মুক্তমনা ব্লগার ও বিজ্ঞান লেখক অনন্ত বিজয় দাশ হত্যার ৯ বছর পরেও সন্তান হত্যাকারীদের মৃত্যুদণ্ড কার্যকরের অপেক্ষায় আছেন তার বৃদ্ধা মা পিযুষ রানী দাশ।
২০১৫ সালের এই দিনে সিলেট নগরীর সুবিদবাজার দস্তিদার দিঘীর পাড়ে প্রকাশ্যে দিবালোকে কুপিয়ে হত্যা করা হয় অনন্ত বিজয় দাশকে।
প্রায় ৪ বছর অপেক্ষার পর ২০১৯ সালে প্রয়াত হন অনন্ত বিজয়ের বাবা রবীন্দ্র কুমার দাশ। তারও তিনবছর পর, ২০২২ সালের ২০ মার্চ রায় হয় অনন্ত হত্যার।
সিলেটের সন্ত্রাস বিরোধী বিশেষ ট্রাইব্যুনালের বিচার নুরুল আমীন বিপ্লব এ হত্যাকাণ্ডের সাথে জড়িত ৪জনের মৃত্যুদণ্ড ঘোষণা করেন এবং একজনকে খালাস দেন।
এ রায়ের পর কেটে গেছে আরও দুই বছর। ট্রাইব্যুনাল থেকে ডেথ রেফারেন্স (মৃত্যুদণ্ডের আদেশ সংক্রান্ত নথিপত্র) উচ্চ আদালতে পৌঁছেছে সময়মতই।
কিন্তু দৈনিক কার্যতালিকার অগ্রগতির ধীরগতির কারণে এই ডেথ রেফারেন্সের শুনানীর সিরিয়াল আসতে আরো কয়েক বছর লাগতে পারে বলে উচ্চ আদালত সূত্রে জানা গেছে।
তাছাড়া খালাসপ্রাপ্ত আসামীর বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষের করা আপীলেরও শুনানীর দিন ধার্য্য হয়নি আজও। ফলে ঠিক কবে ন্যায়বিচার পাবে অনন্তের পরিবার, তা অনিশ্চিত রয়ে গেছে।
তবুও অনন্ত হত্যার ৯ বছরে এসে আশায় বুক বাঁধতে চান অনন্ত বিজয়ের মা, পরিবার, স্বজন, বন্ধু ও শুভাকাঙ্খীরা।
অনন্ত বিজয়ের ভগ্নিপতি অ্যাডভোকেট সমর বিজয় সী বলেন, ‘অনন্তের মা বার্ধ্যক্যজনিত অসুস্থ্যতায় শয্যাশায়ী। এ অবস্থাও তিনি অপেক্ষা করে আছেন অনন্ত হত্যার রায় কার্যকর হতে দেখার জন্য। আমরাও অধীর হয়ে আছি রায় কার্যকরের জন্য।‘
পেশায় ব্যাংকার অনন্ত বিজয় দাশ ‘যুক্তি’ নামের একটি বিজ্ঞানমনস্ত ম্যাগাজিন সম্পাদনা করতেন, বিজ্ঞান ও সমসাময়িক বিষয় নিয়ে লিখতেন মুক্তমনাসহ বিভিন্ন ব্লগে।
২০১৫ সালের ১২ মে সকালে বোনকে সাথে নিয়ে অফিসে যাওয়ার সময় সিলেট নগরীর সুবিদবাজার এলাকার দস্তিদার দিঘীর পাশে ধারালো অস্ত্র দিয়ে তাকে কুপিয়ে হত্যা করে একদল যুবক।
নিষিদ্ধঘোষিত জঙ্গি সংগঠন আনসারুল্লাহ বাংলা টিম (এবিটি) অন্য সকল ব্লগার হত্যার মতো এ হত্যাকাণ্ডেরও দায় স্বীকার করে।
সে রাতেই সিলেটের এয়ারপোর্ট থানায় অজ্ঞাত হামলাকারীদের বিরুদ্ধে হত্যা মামলা দায়ের করেন অনন্ত বিজয় দাশের ভাই রত্নেশ্বর দাশ।
মামলার তদন্তের দায়িত্ব প্রাথমিকভাবে থানা পুলিশের কাছে থাকলেও পরে পুলিশ সদর দপ্তরের নির্দেশের পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) কাছে হস্তান্তর করা হয়।
তদন্ত শেষে মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা সিআইডি’র পরিদর্শক আরমান আলী ২০১৬ সালের ১৮ অক্টোবর আদালতে একটি অভিযোগপত্র দাখিল করলে আদালত পুনরায় তদন্তের নির্দেশ দেন।
এরপর পুনরায় তদন্ত শেষে ২০১৭ সালের ৯ মে সম্পূরক অভিযোগপত্র দিলে আদালত তা গ্রহণ করেন।
