন ,‘চিলমারী ও রৌমারী উপজেলা দুটি কুড়িগ্রাম-৪ আসনের আওতাভুক্ত। ওই আসনের সংসদ সদস্য প্রাথমিক ও গণশিক্ষা প্রতিমন্ত্রী জাকির হোসেন। চিলমারী উপজেলায় দলীয় নেতাকর্মীদের সঙ্গে সমন্বয় না করে তিনি নিজের বয়স্ক শ্বশুরকে প্রার্থী করিয়েছেন। আর রৌমারী উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি প্রতিমন্ত্রী নিজেই। ওই উপজেলায় প্রার্থী হয়েছেন তারই কমিটির সাধারণ সম্পাদক রেজাউল ইসলাম। এরপরও নৌকা প্রতীকের পরাজয়ে তিনি দায় এড়াতে পারেন না।’
তবে দলীয় প্রার্থী হারলেও এটাকে দলের নয় বরং প্রার্থীর পরাজয় হিসেবে দেখছেন ওই আসনের সংসদ সদস্য এবং প্রাথমিক ও গণশিক্ষা প্রতিমন্ত্রী জাকির হোসেন। তিনি বলেন, ‘এটা দলের ভরাডুবি নয়। এখানে প্রার্থী পরাজিত হয়েছেন। রৌমারীতে একাধিক বিদ্রোহী প্রার্থী এবং চিলমারীতে প্রার্থীর বেশি বয়সের কারণে তারা পরাজিত হয়েছেন।’
জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আমান উদ্দিন আহমেদ মঞ্জু বলেন, ‘চিলমারীর প্রার্থীর বেশি বয়স এবং অসুস্থতার জন্য তিনি ভোটারদের কাছে যেতে পারেননি। এমনকি নির্বাচনি মিটিংয়েও উপস্থিত হতে পারেননি। এ ছাড়াও উপজেলা আওয়ামী লীগের কমিটির সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের মৃত্যুর পর ভারপ্রাপ্ত সভাপতি-সাধারণ সম্পাদক দিয়ে দল চলছে। এতে দলীয় নেতাকর্মীদের মধ্যে সমন্বয় করা সম্ভব হয়নি। এটাও পরাজয়ের কারণ।’
‘আমরা এ মাসেই ওই উপজেলায় কাউন্সিল করবো। এতে নেতাকর্মীরা আবারও সক্রিয় হয়ে উঠবেন এবং সাংগঠনিক অবস্থান আবারও দৃঢ় হবে।’ দলীয় অবস্থান পুনর্গঠনের বিষয়ে বলেন এই আওয়ামী লীগ নেতা।
নবনির্বাচিত উপজেলা চেয়ারম্যান মো. রুকুনুজ্জামান শাহীন বলেন, ‘কারও দুর্গ ভাঙতে পেরেছি কিনা জানি না। জনগণ পরিবর্তন চেয়েছে। এই বিজয় গণমানুষের বিজয়।’
চিলমারীর মানুষের জন্য সরকারের দেওয়া যাবতীয় সুযোগ-সুবিধা সার্বজনীন করবেন এমন আশ্বাস দিয়ে চেয়ারম্যান নির্বাচিত হওয়া এই কলেজশিক্ষক বলেন, ‘মানুষ দীর্ঘদিন ধরে পরিবর্তন চেয়েছে। এজন্য আমাকে নির্বাচিত করেছে। আমি বাকি জীবন জনগণের পাশে থেকেই মরতে চাই।’