বাংলাদেশের সামাজিক প্রেক্ষাপট দলীয় রাজনীতির আবহে এতোটাই চৌম্বকীয় মেরুকরণ হয়েছে যে, আজকাল আওয়ামী-বিএনপি পরিবারগুলোর মধ্যে বিয়ে শাদীর সূত্রে আত্মীয়তাও হয় না। সামাজিক অনুষ্ঠান জন্মদিন, আকিকা, বিবাহ বার্ষিকী, মৃত্যুর বার্ষিকীর মত অনুষ্ঠানে একদল আরেক দলকে নিমন্ত্রণ করে না। কিংবা নিমন্ত্রণ করলেও এই অনুষ্ঠানগুলিতে উভয় পক্ষের উপস্থিতি খুব কমই থাকে।
অতীতে আমরা দেখেছি বিয়েশাদী বা বিভিন্ন পারিবারিক অনুষ্ঠানে দলের শীর্ষস্থানীয় নেতারা উপস্থিত থাকতেন, এমনকি উভয় দলের বিভিন্ন দলীয় সমাবেশে ভিন্ন দলের নেতাদের আমন্ত্রণ জানানো হতো, তারা সেইসব সমাবেশে সম্মানের সহিত আসন গ্রহণ করে বক্তৃতাও দিতেন। ক্ষমতার দ্বন্ধে এই দুই দলের সে রাজনৈতিক সৌহার্দ্য, সৌজন্যতা, ভ্রাতৃত্ববোধ বহু আগেই হারিয়েছে।
আওয়ামী রাজনীতি ঘনিষ্ঠ এমনই একটি বিয়ের অনুষ্ঠানে গত মাসে উপস্থিত ছিলাম। রাজনৈতিক পরিবার, খাবার টেবিলে বসে রাজনীতি নিয়ে আলাপ হবে না তা তো হয় না। সাম্প্রতিক বিষয়টি নিয়ে আলোচনা যখন তুঙ্গে, তখন অপ্রাসঙ্গিক ভাবে বলে ফেললাম, দীর্ঘ সময় ধরে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকার ফলে সারা দেশ জুড়ে যে পরিমাণ অতি আওয়ামীকরণ করা হয়েছে তা খোদ আওয়ামী লীগেরই ক্ষতি এবং রাজনৈতিক নেতাকর্মী তৈরি হওয়ার বদলে সুবিধাবাদী চোর বাটপারে দল ভরে গেছে। বিরোধী দলে গেলে এদের কাউকে খুঁজে পাওয়া যাবে না এবং মাঠ পর্যায়ে বড় ধরণের নেতৃত্ব শূণ্যতার সৃষ্টি হবে।
টেবিলে বসা নেতারা কেউই আওয়ামী লীগ যে আবার বিরোধীদলে যেতে পারে এ নিয়ে ভাবতে বিন্দুমাত্র আগ্রহী নন। কারও কারও মনোভাব এও দেখলাম যে, যেভাবেই হোক, যে কোন উপায়ে হোক ক্ষমতায় থাকাই লাগবে। আওয়ামী নেতাকর্মীদের অনেকের মধ্যে এই ধরনের মনোভাব প্রায়ই পরিলক্ষিত হচ্ছে। ক্ষমতায় থাকার পেছনে চলমান উন্নয়নের যুক্তি তো আছেই, আছে গণতন্ত্র নামে চির পরিচিত এন্টি-আওয়ামীদের উত্থানের ভীতি। নেতাদের ভাষ্যমতে যেদিন বিএনপি ক্ষমতায় আসবে, সেদিন দেশে রক্ত গঙ্গা বইবে। লাখ লাখ আওয়ামী নেতা কর্মীদের হত্যা করা হবে। পুনরায় ২১শে অগাস্ট ঘটিয়ে আওয়ামী লীগকে শেকড়ে নিশ্চিহ্ন করার চেষ্টা করা হবে।
“ক্ষমতা অথবা মৃত্যুর” এই চরম সিদ্ধান্ত আমায় ভাবিয়েছে ভীষণ। আওয়ামী লীগের মত ঐতিহ্যবাহী দল, যার অধিকাংশ ইতিহাসই রাজপথে আন্দোলন সংগ্রামের, সেই আওয়ামী লীগের জন্য এই আচরণ বড়ই বেমানান। কিন্তু কেন এই ধরণের আপাতদৃষ্টিতে স্বৈরাচারী মনোভাব!!