এ অভিযোগপত্রে অনন্ত বিজয় দাশ হত্যায় অভিযুক্ত করা হয় শফিউর রহমান ফারাবী, মান্নান ইয়াহইয়া ওরফে মান্নান রাহী, আবুল খায়ের রশীদ আহমেদ, আবুল হোসেন ওরফে আবুল হুসাইন, হারুনুর রশীদ এবং ফয়সল আহমেদকে।
মামলার বিচার প্রাথমিক অবস্থায় কয়েক বছর সিলেটের অতিরিক্ত মহানগর দায়রা জজ আদালতে পরিচালিত হলেও পরে সিলেটে সন্ত্রাসবিরোধী বিশেষ ট্রাইব্যুনাল গঠনের পর ২০২০ সালের শুরুর দিকে মামলাটি এই ট্রাইব্যুনালে স্থানান্তর করা হয়।
২০২২ সালের ৩০ মার্চ সন্ত্রাসবিরোধী ট্রাইব্যুনাল সিলেটের বিচারক নুরুল আমীন বিপ্লব এই হত্যা মামলার রায়ে ৪ জনের মৃত্যুদণ্ডাদেশ ও একজনকে খালাস দেন।
মৃত্যুদণ্ডাদেশপ্রাপ্তরা হলেন সিলেটের কানাইঘাট উপজেলার আবুল হোসেন, উপজেলার খালপাড় তালবাড়ির ফয়সাল আহমদ, সুনামগঞ্জের তাহিরপুরের বিরেন্দ্রনগরের (বাগলী) মামুনুর রশীদ ও কানাইঘাটের ফালজুর গ্রামের আবুল খায়ের রশীদ আহমদ।
এছাড়া বিতর্কিত ব্লগার সাফিউর রহমান ফারাবীকে মামলা থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়। আবুল খায়ের রশীদ আহমদ ছাড়া অপর তিন মৃত্যুদণ্ডাপ্রাপ্ত আসামি পলাতক। অপর আসামী মান্নান রাহী কাশিমপুর কারাগারে অসুস্থ্য হয়ে মৃত্যুবরণ করেন।
হত্যার রায়ে ট্রাইব্যুনাল উল্লেখ করেন, স্বাধীনভাবে মতপ্রকাশের অধিকারকে প্রতিহত এবং লেখনীকে চিরতরে স্তব্ধ করতে বিজ্ঞান লেখক ও ব্লগার অনন্ত বিজয় দাশকে নৃশংস ও বীভৎসভাবে খুন করা হয়েছে। এ হত্যার মধ্য দিয়ে আসামিরা মুক্তবুদ্ধি এবং প্রগতিশীল লেখকদের মধ্যে ভীতি ও শঙ্কা ছড়াতে চেয়েছে।
ট্রাইব্যুনালের পাবলিক প্রসিকিউটর অ্যাডভোকেট মুমিনুর রহমান টিটু বলেন, ‘রায়ের পর ফারাবীর বেকসুর খালাসের বিরুদ্ধে আমরা উচ্চ আদালতে আপীল করেছি। আপীলের শুনানী এখনো হয়নি। এছাড়াও বাকি আসামীদের ডেথ রেফারেন্স উচ্চ আদালতে পৌঁছালেও তার শুনানীরও দিন এখনো ধার্য্য করা হয়নি।‘
আইনানুযায়ী নিম্ন আদালত কোন মৃত্যুদণ্ডাদেশ দিলে ডেথ রেফারেন্স উচ্চ আদালতে প্রেরণ করতে হয়। সেখানে আদেশের উপর শুনানী শেষে উচ্চ আদালত মৃত্যুদণ্ডের অনুমতি দেন। এক্ষেত্রে নিম্ন আদালতের রায় প্রদানের তারিখ অনুযায়ী সিরিয়াল অনুযায়ী শুনানীর দিন ধার্য্য করা হয়।
কেবলমাত্র সরকারের অনুরোধে অথবা প্রধান বিচারপতির ইচ্ছায় ডেথ রেফারেন্সের শুনানীর দিন সামনে আনার সুযোগ থাকে। বর্তমানে উচ্চ আদালতে প্রায় চার বা তারও আগের ডেথ রেফারেন্সের শুনানী চলছে বলে জানা গেছে।
অনন্ত বিজয়ের বন্ধু ও গণজাগরণ মঞ্চ সিলেটের মুখপাত্র দেবাশীষ দেবু বলেন, ‘এ হত্যাকাণ্ডটি কোন সাধারণ হত্যার ঘটনা নয় বরং মুক্তচিন্তার স্বাধীনতাকে বাধাগ্রস্থ করতে জঙ্গিগোষ্ঠীর একটি হামলার উদাহরণ যার মধ্য দিয়ে এদেশে জঙ্গিবাদ বিকাশ লাভ করে।‘
তিনি বলেন, ‘জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে সরকারের শক্ত অবস্থানকে প্রমাণ করতে এই হত্যা মামলার রায় বিশেষ গুরুত্বসহকারে দ্রুত কার্যকর করা খুবই জরুরি। আমরা অনন্ত হত্যার রায় দ্রুত কার্যকরের উদ্যোগ নেয়ার দাবি জানাচ্ছি।‘