দোয়ারাবাজার উপজেলায় বানের পানি কমতে শুরু করেছে। পানি চলে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে চরমে পৌঁছেছে জনদুর্ভোগ। বানের তোড়ে ভেঙ্গেচুরে একাকার হয়ে গেছে উপজেলার সবকটি সড়ক। বিশুদ্ধ পানির অভাবে পানিবাহিত রোগবালাইয়ের প্রকোপ বেড়েছে।
এদিকে বন্যার কবল থেকে প্রাণ বাঁচাতে গিয়ে বজ্রপাতসহ এ পর্যন্ত ১৪ জনের মৃত্যু হয়েছে। বানভাসি মানুষের মধ্যে চরম খাদ্যসঙ্কটে উপজেলাজুড়ে হাহাকার শুরু হয়েছে। সহস্রাধিক বসতঘর বিধ্বস্ত এবং অন্তত শতাধিক বসতঘর ভেসে গেছে।
বুধবার স্থানীয় সংসদ সদস্য মুহিবুর রহমান মানিক দোয়ারাবাজার উপজেলার বন্যা কবলিত বিভিন্ন এলাকা পরিদর্শন করেন। এসময় তিনি উপজেলা সদরে অবস্থান করলে হাজারো বানভাসি মানুষ ত্রাণের জন্য ভীড় জমায়। খাবার সংকটে চারিদিকে যেন হাহাকার বিরাজ করছে।
সরেজমিন ক্ষতিগ্রস্ত বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, উপজেলার ৯ ইউনিয়নে এখনও অধিকাংশ মানুষ পানিবন্দী। বন্যার পানি ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেও বসতভিটায় কাদামাটি হওয়ায় মাথাগোঁজার মতো পরিস্থিতি নেই ঘরে। বানের তোড়ে বসতভিটা ভেসে যাওয়া অসংখ্য মানুষ পরিবার পরিজন নিয়ে খোলা আকাশের নীচে বসবাস করছে। হাজার হাজার মানুষ এখনও আশ্রয় কেন্দ্রগুলোতে অবস্থান করছেন। কোথাও থেকে ত্রাণের খবর পেলে অসহায় বানভাসি মানুষজন কোমর পানিতে সারি সারি হয়ে অপেক্ষা করতে দেখা গেছে। রাত পোহালেই ত্রাণের জন্য শতশত নারী পুরুষ উপজেলা নির্বাহী অফিসার, উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান কার্যালয়, পিআইও অফিস, চেয়ারম্যান মেম্বারদের বাড়িতে ভীড় জমাচ্ছে।
সদর ইউপি চেয়ারম্যান আবদুল হামিদ বলেন, বন্যায় কাবু হয়ে পড়েছন গ্রামের মানুষ! খাদ্য সঙ্কট চরম আকার ধারণ করেছে। রাস্তাঘাট, বাড়িঘরের বেহালবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। মাথাগোঁজার ঠাঁই নেই কোথাও। সদর ইউনিয়নের বিভিন্ন গ্রামে অন্তত শতাধিক বসতঘর বিধ্বস্ত হয়েছে। বানের তোড়ে ভেসে গেছে বেশ কিছু বসতঘর। এ ইউনিয়নের ৯০ ভাগ মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। যা বরাদ্দ হয় তার চেয়ে তিনগুণ বেশি চাহিদা রয়েছে। ত্রাণ দিতেগেলে মানুষ সামাল দেওয়া যাচ্ছে না।
উপজেলা সদরের খেসরি মালা কান্নায় ভেঙে পড়ে বলেন, বন্যায় বসতঘর তলিয়ে গেলে আশ্রয় কেন্দ্রে অবস্থান করছি। দুইদিন দুই বেলা খিচুড়ি এবং এ পর্যন্ত চিরা মুড়ি ব্যতিত আর কিছুই পাইনি। আমার একটি পা ভাঙা ত্রাণ নিতে গিয়ে হয় মারামারি, তাই কোথাও যেতেও পারছি না।
বোগলাবাজার ইউপি চেয়ারম্যান মোহাম্মদ মিলন খাঁন বলেন, বোগলাবাজার ইউনিয়নের অন্তত দুই শতাধিক বাড়িঘর বিধ্বস্ত এবং অর্ধশত ঘর পানির স্রোতে ভেসে গেছে। খাদ্যসঙ্কটে ইদুকোনা-রামনগর পর্যন্ত চিলাই নদীর বেড়িবাঁধের ১৮টি স্থানে ভেঙে গিয়ে ঢলের তোড়ে ভেসে গেছে অনেক বসতঘর। ওই ইউনিয়ন প্রাণ বাঁচাতে গিয়ে জাহানারা বেগম (৬০) নামর এক বৃদ্ধার সলিলসমাধিও হয়েছে। সব-কটি যোগাযোগ সড়ক ভেঙে গিয়ে ভয়ংকর আকার ধারণ করেছ। উপজেলা সদরের বাজিতপু গ্রামের একটি ব্রিজ পানির স্রোতে ভেসে যাওয়ায় কয়েকটি গ্রামের মানুষ চরম বিপাকে রয়েছেন।
দোহালিয়া ইউপি চেয়ারম্যান শামীমুল ইসলাম শামীম জানান, বন্যায় অন্তত দুই শতাধিক বসতঘর বিধ্বস্ত হয়েছে। রাস্তাঘাট, ব্রিজ-কালভার্টের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি সাধিত হয়েছে।
লক্ষ্মীপুর ইউপি চেয়ারম্যান প্রভাষক জহিরুল ইসলাম বলেন, খাসিয়ারা নদীর বেড়িবাঁধ একাধিক স্থানে বড় বড় ভাঙনের ফলে যোগাযোগ ব্যাবস্থা সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন রয়েছে। বানের তোড়ে বিধ্বস্ত হয়েছে অসংখ্য বসতঘর। বানের তেড়ে ভেসেগেছে অর্ধশতাধিক বাড়িঘর।
সদর ইউনিয়নের মাজেরগাঁও গ্রামের পানিবন্দী বীর মুক্তিযোদ্ধা নুরুল ইসলাম বলেন, বসতঘর বানের তোড়ে একদিকে হেলে গেছে। নদীভাঙ্গনের পাড়ে আছি। ঘরের ভেতরের সব মাটি বানের তোড়ে বের হয়ে গেছে। এখনও আশ্রয় কেন্দ্রে পরিবার পরিজন নিয়ে আছি।
উপজেলা সদরের পশ্চিম মাছিমপুর গ্রামের আছমত আলী বলেন, ‘আমার ঘর বানের তোড়ে ভেসে গেছে। ঘরে খাবার নেই। শারীরিক অবস্থার কারণে ত্রাণের জন্য গিয়ে তারাহুড়ো করতে পারি না।’
উপজেলা সহকারী কমিশনার ভূমি ফয়সাল আহমেদ বলেন, উপজেলার ৯০ ভাগ মানুষ এবারের বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। প্রতিটা গ্রামে প্রতিদিন বানবাসী মানুষের বাড়ি বাড়ি গিয়ে ত্রাণ পৌঁছে দেয়ার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি, পাশাপাশি আশ্রয় কেন্দ্রগুলোতে ত্রাণসহ রান্নাকরা খাবার দিয়ে যাচ্ছি।
উপজেলা দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তরের প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা আম্বিয়া আহমদ বলেন, উপজেলায় এ পর্যন্ত সরকারি বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে চালসহ শুকনো খাবার দিয়ে যাচ্ছি। এখন পর্যন্ত ৪ সহস্রাধিক বন্যা কবলিত মানুষের মাঝে সরকারি বরাদ্দ বিতরণ করা হয়েছে। ত্রাণ কার্যক্রম অব্যাহত রয়েছে। এছাড়া বন্যার পানি কমতে থাকায় পানি বিশুদ্ধকরণ ট্যাবলেট এবং ওরস্যালাইন বিতরণ করা হচ্ছে।