বিষয়টি নিয়ে পরবর্তী সময়ে আমি অনে ভেবেছি, ২১শে অগাস্ট এবং পরবর্তী ঘটনাক্রম বিশ্লেষণ করার চেষ্টা করেছি। বিএনপির শীর্ষ নেতাদের সাথে জঙ্গি নেতাদের বৈঠক, পরিকল্পনার প্রমাণিত চ্যাপ্টার যদি এক পাশেও রাখি, তারপরও জজ মিয়া কাণ্ড এবং ২১শে অগাস্টের হামলার আলামত নষ্ট করা, বিএনপি শীর্ষ নেতাদের আক্রোশমূলক বক্তব্য, সংসদে ২১শে অগাস্ট গ্রেনেড হামলা নিয়ে হাস্যরস, তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী খোদ খালেদা জিয়ার নির্দেশে গোয়েন্দা মহাপরিচালকের মামলা ও তদন্তে ইচ্ছামত কাটাছেঁড়া, তদন্ত কর্মকর্তা পরিবর্তন করে নিজেদের আজ্ঞাবহ তদন্ত কর্মকর্তা নিয়োগ… এসবই বাংলাদেশের রাজনীতিতে একটি বিরাট প্রশ্নবোধক চিহ্ন হয়ে আছে, যদি আগামীতে কখনো ক্ষমতার স্বাদ পায় বিএনপি, তাহলে ২১শে অগাস্টের অবিস্ফোরিত গ্রেনেডটি কেন বিস্ফোরিত হল না, কেন শেখ হাসিনা বেঁচে ফিরলেন… তা নিয়েও তারা তদন্ত করতে পারে।
বিএনপি এবং আওয়ামী লীগ উভয় দলই ক্ষমতায় আরোহণের জন্য রাজনীতি করে। একদল একবার ক্ষমতায় যাবে, ভিন্ন দল বিরোধী দলে থেকে সরকারের গঠনমূলক সমালোচনা করবে, বাংলাদেশের রাজনীতি থেকে গণতন্ত্রের এই মহান চর্চা, শিষ্টাচার যেন চির বিদায় নিয়েছে। ক্ষমতাসীন দল বিরোধী দলকে দমন, নিপীড়নই যেন প্রতিপক্ষকে ঘায়েলের প্রধান অস্ত্র হিসেবে নিয়েছে। এবং ২০০৪ সালের ২১শে অগাস্ট সেই দমন নিপীড়নের সকল অতীত ইতিহাসকে ছাড়িয়ে গিয়েছে। রাজপথের শ্লোগান ধরা দু-চারজন নেতাকর্মীকে জেল জুলুম করে বিরোধীদলকে দমানো যাবে না, আঘাত আনতে হবে একদম টার্গেটে… নিশ্চিহ্ন করে দিতে হবে হাই কমান্ড। এ যেন আরেকটি ১৫ই অগাস্টের ব্লু-প্রিন্ট, এরই ধারাবাহিকতা।
২১ শে অগাস্টের হামলা, হত্যাকাণ্ড সাথে আরও বড় ধরনের যে ক্ষতি হয়ে বাংলাদেশের রাজনীতিতে তা হল “অবিশ্বাস” আর “ঘৃণা”র জন্ম। এজন্যই হয়তো তারেক রহমান লন্ডনে বসে বার বার বলছেন, “আমরা ক্ষমতায় এলে আর কোন প্রতিহিংসার রাজনীতিতে যাবো না”। তিনি ক্ষমতায় এলে প্রতিহিংসার রাজনীতির চর্চা করবেন কি করবেন না সে সম্পর্কে আমি আগাম কোন ধারনা বা নিশ্চয়তা দিতে পারি না। কারণ ক্ষমতা বড় অদ্ভুত অনুভূতি, যা আপাদমস্তক সুস্থ মানুষকে উন্মাদে পরিণত করে। আর ২১ শে অগাস্টের তদন্তে তারেক রহমানের সরাসরি যে ধরনের সংশ্লিষ্টতা বেরিয়ে এসেছে, এরপর আওয়ামী লীগ ওনাকে আর বিশ্বাস করবে বাংলাদেশের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে প্রায় অসম্ভব একটি ব্যাপার।
