আইনজীবীর অশালীন কথাবার্তা আচরণবিধির লঙ্ঘন

নরসিংদী রেলওয়ে স্টেশনে একজন তরুণীকে তাঁর পোশাকের জন্যে হেনস্তা করে হয়েছে। এই হেনস্তার জন্যে একটা মামলা হয়েছে, মামলায় দুইজন আসামিকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। একজন আসামি মার্জিয়া, তাঁর পক্ষে নিযুক্ত উকিল সাহেবার নাম অ্যাডভোকেট শিরিন।

একজন উকিল হিসাবে তিনি মার্জিয়াকে আইনি সেবা দিচ্ছেন, সেটা তিনি দিতেই পারেন, সেটা তাঁর পেশাগত কাজ। সেটার জন্যে তাকে নিন্দা করার কিছু নাই। তিনি যদি মনে করেন যে মার্জিয়াকে রিমান্ডে নেওয়া ঠিক হয়নি, তিনি নিশ্চয়ই সেটা আদালতে বলেছেন, যুক্তি-তর্ক উপস্থাপন করেছেন। সেটাও তাঁর পেশাগত দায়িত্ব।

আদালত তাঁর সিদ্ধান্ত দিয়েছেন, সেই সিদ্ধান্ত যদি অ্যাডভোকেট সাহেবার পছন্দ না হয়, তাঁর বিরুদ্ধেও প্রতিকার আছে, সেগুলিও অ্যাডভোকেট শিরিন চেষ্টা করতে পারেন। এইগুলি নিয়ে বলার কিছু নাই। বিচারে তাঁর মক্কেলের জন্যে আইনগতভাবে বৈধ পন্থায় যা কিছু করার সবই তিনি করতে পারেন।

কিন্তু তিনি যখন ফেসবুক লাইভে এসে ভিক্টিম সম্পর্কে অশালীন কথাবার্তা বলতে থাকেন আর ভিক্টিমকে হাতের কাছে পেলে দেখে নিতেন ইত্যাদি বলে হুমকি দিতে থাকেন, এটা অ্যাডভোকেট শিরিনের পেশাগত কাজ নয়। সেই সাথে তিনি তদন্তকারী কর্মকর্তা সম্পর্কে যেসব কথা প্রচার করছেন, হেনস্তার প্রতিবাদ যারা করছেন ওদের সম্পর্কে যেসব মন্দ ও আপত্তিকর কথা বলছেন সেগুলিও তাঁর পেশাগত কাজের অংশ মোটেই নয়।

লোকজনকে বেত্রাঘাত করার হুমকি দেওয়া এবং অশোভন ভাষায় গালাগালি করা এগুলি উকিলের কাজ নয়। এগুলি তিনি করছেন তাঁর নিজের রাজনৈতিক ও আদর্শগত অবস্থান থেকে। স্পষ্টতই তিনি তীব্র নারীবাদ বিরোধী, নারী বিদ্বেষী। নারীবাদীদের নিয়ে তাঁর অশালীন কথা তো তাঁর ভিডিওতেই আছে আরকি। নারীবাদী শব্দটি উচ্চারণের সাথে তাঁর চেহারার যে কুৎসিত অভিপ্রকাশ তিনি করেন সেটা তাঁর মুখের শব্দসমূহের চেয়ে অশ্লীল, কদর্য ও অন্যায়।

আপনারা লক্ষ্য করেছেন কিনা জানি না, এই ভদ্রমহিলা তাঁর ভিডিওতে এইসব অন্যায় ও কদর্য আচরণের সাথে, সম্ভবত তাঁর বক্তব্য ইত্যাদির পক্ষে নৈতিক সমর্থন আদায়ের উদ্দেশ্যে এবং নিজের সামাজিক অবস্থানের গুরুত্বও বোঝানোর জন্যে বাংলাদেশ মহিলা আইনজীবী সমিতির পরিচয় ব্যবহার করছেন এবং আমাদের দেশের একজন শীর্ষস্থানীয় নারী অধিকার নেত্রী অ্যাডভোকেট ইসলামের সাথে তাঁর সম্পর্কের কথা ব্যবহার করছেন।

