সিলেটের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের সবচেয়ে বড় প্রকল্প ছিল জাফলং সেতু নির্মাণ। দীর্ঘ প্রতীক্ষার পর সেতুটি পূর্ণাঙ্গরূপ পেলেও মাত্র চার বছরের মাথায় ঝুঁকিতে পড়েছে। যেকোনো মুহূর্তে সেতুটির বড় ধরনের ক্ষতির আশঙ্কা করছেন স্থানীয়রা। সেতুর নিচ থেকে অপরিকল্পিতভাবে বালি ও পাথর উত্তোলনের ফলে দুটি বাদে সব পিলারের ভূগর্ভস্থ অংশের চারপাশ আলগা হয়ে পড়েছে। সেতুর ওপর হালকা যান চলাচলেও মাত্রাতিরিক্ত ঝাঁকুনির সৃষ্টি হচ্ছে। অভিযোগ রয়েছে, রহস্যজনক কারণে পাথর ও বালি উত্তোলনকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে না।
জানা যায়, ভারতের মেঘালয় পাহাড় থেকে বয়ে আসা পিয়াইন নদীর জাফলং খেয়াঘাট এলাকায় এলজিডির তত্ত্বাবধানে প্রায় ২৯ কোটি টাকা ব্যয়ে ৩৬০ মিটার দৈর্ঘ্যের সেতুটি নির্মাণ করা হয়। এর লক্ষ্য ছিল জেলা সদরের সঙ্গে গোয়াইনঘাট উপজেলার পূর্ব জাফলংয়ের সড়ক যোগাযোগ সহজ ও দূরত্ব কমিয়ে আনা।
২০১৩ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে জাফলং সেতু প্রকল্পের ভিত্তিপ্রস্তর উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ২০১৮ সালের ১৪ এপ্রিল বাংলা নববর্ষের প্রথম দিনে যানবাহন চলাচলের জন্য আনুষ্ঠানিকভাবে খুলে দেয়া হয় সেতুটি। ওইদিন সেতুটির উদ্বোধন করেন প্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থানমন্ত্রী ইমরান আহমদ এমপি।
স্থানীয়রা জানান, জাফলং সেতু উদ্বোধনের পর সিলেট সদর উপজেলার সঙ্গে জাফলংয়ের সরাসরি যোগাযোগ স্থাপনের পাশাপাশি উত্তর সিলেটের জৈন্তাপুর-গোয়াইনঘাট-কোম্পানীগঞ্জ উপজেলার যোগাযোগ সহজতর হয়। যোগাযোগ ও পর্যটন সম্ভাবনার উন্নয়ন ব্যবস্থাপনায়ও নতুন সম্ভাবনা দেখা দেয়।
এদিকে জাফলং পাথরকোয়ারি ইসিএভুক্ত এলাকা হওয়ায় বাকু পাথর উত্তোলন বন্ধ করে দেয় সরকার। তবে স্থানীয় প্রভাবশালীদের স্বার্থের কারণে জাফলং সেতুটি ঝুঁকিতে পড়েছে। উপজেলার সংশ্লিষ্ট অসাধু কর্মকর্তা, রাজনৈতিক নেতা, আইন প্রয়োগকারী সংস্থার কতিপয় ব্যক্তির মদদে সেতুর নিচ থেকে বালি পাথর উত্তোলন করছে একটি চক্র। এতে চরম ঝুঁকিতে পড়েছে সেতুটি।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, আওয়ামী লীগ নেতাদের ছত্রছায়ায় স্থানীয় ইমরান হোসেন সুমন নামের এক ব্যক্তি সব পক্ষকে ম্যানেজ করে জাফলং সেতুর নিচ থেকে বালি ও পাথর উত্তোলনকারী চক্রকে নিয়ন্ত্রণ করেন। এছাড়া জাফলং বল্লাঘাট পাথর উত্তোলন ও শ্রমিক বহুমুখী সমবায় সমিতির সভাপতি সিরাজ উদ্দিন, জাফলং ট্রাক ও ট্যাংকলরী শ্রমিক ইউনিয়নের সাংগঠনিক সম্পাদক সোহাগ মিয়ারও নাম রয়েছে ওই চক্রের সঙ্গে।
যদিও ইমরান হোসেন সুমন তার বিরুদ্ধে আনা সব অভিযোগ অস্বীকার করেন। তিনি বলেন, ‘একটি চক্র আমাকে হেয় করার জন্য গণমাধ্যমে মিথ্যা তথ্য দিচ্ছে।’
জাফলং নদী ঘুরে দেখা যায়, বোমা মেশিনসহ বিভিন্ন যন্ত্র দিয়ে বালি ও পাথর উত্তোলন অব্যাহত রাখায় এরই মধ্যে সেতুটির দুটি পিলার ছাড়া সব পিলারের ভূগর্ভস্থ অংশ আলগা হয়ে পড়েছে। বর্তমানে সেতু ওপর দিয়ে যেকোনো ধরনের হালকা যান চলাচল করলে বড় ধরনের ঝাঁকুনির সৃষ্টি হচ্ছে। তাই যেকোনো সময় সেতুটি ভেঙে পড়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে।
স্থানীয়রা জানান, একটি চক্র গত বছরের আগস্ট-সেপ্টেম্বর থেকে ইসিএভুক্ত এলাকা জাফলং, পিয়াইন ও ডাউকী নদীর উৎসমুখ হয়ে জাফলং সেতু পর্যন্ত অবাধে পাথর উত্তোলন করছে।
সেতু দিয়ে চলাচলকারী রহিম উদ্দিন নামের স্থানীয় এক বাসিন্দা বলেন, ‘যারা বালি পাথর উত্তোলন করছে, তারা খুব প্রভাবশালী। প্রশাসনকে ম্যানেজ করেই তারা এ অপকর্ম চালিয়ে যাচ্ছে। এভাবে চলতে থাকলে সেতুটি যেকোনো সময় ভেঙে পড়তে পারে।’
শুয়েব আহমদ নামের আরেক বাসিন্দা বলেন, ‘সেতুটি ক্ষতিগ্রস্ত হলে উত্তর-পূর্ব সিলেটের গোয়াইনঘাটের জাফলংবাসীকে সেই পুরনো খোয়া নৌকার যুগে ফিরে আসতে হবে। এখনই বালি-পাথর উত্তোলনের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে।’
গোয়াইনঘাট উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা তাহমিলুর রহমান জানান, ‘সব জায়গাতেই পাথর উত্তোলন বন্ধ রয়েছে। লুকিয়ে অনেকে পাথর উত্তোলনের চেষ্টা করলে আমরা ব্যবস্থা নিই। জাফলং সেতুর নিচে পাথর উত্তোলনের বিষয়টি আমাদেরও নজরে এসেছে। পাথর ও বালি উত্তোলনের খবর পেলেই পুলিশ পাঠাচ্ছি।’
সড়ক বিভাগ সিলেটের উপ-সহকারী প্রকৌশলী মো. সাইফুল ইসলাম বলেন, ‘নিচ থেকে বালি ও পাথর উত্তোলন করলে সেতুটি অবশ্যই ক্ষতিগ্রস্ত হবে, দুর্বল হয়ে পড়বে। শিগগিরই সরজমিন পরিদর্শন করে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে বিষয়টি অবহিত করব।’
সওজ’র নির্বাহী প্রকৌশলী মো. মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, ‘জাফলং সেতুটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এটি ক্ষতিগ্রস্ত হলে জনসাধারণের দুর্ভোগ বাড়বে। দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের নির্দেশনা দেব, তারা যেন দ্রুত প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেন। সংশ্লিষ্ট অন্যান্য বিভাগকেও ব্যবস্থা নিতে অবহিত করব।’
সূত্র : বণিক বার্তা