রাষ্ট্রপতি মো. আব্দুল হামিদ বলেছেন, প্রয়াত স্পিকার হুমায়ুন রশীদ চৌধুরী ছিলেন সততা ও সাহসের মূর্ত প্রতীক, নিখাঁদ দেশপ্রেমিক। একজন আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন বরেণ্য কূটনীতিবিদের পাশাপাশি তিনি ছিলেন এক আদর্শ ও আধুনিক মতবাদের অনুসারী ও প্রবক্তা।
শনিবার (১৭ ডিসেম্বর) বিকেলে ‘স্পিকার হুমায়ুন রশীদ চৌধুরী স্মৃতি পরিষদ’র উদ্যোগে সিলেটের জালালাবাদ গ্যাস ভবনে প্রয়াত স্পিকার হুমায়ুন রশীদ চৌধুরীর ৯৪তম জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে আয়োজিত আলোচনা সভায় ভার্চুয়ালি যুক্ত হয়ে তাঁর সম্পর্কে এমন মন্তব্য করেন রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ।
রাষ্ট্রপতি বলেন, ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট জাতির পিতাকে স্ব পরিবারে হত্যাকাণ্ডের পর শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানাকে সুরক্ষিত রাখেন সাবেক স্পিকার হুমায়ুন রশিদ চৌধুরী। জাতীয় রাজনীতি, কূটনীতি এবং দেশের উন্নয়নে মরহুম হুমায়ুন রশীদ চৌধুরীর অবদান ও স্মৃতি জাতির কাছে চিরভাস্বর হয়ে থাকবে।
হুমায়ুন রশীদ চৌধুরীর কর্মময় জীবনকে নতুন প্রজন্মের মাঝে ছড়িয়ে দিতে এবং তাঁর আদর্শকে ধারণ করার আহ্বান জানান তিনি।
‘স্পীকার হুমায়ুন রশীদ চৌধুরী স্মৃতি পরিষদ’র সভাপতি, প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব ও ক্যাপিটাল মার্কেট স্ট্যাবিলাইজেশন ফান্ডের চেয়ারম্যান মো. নজিবুর রহমানের সভাপতিত্বে আলোচনা সভায় স্বাগত বক্তব্য রাখেন সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক, শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. এহছানে এলাহী।
বিশেষ অতিথি হিসেবে বক্তব্য রাখেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেন এমপি। মুখ্য আলোচক হিসেবে বক্তব্য প্রদান করেন বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা মণ্ডলীর সদস্য ইনাম আহমদ চৌধুরী।
‘স্পীকার হুমায়ন রশীদ চৌধুরী স্মৃতি পরিষদ’র অন্যতম নেতা শামসুল ইসলামের সঞ্চালনায় আরও বক্তব্য রাখেন, সিলেট-৩ আসনের এমপি হাবিবুর রহমান হাবিব, জেবা রশীদ চৌধুরী, সিলেট রেঞ্জের ডিআইজি মফিজ উদ্দিন আহমেদ, সিলেটের পুলিশ কমিশনার, সিলেট জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ও সিলেট জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এডভোকেট নাসির উদ্দিন খান, সিলেট মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি বীর মুক্তিযোদ্ধা মাসুক উদ্দিন আহমদ, ‘স্পীকার হুমায়ুন রশীদ চৌধুরী স্মৃতি পরিষদের সিলেট শাখার আহ্বায়ক ও সিলেট মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক জাকির হোসেন, সংগঠনের সহ সভাপতি ও প্রয়াত হুমায়ুন রশীদ চৌধুরীর পৌত্র মাহসুন নোমান রশীদ চৌধুরী, সংগঠনের সিলেট শাখার যুগ্ম আহ্বায়ক ও সিলেট চেম্বার অব কমার্স এন্ড ইন্ডাস্ট্রির সিনিয়র সহ-সভাপতি ফালাহ উদ্দিন আলী আহমদ প্রমুখ।
এছাড়া উপস্থিত ছিলেন বিটাকের মহাপরিচালক আনোয়ার হোসেন চৌধুরী (অতিরিক্ত সচিব), স্পীকার হুমায়ুন রশীদ চৌধুরী স্মৃতি পরিষদের সাংগঠনিক সম্পাদক মো. আখলাকুল আম্বিয়া, পরিষদের অর্থ বিষয়ক সম্পাদক জাফর রাজা চৌধুরী, মিসেস দুরদানা দিলিয়া, এইচআরসিএমসি’র সিলেট শাখার সদস্য সচিব মাহবুবুল হাফিজ চৌধুরী মুশফিক, আজীবন সদস্য কাজী মোস্তাফিজুর রহমান, মনজুর আহমদ চৌধুরী, দৈনিক স্বাধীন বাংলার নির্বাহী সম্পাদক মো. মাহবুবুল আম্বিয়া, ফজলে এলাহী সহ বিভিন্ন শ্রেণিপেশার মানুষ।
