বাজেট সহায়তা বাবদ প্রত্যাশিত ঋণ পেতে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ)-এর দেওয়া শর্ত পরিপালনে বাংলাদেশের তেমন সমস্যা হবে না বলে মনে করেন অর্থনীতিবিদরা। তারা বলছেন, শর্তগুলো পুরনো। এগুলো বাস্তবায়নে আগে থেকেই সরকার আন্তরিক। তবে এর পাশাপাশি সরকারকে রিজার্ভ বাড়ানোর পরামর্শ দিয়েছেন অর্থনীতিবিদরা।
সূত্র জানিয়েছে, আইএমএফ-এর ঋণ পেতে বাংলাদেশকে শর্ত হিসেবে অর্থনীতিতে কিছু সংস্কারের পরামর্শ দেওয়া হতে পারে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে— রাজস্ব খাতে অটোমেশন চালু, আর্থিক খাতে ঋণ ও আমানতের সুদের হারের ওপর আরোপিত ক্যাপ তুলে নেওয়া, জ্বালানি তেলের মূল্য সমন্বয়ে একটি ফর্মুলায় এনে তা ঘোষণা করা, সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচিকে বাজেট থেকে আলাদা করা এবং কৃষিতে ভর্তুকির পরিমাণ কমানো।
তবে এসব শর্ত ও সংস্কার সরকার নিজে থেকেই করছে বলে দাতা সংস্থা নতুন করে আর সমস্যায় ফেলবে না বলেও জানায় সূত্র।
২০২২ সালে করোনার দাপট কমে এলেও ইউক্রেন-রাশিয়ার যুদ্ধের কারণে অস্থিতিশীল হয়ে ওঠে বিশ্ব অর্থনীতি। যার প্রভাব পড়ে দেশের অর্থনীতিতেও। এতে ডলার সংকটের পাশাপাশি বাড়ে আমদানি ব্যয়। কমতে থাকে রিজার্ভ। গত ২০ জুলাই যা ৩৯ দশমিক ৪৯ বিলিয়ন ডলারে দাঁড়িয়েছে।
জুলাইতে বাড়লেও তার আগের কয়েক মাস প্রবাসী আয়ের প্রবাহ কমেছে। সব মিলিয়ে লেনদেনের ভারসাম্যে নেতিবাচক অবস্থা সৃষ্টি হয়েছে।
মুদ্রা বাজারে স্থিতিশীলতা, রিজার্ভের মজুত চাঙ্গা করা এবং বাজেট ঘাটতি মেটাতে আন্তর্জাতিক ঋণদাতা সংস্থাগুলোর কাছ থেকে ঋণ গ্রহণে সরকারের পক্ষ থেকে আবেদন করা হয়েছে বলে জানা গেছে। যা গণমাধ্যমকে জানিয়েছেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল।
বৈশ্বিক পরিস্থিতিতে দেশের আর্থিক পরিবেশ কিছুটা সংকটে বলে এটা মোকাবিলায় আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর কাছ থেকে ঋণ নেওয়া উচিত বলে মনে করেন অর্থনীতিবিদরা। এতে কোনও জটিলতাও দেখছেন না বলে জানিয়েছেন তারা।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বৈশ্বিক পরিস্থিতিকে সামাল দিতে দেশের লেনদেনের ভারসাম্য বজায় রাখা এবং বাজেট সহায়তার জন্য সরকার বিভিন্ন উন্নয়ন সহযোগীরও সহায়তা চাইছে। করোনা শুরুর সময় সরকার উন্নয়ন সহযোগীদের কাছে সহায়তা চেয়েছিল।
এবার আইএমএফ-এর কাছে ৪৫০ কোটি ডলার, বিশ্বব্যাংকের কাছে ৭৫ কোটি ডলারের বাজেট সহায়তা ও জলবায়ু তহবিল থেকে ২৫ কোটি ডলার, জাপান ইন্টারন্যাশনাল কো-অপারেশন এজেন্সির (জাইকা) কাছে ৭৫ কোটি ডলার, এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের (এডিবি) কাছে ১০০ কোটি ডলার, এশিয়ান ইনফ্রাস্ট্রাকচার ইনভেস্টমেন্ট ব্যাংকের (এআইআইবি) কাছে ৪০ কোটি ডলার ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের কাছে থেকে ৯ দশমিক ৯ কোটি ডলারের বাজেট সহায়তা পাওয়ার চেষ্টা করা হচ্ছে।
