কথিত হিজরতের উদ্দেশ্যে বাসা থেকে বের হয়ে আত্মগোপনে চলে যায় দেশের বিভিন্ন স্থানে নিখোঁজ বেশকিছু কিশোর ও তরুণ। তাদের একটি তালিকাও প্রকাশ করে র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র্যাব)। তবে সেই তালিকায় থাকা কিশোর ও তরুণদের অনেককেই এখনও গ্রেফতার করতে পারেনি সংস্থাটি। তাদের কোনও খবরও পায়া যাচ্ছে না। র্যাব বলছে, তাদের অবস্থান শনাক্ত করতে এবং গ্রেফতারের বিষয়ে পাহাড়ি এলাকাসহ বিভিন্ন জায়গায় অভিযান পরিচালনা করা হচ্ছে।
সম্প্রতি নতুন জঙ্গি সংগঠন ‘জামাতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্বীয়া’ এর মতাদর্শের ২৬ সদস্যকে গ্রেফতার করার পর র্যাব আরও জানিয়েছে, আত্মগোপনে যাওয়া তরুণ ও কিশোররা অনেকেই সামরিক কলাকৌশল ও অস্ত্রসহ নানা ধরনের প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেছে বলে র্যাবের তদন্তে উঠে এসেছে। তারা যেকোনও সময় হামলা চালাতে পারে, এমন শঙ্কার কথাও বলছেন কর্মকর্তারা।
র্যাবের দাবি, হরকাতুল জিহাদ, জেএমবি এবং আনসার আল ইসলামের বেশ কিছু সদস্য ২০১৭ সালে নতুন এই উগ্রবাদী সংগঠনের কার্যক্রম পরিচালনা করে আসছিল। তবে ২০১৯ সাল থেকে পুরোদমে কর্মকাণ্ড শুরু করে সংগঠনটি। যদিও কার্যক্রম পরিচালনার তিন বছর পর এই সংগঠনটির বিষয়ে জানতে পারে পুলিশের এই এলিট বাহিনী। নতুন এই জঙ্গি সংগঠনের অর্থের যোগানদাতা কিংবা ডোনার কারা এ বিষয়টিও খতিয়ে দেখা হচ্ছে। সংগঠনের পেছনে কারা রয়েছে সেসব বিষয় তদন্ত করতে গিয়ে সংস্থাটি জানতে পেরেছে, উগ্রবাদী এই সংগঠনটির দাওয়াতি শাখায় বেশ কয়েকজন নারী সদস্যও রয়েছে। যদিও প্রাথমিকভাবে ছয় নারীর সম্পৃক্ততা পাওয়া গেছে, তবে এর সংখ্যা আরও বেশি বলে ধারণা করছেন অভিযান সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা।
সম্প্রতি র্যাব এর পক্ষ থেকে গণমাধ্যমের কাছে ৫৫ জন নিখোঁজ তরুণের তালিকা দেওয়া হয়। এরমধ্যে নতুন জঙ্গি সংগঠনের সঙ্গে সম্পৃক্ততার অভিযোগে বেশ কয়েকজনকে গ্রেফতার করা হলেও তালিকার থাকা নিখোঁজ তরুণদের কাউকেই উদ্ধার করা সম্ভব হয়নি। র্যাব বলছে, আত্মগোপনে থাকা ৫০ এরও বেশি কিশোর ও তরুণ বান্দরবান এলাকায় জঙ্গি প্রশিক্ষণ নিয়েছে। তারা এখন পার্বত্য চট্টগ্রাম এলাকায় অবস্থান করছে, নাকি বের হয়ে এসেছে এ বিষয়টি এখনও অজানা। তবে খোঁজখবর নেওয়া হচ্ছে। পার্বত্য চট্টগ্রাম এলাকার যে জায়গায় তারা প্রশিক্ষণ নিচ্ছিলো, সেই রোয়ানছড়িসহ ও রুমাসহ বিভিন্ন এলাকাগুলো অত্যন্ত গহীন বনাঞ্চল। এসব জায়গায় তাদের অবস্থান শনাক্ত করা অনেক কষ্টসাধ্য। এছাড়া সেখান থেকে বিভিন্ন ছদ্মবেশে বের হয়ে আসাটাও অনেকটাই সহজ।
তিন ধরনের ডোনার
এদিকে র্যাব জানিয়েছে, নতুন জঙ্গি সংগঠনটিতে অর্থ যোগানদাতা কিংবা ডোনারদের বিষয়ে বেশ কিছু তথ্য পেয়েছে তারা। এ সংগঠনে তিন ধরনের ডোনার রয়েছে। যারা বিভিন্ন সময় বিভিন্নভাবে বিভিন্ন পরিমাণ টাকা সংগঠনের বিভিন্ন সদস্যদের কাছে পাঠাচ্ছে। আর এসব টাকা মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে পাঠানো হচ্ছে বলে প্রাথমিকভাবে জানা গেছে। ডোনার শাখা ‘ক’তে যারা ডোনার হিসেবে রয়েছে, তারা প্রতি মাসে ১০ হাজার থেকে এক লাখ টাকা দিচ্ছে। ‘খ’তে যারা তারা প্রতি মাসে তিন হাজার থেকে ১০ হাজার টাকা দিচ্ছে। আর ‘গ’ ভুক্তরা প্রতি মাসে এক হাজার থেকে তিন হাজার টাকা দিয়ে যাচ্ছে।
তথ্য পেলে জানানোর পরামর্শ