“ক্ষমতায় অবস্থান অথবা মৃত্যু” ঐতিহ্যবাহী দল হিসেবে আওয়ামীলীগের স্ববিরোধী এই নীতি নিতে প্রায় বাধ্য করেছে রাজনৈতিক প্রতিহিংসা আর বিদ্বেষ যা বাংলাদেশের রাজনীতির ভবিষ্যতকে এক অনিশ্চিত কঠিন গন্তব্যে নিয়ে যাচ্ছে।
গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় দেশের উন্নয়নের প্রশ্নে সকল রাজনৈতিক দল ঐক্যবদ্ধ থাকবে, সরকারি দল রাষ্ট্র পরিচালনার পাশাপাশি উন্নয়ন এবং জনসেবায় মনযোগী হবে আর বিরোধীদল গঠনমূলক সমালোচনায় অবস্থান নেবে সংসদ বা রাজপথে, এই যে রাজনৈতিক সৌহার্দ্য, সম্প্রীতি, আর শিষ্টাচারের চর্চা এই দেশে কবে ফিরবে তা পুরোপুরি অনিশ্চিত। আর এই রাজনৈতিক সৌহার্দ্য, সম্প্রীতি, আর শিষ্টাচারের কফিনে শেষ পেরেক ছিল ২০০৪ সালের ২১শে অগাস্ট!
কলামিস্ট এবং সাবেক ছাত্রনেতা চিররঞ্জন সরকারের লিখা একটি প্রাচীন গল্প দিয়ে শেষ করি আজকের কলাম… কোন এক পাড়াগাঁয়ে ছেলেকে নিয়ে এক বাবা থাকতেন। বাড়ির পাশে একটি গর্তের মধ্যে একটি সাপও থাকত। একদিন লোকটির ছেলেকে ওই সাপটি কামড়াল। ফলে ছেলেটি মারা গেল। ছেলেটির বাবা তখন রাগের বশে একটি কুড়াল হাতে বসল সেই সাপের গর্তের ধারে। বেরুলেই সাপটাকে খতম করে দেবে। কিছুক্ষণ সেখানে অপেক্ষা করার পর লোকটি দেখতে পেল সাপটা মাথা বের করছে। লোকটি অমনি জোরে একটা কোপ মারল। কিন্তু কোপটা সাপের মাথায় না লেগে লাগল একটা পাথরের ওপর। আর পাথরটা গেল ফেটে। এবার লোকটি মনে মনে একটু ভয় পেয়ে গেল। সে সাপটাকে মারতে গিয়েছিল, কিন্তু সাপ মরেনি। ফলে সাপটি নিশ্চয়ই তার ওপর রেগে রয়েছে। যেকোনো সময় সাপটি তাকেও কামড়াতে পারে। এসব ভেবে লোকটি সাপের সঙ্গে ভাব করতে গেল। বুদ্ধিমান সাপ তাতে রাজি হলো না। সে বলল, আমাদের দু’জনের ভাব হওয়া অসম্ভব। পাথরের ওই ফাটা জায়গাটা দেখলেই আমার মনে পড়বে তুমি আমায় কী করতে চেয়েছিলে? আর তোমার ছেলের কবরের দিকে নজর পড়লেই তোমার মনে পড়বে আমি তোমার কী করেছি। এমন দু’জনের কি ভাব হতে পারে?
আওয়ামী লীগ ও বিএনপির মধ্যে সব বিরোধ মিটিয়ে গনতান্ত্রিক শিষ্টাচারের রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন দেখা আমি ২১শে আগস্টের অমোচনীয় ‘ক্ষত’ সারাবো কিভাবে!?
লেখকঃ কলামিস্ট, সাহিত্যিক, জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ।