হবিগঞ্জ পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) আওতায় কুশিয়ারা নদীর তীরে ৫৭৩ কোটি টাকার প্রতিরক্ষা প্রকল্প নির্মাণকাজে দুর্নীতি আর অনিয়মের অভিযোগ উঠেছে। জানা গেছে, প্রকল্পের তদারকির দায়িত্বে থাকা খোদ পাউবো কর্তৃপক্ষের যোগসাজশেই প্রকল্পের কাজে বেপরোয়া প্রভাবশালী ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানগুলো।
এমন পরিস্থিতিতে স্থানীয়দের প্রশ্ন- প্রতিবাদ কে করবে, কোথায় করবে, কার কাছে করবে? শত শত কোটি টাকার এই প্রতিরক্ষার প্রকল্প রক্ষা করবে কে? প্রতিবাদ করতে গেলে ঝুলিয়ে দেবে মামলায়। আর অভিযোগ যেখানে করার কথা, সেখানেই তো অভিযুক্তদের আশ্রয়স্থল।
জনগুরুত্বপূর্ণ এই প্রকল্প বাঁধের বিভিন্ন জায়গায় ব্লক দেবে গিয়ে বেশ কয়েকটি পয়েন্টে বড় বড় ফাটল দেখা দিয়েছে, যা নিয়ে ক্ষোভ দেখা দিয়েছে স্থানীয়দের মাঝে।
স্থানীয়দের অভিযোগ, কাজ শুরুর পর থেকে কুশিয়ারা নদীর তীর প্রতিরক্ষায় ব্লক নির্মাণে মাটি যুক্ত বালু, নুড়ি পাথর, ছোট পাথরের জায়গায় বড় পাথর, গোটা পাথর, মরা পাথর ব্যবহার করা হচ্ছে। ধুলাবালিযুক্ত অবস্থাতেই করা হয়েছে ঢালাইয়ের কাজ। ইটের খোয়া মিশ্রণ এবং সিমেন্টের তুলনায় অতিরিক্ত বালু ব্যবহারসহ নানা অনিয়মের মধ্য দিয়ে ব্লকগুলোর নির্মাণকাজ করেছে ঠিকাদার। তদারকির দায়িত্বে থাকা পানি উন্নয়ন বোর্ডের কর্মকর্তাদের জোগসাজশেই এমন অনিয়ম হয়ে আসছে বলেও অভিযোগ তাঁদের। ফলে কাজ শেষ হওয়ার আগেই প্রায় অর্ধ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মাণাধীন এ প্রতিরক্ষা প্রকল্পের বেশকিছু স্থান দেবে গেছে।
পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী শামীম হাসনাইন মাহমুদ বলেন, অভিযোগ পেয়ে ওইসব স্থান পরিদর্শন করেছি এবং ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে দেবে যাওয়া ব্লক তুলে ফের বালু ও জিও টিউব দিয়ে ব্লক বসানোর নির্দেশনা দিয়েছি। চলমান কাজ নিয়মিত তদারকি করা হচ্ছে।
প্রকল্প এলাকার বিভিন্ন পয়েন্ট ঘুরে দেখা যায়, নবীগঞ্জের পাহাড়পুর অংশে এ এইচ ট্রেডিং করপারেশন নামে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের শ্রমিকরা ব্লক নির্মাণ করছেন। সেখানে সঠিক পরিমাণে নির্ধারিত নির্মাণসামগ্রীর মিশ্রণ তৈরি করা হচ্ছে না। প্রতিটি ব্লকের জন্য নির্ধারিত পরিমাণের চেয়ে কম সিমেন্ট এবং অধিক পরিমাণ বালুর সঙ্গে মেশানো হচ্ছে মরা পাথর। তাৎক্ষণিক এ বিষয়ে জানতে চাইলে পাশ কাটিয়ে যান ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানটির ব্যবস্থাপনা কর্মকর্তা আরাফাত খান।
এছাড়া ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান ন্যাশন ট্রেক ট্রেডিং, আরএফএল ট্রেডিং করপোরেশন নিম্নমানের মালপত্র দিয়ে ব্লক নির্মাণের ফলে লামা তাজপুর এলাকার বেশ কিছু স্থানে প্রকল্পের ব্লক দেবে গেছে। যার ফলে ওইসব পয়েন্টে দেখা দিয়েছে বড় বড় ফাটল।
শেরপুর এলাকার জুয়েল আহমদ জানান, স্থানীয় অঞ্চলের বন্যা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে এ প্রতিরক্ষা প্রকল্প নির্মাণ ছিল সরকারের প্রশংসনীয় উদ্যোগ। তবে নিম্নমানের মালপত্র, দায়সারা কাজ, অনিয়ম আর দুর্নীতিতে কাজ শেষ হওয়ার আগেই প্রকল্পটি নিয়ে শঙ্কা দেখা দিয়েছে।
লামা তাজপুরের খোয়াজ উল্লাহ ব্লক নির্মাণে অনিয়মের কথা জানিয়ে স্থানীয় তফুর আলী জানান, শুরু থেকে প্রকল্পের কাজে নিম্নমানের নির্মাণসামগ্রী ব্যবহার করা হচ্ছে। পাউবো কর্মকর্তারা সবই জানেন। তাঁরা আসেন, দেখেন; কিন্তু কোনো ব্যবস্থা নেন না। প্রকল্পের কাজে চলমান দুর্নীতি বন্ধে দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়ার দাবি জানিয়েছেন নবীগঞ্জ উপজেলার চেয়ারম্যান পরিষদের চেয়ারম্যান ফজলুল হক চৌধুরী সেলিম।
২০২০ সালে প্রকল্পটির দরপত্র আহ্বানের কাজ পায় ৫টি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান- গোলাম রব্বানী কনস্ট্রাকশন, এ এইচ ট্রেডিং কোং, আরএফএল, নেশন ট্রেক কমিশন ও আবুল কালাম কোং। তারা ১১টি প্যাকেজে কাজ শুরু করে। এর মধ্যে এ এইচ ট্রেডিং কোং, আরএফএল ও নেশন ট্রেক কমিশনের কাজে ফাটল দেখা দিয়েছে।
আরএফএলের পরিচালক রাসেল আহমদ জানান, শুধু তাঁদের নয়, সবার করা ব্লকেই ফাটল দেখা দিয়েছে নিচ দিয়ে দেবে যাওয়ার কারণে। সমস্যা সমাধানে চেষ্টা করা হচ্ছে। তবে অন্যান্য ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের পরিচালকদের সঙ্গে কথা বলার জন্য তাঁদের মোবাইল ফোনে যোগাযোগ করলেও সাড়া মেলেনি।
প্রকল্পটি ঘিরে দুর্নীতি ও অনিয়মের অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে সংসদ সদস্য গাজী মোহাম্মদ শাহনওয়াজ মিলাদ বলেন, স্থানীয়দের দুর্ভোগ কমাতে এত কষ্ট করে প্রকল্প আনলাম আর সেখানে এমন দুর্নীতি আর অনিয়মের অভিযোগ উঠছে। এ বিষয়ে সংশ্নিষ্ট পর্যায় থেকে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হোক।