শিরিন নামক এই মহিলার বক্তব্য তাঁর ভিডিও, ফেসবুক পোস্ট ইত্যাদি এবং সেইসব ভিডিও ও পোস্টে দেওয়া বক্তব্য এইগুলি নিয়ে আমি কিছু বলতে চাই না। নরসিংদীর কোথাকার কোন এক শিরিন নারীবাদীদের সম্পর্কে বা নারী অধিকার সম্পর্কে বা নারীর স্বাধীনতা প্রসঙ্গে কি বলল বা না বলল তাতে আমি উদ্বিগ্ন নই। নারী অধিকার নিয়ে যারা কথা বলেন ওদেরকে এইসব কথা প্রতিদিন শুনতে হয়, প্রতিদিন লড়তে হয় পিতৃতন্ত্রের দাসী নানা শ্রেণি-পেশার এইসব লোকেদের সাথে। শিরিন এইরকমই আরেকজন মাত্র। এইরকম তুচ্ছ ক্যারেক্টারদের নিয়ে মাথা ঘামানোর কিছু নাই। শিরিন তো গুরুত্বপূর্ণ কেউ নয়, অনেক গুরুত্বপূর্ণ নারীকেও আমি এইরকম ভূমিকা নিতে দেখেছি। কিন্তু আমার কিঞ্চিৎ উদ্বেগ অন্যত্র।

এই যে ভদ্রমহিলা নানাভাবে জাতীয় মহিলা আইনজীবী সমিতির নাম ব্যবহার করে যাচ্ছেন সেইটা নিয়ে আমার কথা আছে। আমি জানতে চাই এই শিরিন কি আসলেই মহিলা আইনজীবী সমিতির নেত্রী? তিনি কি মহিলা আইনজীবী সমিতির হয়ে ওদের নামের নীতিগত অবস্থান প্রকাশ করার অধিকার সংরক্ষণ করেন? মহিলা আইনজীবী সমিতি কি শিরিনের এইসব বক্তব্য সমর্থন করে? এইসব বক্তব্য কি মহিলা আইনজীবী সমিতির বক্তব্য? অনুমান করি এইসব বক্তব্য মহিলা আইনজীবী সমিতির বক্তব্য নয়। নারীর স্বাধীনতা প্রশ্নে মহিলা আইনজীবী সমিতির যে রাজনৈতিক ও আদর্শগত অবস্থান সেটার সাথে এই শিরিন নামক ভদ্রমহিলার বক্তব্য সঙ্গতিপূর্ণ নয়। এই নারীটি মহিলা আইনজীবী সমিতির নাম ব্যবহার করে চূড়ান্ত পেট্রিয়ার্কি ছড়াচ্ছেন।

আপনারা কেউ কি জাতীয় মহিলা আইনজীবী সমিতির নজরে এই বিষয়টা এনেছেন? আনতে পারেন? পোশাকে কারণে একটা মেয়েকে হয়রানী করল কিছু লোক, আর জাতীয় মহিলা আইনজীবী সমিতির নাম ব্যবহার করে একজন অ্যাডভোকেট ভিক্টিমকে গালাগালি করবে আর হেনস্তার পক্ষে নৈতিক সমর্থন প্রকাশ করবে? না, সেই অ্যাডভোকেট মহিলার মক্কেল দোষী কি নির্দোষ সেটা নিয়ে তিনি আদালতে লড়ুন, সেটা ভিন্ন বিষয়। কিন্তু ভিক্টিমকে দোষারোপ করবেন, তাও আবার এইরকম একটা সংগঠনের নামে! এইটার বিরুদ্ধে তো একটা ব্যবস্থা নিতে হয়।

আর উকিল হিসেবেও এই মহিলার আচরণ আমাদের আচরণবিধির লঙ্ঘন বটে। আমাদের আচরণবিধিতে বলা আছে যে উকিলরা তাঁদের পেশাগত কাজের সাথে ব্যক্তিগত স্বার্থ জড়াবেন না- একটা ন্যুনতম মাত্রায় হলেও নৈর্ব্যক্তিক অবস্থান বজায় রাখতে হয়। অবশ্য এই মহিলা আচরণবিধির কিছু জানেন বলে আমার মনে হয় না। উকিলদের মধ্যে মূর্খের অভাব তো নাইই আর কি।

ইমতিয়াজ মাহমুদ : লেখক, অ্যাক্টিভিস্ট ও আইনজীবী