আলোচনা সভায় বক্তারা প্রয়াত স্পিকার হুমায়ুন রশীদ চৌধুরীর স্মৃতিচারণ করে বলেন, ন্যায়নিষ্ঠা ও সততার অনন্য নজির ছিলেন হুমায়ুন রশীদ চৌধুরী। হুমায়ুন রশীদ চৌধুরী শুধু সিলেটের নয়, পুরো দেশের গর্ব। দেশের প্রতি তাঁর ছিল অসাধারণ ভালোবাসা। তিনি নিজের ক্যারিয়ারের কথা চিন্তা না করে ৭১ সালে যেভাবে মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন, ঠিক তেমনি পঁচাত্তরের ১৫ আগস্টের নির্মম হত্যাকাণ্ডের পর বঙ্গবন্ধুর দুই কন্যার জীবন বাঁচাতে তিনি বজ্রকঠিন ভূমিকা রেখেছিলেন। সিলেটের উন্নয়ন অগ্রযাত্রার প্রতিও তিনি বিশেষ নজর রাখতেন। অসংখ্য উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ডের মধ্যে সিলেটে ‘শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়’ তাঁরই অবদানের স্মারক বহন করছে।
উল্ল্যেখ, মরহুম স্পিকার হুমায়ুন রশীদ চৌধুরী ছিলেন একাধারে কূটনীতিক, আমলা ও রাজনীতিক। তিনি ১৯৫৩ সালে পাকিস্তান ফরেন সার্ভিসে যোগদান করেন। কূটনীতিক হিসেবে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে দায়িত্বপালনের ধারাবাহিকতায় ১৯৭১-৭২ সালে দিল্লীতে বাংলাদেশ মিশনের প্রধানের দায়িত্ব পালন করেন। একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে তিনি অসীম সাহসিকতা দেখিয়ে পাকিস্তানের পক্ষ ত্যাগ করে বাংলাদেশের পক্ষে জনমত গঠন এবং স্বীকৃতি আদায়ে ৪০টির বেশি দেশের সাথে যোগাযোগ স্থাপন করে অন্তত ৩৪টি দেশের স্বীকৃতি আদায়ে সক্ষম হয়েছিলেন। বাংলাদেশি হিসেবে একমাত্র তিনিই জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের ৪১তম অধিবেশনে সভাপতিত্ব করার গৌরব অর্জন করেছিলেন। তিনি যুক্তরাষ্ট্রের ভার্জিনিয়া অঙ্গরাজ্যের ‘কলেজ অব উইলিয়াম এন্ড মেরি’ থেকে ১৯৮৪ সালে ‘মাহাত্মা গান্ধী শান্তি পুরস্কার’ লাভ করেন। ২০১৮ সালে বাংলাদেশ সরকার তাকে মরণোত্তর ‘স্বাধীনতা পুরস্কার’ প্রদান করে।
তিনি ১৯৭২ সালে জার্মানীতে বাংলাদেশের প্রথম রাষ্ট্রদূত হিসেবে দায়িত্বপ্রাপ্ত হন। এছাড়া সুইজারল্যান্ড, অস্ট্রিয়া এবং ভ্যাটিকানেও একই পদে অধিষ্টিত ছিলেন। তিনি আন্তর্জাতিক পরমাণু শক্তিসংস্থা (IAEA) এবং জাতিসংঘের (UNIDO) শিল্পাঞ্চল উন্নয়ন সংস্থার প্রথম স্থায়ী প্রতিনিধির দায়িত্ব পালন করেন।
সিলেটের উন্নয়নে তিনি ছিলেন এক নিবেদিতপ্রাণ। জীবদ্দশায় তিনি সিলেটের রাস্তাঘাট, ব্রীজ-কালভার্ট ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের উন্নয়নে ব্যাপক অবদান রেখেছেন। সিলেট শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা এবং দৃষ্টিনন্দন সিলেট রেলওয়ে স্টেশন নির্মাণে তার অবদানের কথা সিলেটবাসী এখনও শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করে।
৭৫ এর ১৫ আগস্ট নৃশংসভাবে স্বপরিবারে বঙ্গবন্ধু হত্যাকান্ডের সময় সৌভাগ্যক্রমে প্রাণে বেঁচে যাওয়া আশ্রয়হীন বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও তার বোন শেখ রেহানাকে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে নিজ বাসায় আশ্রয় দিয়েছিলেন হুমায়ুন রশীদ চৌধুরী।
১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতা গ্রহণ করলে জাতীয় সংসদের স্পিকার মনোনীত হন হুমায়ুন রশীদ চৌধুরী এবং ২০০১ সালের ১০ জুলাই স্পিকার থাকাকালীন মৃত্যুবরণ করেন। হযরত শাহজালাল (র.) এর মাজার প্রাঙ্গণে তিনি চিরনিদ্রায় শায়িত আছেন।
মরহুম স্পিকার হুমায়ুন রশীদ চৌধুরী ১৯২৮ সালের ১১ নভেম্বর সিলেট শহরের দরগা গেইটস্থ রশিদ মঞ্জিলে জন্মগ্রহণ করেন।