কথিত হিজরতের উদ্দেশ্যে বাড়ি থেকে বেরিয়ে যাওয়ার পেছনে এরইমধ্যে চিকিৎসকসহ অনেকের সম্পৃক্ততার বিষয়টি জেনেছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। তাদের কাছ থেকে পাওয়া তথ্যের ভিত্তিতে দেশের বিভিন্ন জায়গায় আত্মগোপনে কিংবা কথিত হিজরতের উদ্দেশ্যে ঘর ছেড়ে যাওয়াদের শনাক্ত করতে মাঠে রয়েছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা। তালিকায় থাকা কিশোর এবং তরুণদের পরিবারের সঙ্গেও প্রতিনিয়ত যোগাযোগ রাখা হচ্ছে। কোনও ধরনের তথ্য পেলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে জানানোর পরামর্শ দেওয়া হয়েছে।
আইনশৃঙ্খলা বাহিনী বলছে, যেহেতু নতুন এই জঙ্গি সংগঠনটি এর আগে নিষিদ্ধ বেশ কয়েকটি জঙ্গি সংগঠনের সদস্যদের সমন্বয়ে গঠিত, সেকারণে তারা তাদের অতীত অভিজ্ঞতা এবং আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তৎপরতার বিষয়টি বিবেচনা করেই নিজেদের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা নির্ধারণ করছে। তবে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীও তাদের পেছনে সক্রিয় আছে। যখনই অনলাইন কিংবা অফলাইনে কোনও ধরনের ক্লু পাওয়া যাচ্ছে, সেসব বিষয়গুলো বিচার-বিশ্লেষণ করে অভিযান পরিচালনা করা হচ্ছে।
কী বলছেন কর্মকর্তারা
কাউন্টার টেরোরিজম অ্যান্ড ট্রান্স ন্যাশনাল ক্রাইম (সিটিটিসি) ইউনিটের প্রধান মো. আসাদুজ্জামান বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, নিখোঁজ তরুণদের শনাক্ত এবং উদ্ধারে আমরা কাজ করছি। এছাড়া যারা এসব তরুণ এবং কিশোরদের জঙ্গিবাদে উদ্বুদ্ধ করে জঙ্গিবাদী কর্মকাণ্ডে যুক্ত করছে, তাদের বেশ কয়েকজনকে আমরা গ্রেফতার করেছি। আমাদের অভিযান চলমান রয়েছে।
র্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন জানান, জঙ্গিদের অর্থের যোগান দিচ্ছে এমন বেশ কয়েকজনের নাম পাওয়া গেছে। সেসব বিষয় তদন্ত করে দেখা হচ্ছে, খতিয়ে দেখা হচ্ছে। এগুলো কী ধরনের অর্থায়ন, অর্থের যোগানদাতা বা ডোনারদের নিজস্ব অর্থ না কিনা, তারা অন্য কোনও জায়গা থেকে বা যারা সহানুভূতিশীল তাদের কাছ থেকে অর্থ সংগ্রহ করেছে কিনা, সেটি কি দেশে না বিদেশ থেকে এসেছে, এসব বিষয়ে আমরা পর্যালোচনা করছি, যাচাই-বাছাই করছি।
যে ছয় ধাপে দাওয়াতি কাজ চলছে
প্রথম ধাপে রয়েছে টার্গেট নির্বাচন। অর্থাৎ কোনও ব্যক্তিকে সংগঠনের জন্য নির্বাচন করা। এই প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে পাঁচটি শ্রেণিকে তারা অযোগ্য বলেছে। যারা ভীতু, কৃপণ, বাচাল, ঘরকোনা ও রাজনীনৈতিক সংগঠনের সঙ্গে জড়িতরা এর মধ্যে রয়েছে।
দ্বিতীয় ধাপ হলো সম্পর্ক যাচাইয়ের কৌশল। পাঁচটি কৌশলের মাধ্যমে যে কারও সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন করা যাবে বলে বলা হচ্ছে। কৌশলগুলো হলো- সালাম দেওয়া, হাসিমুখে কথা বলা, অন্যের দোষ না ধরা, প্রশংসা করা ও হাদিয়া দেওয়া।
তৃতীয় ধাপে ঈমান নির্ধারণ করা হয়। দশটি বিষয়ের ওপর গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে। এগুলো হলেঅ– জান্নাত, জাহান্নাম, নামাজ, গুনাহ, এখলাস পরীক্ষা, উত্তম চরিত্র, কোন কাজ করলে গুনাহ হবে বা কোন কাজ করলে গুনাহ হবে না ইত্যাদি সম্পর্কে উল্লেখ করা হয়েছে।
চতুর্থ ধাপে চিন্তার বীজ বপন করা হচ্ছে। কুরআন-সুন্নাহ, গণতন্ত্রসহ বিভিন্ন বিষয় সম্পর্কে ধারণা থাকাদের সদস্য হিসেবে সংগ্রহ করা অন্যতম বিষয় হিসেবে কাজ করে।
পঞ্চম ধাপে রয়েছে সংগঠনের সাংগঠনিক শ্রেণিবিন্যাস। সংগঠনের নির্দেশনা ও কর্মপরিকল্পনা কী হবে এসব বিষয়ে আলোচনা করা হয়।
সবশেষ ষষ্ঠ ধাপে সাথিদের যুদ্ধের কৌশল সম্পর্কে জ্ঞান ও প্রশিক্ষণ দিয়ে যেকোনও একটি সেক্টরে যোগ্য করে গড়ে তোলার ব্যাপারে কাজ করা হয়।
সূত্র: বাংলা ট্রিবিউন