‘জবা কুসুম সন্ধ্যামালী আনরে তুলিয়া মনোরঙ্গে সাজাও কুঞ্জ সব সখি মিলিয়া’, ‘মুর্শিদ বলি নৌকা ছাড়ো তুফান দেখি ভয় করিও না, মুর্শিদ নামে ভাসালে তরী অকূলে ডুবিবে না’, ‘দেখলাম দেশের এই দুর্দশা, ঘরে ঘরে চুরের বাসা’ এমন গান শুনলেই বুঝা যাবে রাধারমণ দত্তের সংগীত বিচিত্র বিষয়ে পরিপূর্ণ। রাজবৈদ্য চক্রপাণি দত্তের অধস্তন পুরুষেরা শ্রীহট্টের প্রাচীন সামন্ত বংশ। ১৮৩৩ সালে এই বংশের প্রভাকর দত্তের দ্বাদশ পুরুষে জগন্নাথপুর থানার কেশবপুর গ্রামে দেশের লোক সংষ্কৃতির উজ্জ্বল নক্ষত্র গীতিকবি রাধারমণ দত্তের জন্ম। রাধারমণের পিতা রাধামাধব পরম পন্ডিত ও অশেষ গুণের অধিকারী ছিলেন। পিতার সংগীত ও সাহিত্য সাধনা রাধারমণকে প্রভাবিত করে। কালক্রমে তিনি একজন স্বভাবকবি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন। সার্বজনীন গানের এই স্রষ্টা ১৯১৫ সালের ১০ নভেম্বর (১৩২২ বঙ্গাব্দের ২৬ কার্তিক) শুক্রবার পৃথিবী থেকে পাড়ি জমান সাধনোচিত ধামে।
বৈষ্ণব কবি রাধারমণ দত্ত একাধারে গীতিকার, সুরকার ও শিল্পী ছিলেন। বিভিন্ন সংগ্রাহকদের মতে, রাধারমণে গানের সংখ্যা তিন হাজারেরও উপরে। সাধক রাধারমণের গানের বেশ কিছু গানের বই বিভিন্ন সময়ে প্রকাশিত হয়েছে। অধ্যাপক যতীন্দ্র মোহন ভট্টাচার্য প্রথমে রাধারমণ দত্তের গান সংগ্রহের উদ্যোগ গ্রহণ করেন। কলিকাতা থেকে ‘বাউল কবি রাধারমণ’ নামে ৮৯৮ টি গান নিয়ে একটি গ্রন্থ প্রকাশিত হয়। মোহাম্মদ মনসুর উদ্দীন তার হারামনি গ্রন্থের সপ্তম খণ্ডে রাধারমণের ৫১ টি গান অন্তর্ভুক্ত করেন।
এছাড়াও রাধারমণ সংগীত, সম্পাদক, মোহাম্মদ আসরাফ হোসেন, সাহিত্যরতœ, ভানুগাছ, শ্রীহট্ট, (দ্বিতীয় সংস্করণ ১৩৩৬ বঙ্গাব্দ), ‘ভাইবে রাধারমণ বলে’ (১৯৭৭) সম্পাদনা মুহম্মদ আবদুল হাই, সুনামগঞ্জ, শ্রীহট্ট, সিলেটের মোদন মোহন কলেজের সাহিত্য পরিষদ থেকে ‘রাধারমণ সঙ্গীত’ নামে চৌধুরী গোলাম আকবর সাহিত্যভূষনের সংগৃহিত একটি গ্রন্থ ১৯৮১ খ্রিস্টাব্দে প্রকাশিত হয়। অধ্যাপক নন্দলাল শর্মা ‘রাধারমণের হাজার কবিতা’ নামে একটি সংকলন প্রকাশ করেছেন। ঢাকার অ্যার্ডন পাবলিকেন্স প্রকাশ করেছে সুমনকুমার দাশ সম্পাদিত ‘অগ্রন্থিত রাধারমণ’। আরও অনেক বিদগ্ধজন রাধারমণ দত্তের গান সংগ্রহ করেছেন।
ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের আগরতলার কবি বিজনকৃষ্ণ চৌধুরী সম্পাদিত ‘বাউল কবি রাধারমণগীতি সংগ্রহ’ গ্রন্থে ‘রাধারমণের জীবনী কথা’য় বলা হয়েছে, যদিও রাধারমণের স্বগৃহে আমরা খুব বেশি সংখ্যক গান পাইনি, তবু কেশবপুর গ্রামেই এখনো প্রচুর অসংগৃহীত গান ছড়িয়ে আছে, নানা কারণে আমরা তার অংশমাত্র সংগ্রহ করতে পেরেছি। এমন অভিজ্ঞতা আমাদের অন্যত্রও হয়েছে। স্থানীয়রা বলছেন, দেশ বিভাজনের পর তঁর ভক্তরা অনেকেই আসাম, মেঘালয়, ত্রিপুরা, পশ্চিমবঙ্গে ও অন্যত্র সরে এসেছেন। অধ্যক্ষ দেওয়ান আজরফ সাহেবের মাধ্যমে জানা গেছে, সুনামগঞ্জের জামাইপাড়ার জনৈক শ্রীযুক্ত সতীশ রায়ের সংগ্রহেই একসময় সহস্রাধিক গানের সংগ্রহ ছিল। এও জানা যায় শ্রীযুক্ত সতীশ রায় কাছাড়ের শিলচরে এসে কিছুকাল বসবাসের পরই লোকান্তরিত হন এবং তাঁর আত্মীয় স্বজনেরা কেউ সেই সংগৃহীত গীতরাশির কোনো হদিশ দিতে পারেন নি।
তাঁর গানে প্রার্থনা, আত্মতত্ব, দেহতত্ব এবং পরমাত্মা বিষয়ক সঙ্গীত ছাড়াও তাঁর স্বদেশ প্রেমেরও অনেক গান রয়েছে। তবে সবচেয়ে আকর্ষণীয় এবং ব্যতিক্রম হচ্ছে ধামাইল গান। রাধারমণের গানে শব্দ প্রয়োগের ক্ষেত্রে সাম্প্রদায়িকতা ছিলা না। আল্লাহ্-ঈশ্বরে যেমন তিনি পার্থক্য দেখেন নি, গুরু এবং মুর্শিদ শব্দের পার্থক্য দেখান নি। তাঁর গানের সুরে ভূবন মাতোয়ারা হলেও রাধারমন দত্তের নিজের ভূ-সম্পতি অর্পিত হওয়ায় রাধারমণ গবেষক ও ভক্তদের মধ্যে ক্ষোভ রয়েছে। রাধারমণ দত্তের গানের চর্চা বাড়াতে রাধারমণের জন্মভিটায় রাধারমণ কমপ্লেক্স দ্রুত নির্মাণের দাবি রয়েছে স্থানীয় সংস্কৃতি কর্মীদের। সেজন্য তাঁর জন্মভিটায় রাধারমণ কমপ্লেক্স নির্মাণের উদ্যোগ গ্রহণ করেছে বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমী। রাধারমণের ১০৫০টি গান ডিজিটাল পদ্ধতিতে সংরক্ষণ হয়েছে।
রাধারমণ দত্তের অমূল্য সৃষ্টিকর্ম আমাদের লোক সাহিত্যের অমূল্য রতœভান্ডার। রাধারণের গান এখনও আমাদের হৃদয়ে দোলা দেয়। তার রচিত গান সাধন ভজনের পরিধি সত্বেও কোন একটি নির্দিষ্ট সম্প্রদায়ের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকেনি। তাঁর সৃষ্টিতে রয়েছে জীবনবোধের অন্য এক মায়াবী আধার, এর সংস্পর্শে এলেও আনন্দ লাভ হয়। তাঁরগানের ওপর ইউরোপের নামিদামি বিশ্ববিদ্যালয়ে থিসিস হচ্ছে। কিন্তু দু:খের বিষয় সংরক্ষণের অভাবে তার অনেক গান হারিয়ে যাচ্ছে। গানের কথা ও সুর বিকৃত করা হচ্ছে। এজন্যই হয়তো জীবনের শেষ পর্যায়ে এসে তিনি লিখেছিলেন,‘আমার সাধনার ধন হইল চুরি, আমি কার পানে চাইরে।’