ভালবাসা পরিমাপের কোন মাপকাঠি বা স্কেল আমাদের হাতে নেই। তারপরও বিভিন্ন দিক পর্যালোচনা করে একথা বলাই যায় যে মানুষ বোধহয় সবচেয়ে বেশি ভালবাসে তার সন্তানকে। সন্তানের প্রতি বাবা-মার ভালবাসা নিয়ে লেখা হয়েছে নানান কবিতা, উপন্যাস, গল্প কিংবা তৈরি হয়েছে চলচ্চিত্র।
পৃথিবীর সবচেয়ে আস্থার সম্পর্ক হচ্ছে সন্তানের সাথে পিতামাতার সম্পর্ক। কারো জন্যে মনে ভালবাসা থাকলে স্বভাবতই মনে ভয় যেমন কাজ করে এবং একইভাবে তার কিছু হয়েছে এটা বিশ্বাস করতেও কষ্ট হয়। ছোট ছোট মায়াবী সুন্দর নিস্পাপ বাচ্চাদের বাবা-মায়েরা প্রায়ই তাদের নিস্প্রভ ছলছল চোখ নিয়ে চিকিৎসকদের শরণাপন্ন হচ্ছেন আর জানতে চাচ্ছেন অটিজম সম্পর্কে। বাচ্চা অসুস্থ কিন্তু স্বল্পমেয়াদী ঔষধ প্রয়োগে পুরোপুরি সুস্থ্য হয়ে যাবে বা সুস্থ্যতার আশা আছে এটি বাবা-মার কাছে সহনীয় পর্যায়ের চিন্তা আর অন্যদিকে বাচ্চা তার স্বাভাবিক জীবন থেকে দূরে চলে গিয়েছে কিংবা দীর্ঘস্থায়ী বিকাশজনিত রোগে ভুগছে এটি মেনে নেওয়া, গ্রহন করা কিংবা মানিয়ে নেওয়া বাবা-মার জন্যে অনেক কষ্টদায়ক।
অটিজম শিশুদের মস্তিষ্কের বিকাশজনিত সমস্যা যা সাধারণত তিনবছর বয়সের আগেই দেখা যায়। অটিজম রোগটির সাথে অতি চঞ্চলতা, বুদ্ধি প্রতিবন্ধী, শিক্ষার সমস্যা, খিচুনি রোগ, কিছু জন্মগত বংশগতির রোগ, হজমের সমস্যা, রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যাওয়া, উদ্বিগ্নতা, ভয়জনিত সমস্যা, বিভিন্ন ইন্দ্রিয় অক্ষমতা, মাংসপেশীর কাজের অক্ষমতা, সমন্বয়ের সমস্যা কিংবা ঘুমের সমস্যা থাকতে পারে।
আমাদের সমাজে বিদ্যমান নানান কুসংস্কার এবং ভ্রান্ত বিশ্বাস বিদ্যমান অটিজম রোগ নিয়ে। অনেক সময়ই যা এ রোগের চিকিৎসায় প্রতিবন্ধকতা তৈরি করে। অটিজমের কারণ খুব জটিল এবং মিশ্র প্রকৃতির। বংশগতির প্রভাব, মস্তিষ্কের নানান রাসায়নিক পদার্থের অসংগতি এবং গঠনগত পরিবর্তন এ রোগের জন্যে দায়ী। সাধারণত নির্ধারিত সময়ের পূর্বে বাচ্চা জন্মগ্রহণ করলে মানে প্রিম্যাচ্যুর বাচ্চা জন্ম নিলে, মায়ের গর্ভকালীন সমস্যা থাকলে, জন্মের সময় বাচ্চা মাথায় আঘাত পেলে, জন্মের পর বাচ্চার অক্সিজেন স্বল্পতা হলে, মায়ের বিভিন্ন ভাইরাসজনিত রোগ বাচ্চা ধারনের সময় থাকলে, মা যদি মাদকাসক্ত হয়, পিতা মাতার বয়স বেশি হলে, মায়ের বহুমূত্র রোগ থাকলে কিংবা গর্ভকালীন রক্তপাত থাকলে বাচ্চার অটিজমের সম্ভাবনা থাকে। এ সকল ব্যাপারে এখনো গবেষণা চলছে।
প্রাথমিক পর্যায়ে কিছু বিষয় লক্ষ্য করুন অটিজম সনাক্তকরণে :
- চোখে চোখ না রাখা। চোখের দিকে না তাকিয়ে অঙ্গভঙ্গি প্রকাশ করতে চাওয়া।
- অদ্ভুত বা সাদৃশ্যহীন মুখভঙ্গি করা যা তার কাজের সাথে যায় না।
- শারীরিক বাচনভঙ্গি অভাব বা শারিরীক ভাষায় কোন কিছু প্রকাশ করতে না পারা।
- সঠিক সময়ে কথা বলতে না পারা বা কথা বলতে বিলম্ব হওয়া। কথা বললেও একই কথা বা শব্দ বারবার বলা এবং অতিরিক্তভাবে অপ্রয়োজনীয়ভাবে বলা।
- স্বাভাবিক শব্দ, গন্ধ বা দৃষ্টিকে উপেক্ষা করা। সামাজিক আবেগ, ভাবাবেগ আদান প্রদানে ব্যর্থ হওয়া।
- একই কাজ বারবার করা এবং দৃষ্টি আকর্ষণের জন্যে শ্রুতিকটু শব্দ ব্যবহার করা। বারবার অতিরিক্ত হাততালি দেওয়া, শরীর মোচড়ানো, পায়ের পাতার উপর ভর করে হাঁটা বা হাঁটার চেষ্টা, মাথায় বারবার ব্যাথা পাওয়া সত্ত্বেও আঘাত দেওয়ার প্রচেষ্টা, নিজের শরীরে চিমটি কাটা বা সারাদিন আঙুল কামড়ানো।
- বাই-বাই, টা-টা না বলা এবং হাত না তোলা। যা শোনে তা নকল করে না এবং অন্যদের মুখের ভাব শিখে না।
অন্য শিশুর সাথে খেলে না, ভাব বিনিময় করে না মানে সামাজিক সম্পর্ক স্থাপন করে না।
সবার অটিজম একইরকম নয় এবং মাত্রাও একই নয়। পারিপার্শ্বিক পরিবেশ এবং অন্য রোগের মিথস্ক্রিয়ায় অটিজমের তার বহিঃপ্রকাশ এবং মাত্রা ভিন্নতা পায়। এক্ষেত্রে সঠিক তথ্য, চিকিৎসা,পরামর্শ এবং প্রশিক্ষণ প্রয়োজন। দরকার বিভিন্ন থেরাপি, ব্যায়াম এবং প্রয়োজন হলে ঔষধ। এক্ষেত্রে শিশুর যত্নের সাথে সাথে নেতিবাচক মনোভাব, শিশুর সবকিছুতে বিরোধিতা, অতিরিক্ত কঠোরতা এবং শারীরিক আঘাত পরিহার করতে হবে। আমাদের আগামীর বিজ্ঞানমনস্ক, আধুনিক মানবিক সুস্থ্য জাতির জন্যে অটিজম বিষয়ে জানা প্রয়োজন এবং সাইকিয়াট্রিস্টদের পরামর্শে পরবর্তী পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন।
ডা. মোহাম্মদ হাসান
চিকিৎসক ও বিজ্ঞান লেখক।
মনোরোগ বিদ্যা বিভাগ, সিলেট এম এ জি ওসমানী মেডিকেল কলেজ।