সব মিলিয়ে ৭৭৪ দশমিক ৯ কোটি ডলার ঋণ সহায়তা চেয়েছে সরকার। এর মধ্যে আইএমএফ’র কাছে আগামী তিন বছর মেয়াদে ৪৫০ কোটি ডলার চেয়ে সরকারের পক্ষ থেকে চিঠি দেওয়া হয়েছে।
আইএমএফর পক্ষ থেকে বাংলাদেশকে এ ঋণ সহায়তা দিতে সবুজ সংকেতও পাওয়া গেছে, যা গত ৪ আগস্ট কৃষিমন্ত্রী ড. আব্দুর রাজ্জাক সাংবাদিকদের জানিয়েছেন।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে বিশ্বব্যাংকের বাংলাদেশ মিশনের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন জানিয়েছেন, ‘আইএমএফ, বিশ্বব্যাংকসহ দাতাসংস্থাগুলোর কাছে বাজেট সহায়তা হিসেবে ঋণ চাইছে সরকার। এখন আমাদের রিজার্ভ বাড়ানো দরকার। এমন পরিপ্রেক্ষিতে দাতাসংস্থা থেকে বাজেট সহায়তা হিসেবে ঋণ গ্রহণে তেমন কোনও সমস্যা হবে না।’
ড. জাহিদ আরও জানিয়েছেন, ‘আইএমএফ ঋণ দেওয়ার ক্ষেত্রে বাংলাদেশকে শর্ত হিসেবে কিছু সংস্কারের কথা বলবে। যা তারা এর আগেও বলেছে। এ ধরনের শর্ত ও সংস্কার সরকারের এমনিতেই করা উচিত।’
ইতোমধ্যেই নিয়মিত পরিদর্শনের অংশ হিসেবে বাংলাদেশ সফর করে গেছে আইএমএফ-এর একটি প্রতিনিধি দল। বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ সন্তোষজনক পর্যায়ে আছে বলে মন্তব্য করেছে তারা।
তবে রাজস্ব বাড়িয়ে বিভিন্ন খাতে ভর্তুকির পরিমাণ কমিয়ে আনার পরামর্শ দিয়েছে আইএমএফ।
ব্যাংকিং খাতে সুশাসন নিশ্চিত এবং আমানত ও ঋণের সুদ হারে ৯ ও ৬ শতাংশ সীমা (ক্যাপ) প্রত্যাহারেরও পরামর্শ দিয়েছেন প্রতিনিধিরা।
আইএমএফ প্রতিনিধি দলটি খেলাপি ঋণ নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। তবে পর্যায়ক্রমে জ্বালানি তেলের মূল্য সমন্বয় করতে আইএমএফ যে আহ্বান জানিয়েছিল, তার পরিপ্রেক্ষিতে ৬ আগস্ট মধ্যরাত থেকে জ্বালানি তেলের দাম বাড়িয়েছে সরকার।
এছাড়া, বাজেট অর্থায়ন থেকে সঞ্চয়পত্রকে আলাদা করারও পরামর্শ দিয়েছে আইএমএফ প্রতিনিধি দল।
অর্থ বিভাগ ও অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ সূত্রে আরও জানা গেছে, বিশ্বব্যাংক ও জাইকার কাছ থেকে ২০০ কোটি ডলার পাওয়ার বিষয়ে অনানুষ্ঠানিক আলোচনা শুরু হয়েছে।
এছাড়া, এআইআইবি থেকে ৪০ কোটি ডলার বাজেট সাপোর্ট পেতে আলোচনা করছেন অর্থ মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা।
ইইউ থেকে ৯ দশমিক ৯ কোটি ডলার পাওয়ার বিষয়ে শিগগিরই চুক্তি সই হবে।
সূত্রমতে, চলতি (২০২২-২৩) বাজেট সহায়তা হিসেবে এ মুহূর্তে দাতা সংস্থাগুলোর সঙ্গে প্রায় ৮০০ কোটি ডলারের ঋণ সহায়তা পেতে আলোচনা চলছে।
আইএমএফ-এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) ক্রিস্টালিনা জর্জিয়েভার কাছে তিন বছরের জন্য ৪৫০ কোটি ডলার ঋণ চেয়ে চিঠি দিয়েছে অর্থ বিভাগ। অর্থসচিব ফাতিমা ইয়াসমিনের সই করা চিঠিতে ঋণের বিষয়ে আইএমএফকে প্রয়োজনীয় আলোচনা শুরুর অনুরোধ করা হয়।
এ প্রসঙ্গে অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল জানিয়েছেন, আমরা যখন অর্থনীতি ম্যানেজ করি, আমাদের বিভিন্ন পারসপেক্টিভ (পরিপ্রেক্ষিত) দেখতে হয়। আমাদের ঋণ দরকার। আর কিছুদিন দরকার। এরপর ঋণ থাকবে না। আমরা তো বলেছিলাম, ঋণ দেবো।