‘জীবনের বেশিরভাগ সময়ই শিক্ষককতা করে কাটিয়েছি। চাকরিতে থাকাকালীন সময়ে অনেকে গুরুত্ব দিলেও অবসরের পর আমাদের কথা আর কেউ মনে রাখে না। মুখেই কেবল শিক্ষকের মর্যাদার কথা বণলা হয়, বাস্তবে এর কোন প্রয়োগ নেই। অবসর নেওয়ার পর আজকেই প্রথম কেউ আমাকে ডেকে সম্মাননা জানালো’।
-আবেগাপ্লুত কণ্ঠে এমনটি বললেন জকিগঞ্জের অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক আকরাম আলী। মঙ্গলবার আকরাম আলীসহ ২৪ জন অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষককে সম্মাননা প্রদান করে ‘টি আলী স্যার ফাউন্ডেশন’ নামের একটি সংগঠন। এদের মধ্যে ৫ জনকে প্রদান করা হয় ‘টি আলী স্যার সম্মাননা পদক-২০২২।’
বুধবার (১৫ নভেম্বর) দুপুরে নগরের রাজা গিরিচন্দ্র উচ্চ বিদ্যালয়ের মিলনায়তনে ব্যতিক্রমী এই সম্মানা প্রদান অনুষ্ঠান ও অবসরপ্রাপ্ত গুণী শিক্ষক সমাবেশের আয়োজন করা হয়।
সম্মাননা পাওয়া বেশিরভাগ শিক্ষকই অশীতিপর বৃদ্ধ। প্রয়াতও হয়েছেন কয়েকজন। তাদের পক্ষ থেকে পরিবারের সদস্যরা গ্রহণ করেন সম্মাননা। সম্মাননা পেয়ে সকলেই ছিলেন আবেগাপ্লুত। চোখের জলও ফেলেন অনেকে।
ওসমানীনগর উপজেলার প্রয়াত শিক্ষক বিন্দু মাধব ভট্টাচার্যের পক্ষে সম্মাননা গ্রহণ করতে এসেছিলেন তার স্ত্রী, পুত্রবধূ ও নাতনি। সম্মাননা স্মারক গ্রহণের পর চোখের জল আটাতে পারেননি পুত্রবধূ। তার আবেগ ছড়িয়ে পড়ে মিলনায়তনে।
রাজা গিরিশ্চন্দ্র মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মোহম্মদ আবদুল মুমিতের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্য রাখেন, জেলা শিক্ষা কর্মকর্তা আবু সাঈদ মো. আব্দুল ওয়াদুদ।
তিনি বলেন, অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষকদের সম্মাননা প্রদান ‘টি আলী স্যার ফাউন্ডেশন’র একটি অনন্য উদ্যোগ। আগে কেউ শিক্ষকদের এভাবে শ্রদ্ধা জানায় নি। অবসর নেওয়ার পর অনেক শিক্ষকই আর্থিক সঙ্কটে থাকেন। তাদের খবরই কেউ নেয় না। এক্ষেত্রে আজকের আয়োজনটি অত্যন্ত ব্যতিক্রমী ও প্রশংসনীয়।
সম্মাননা পাওয়া শিক্ষকদের উদ্দেশ্যে তিনি বলেন, আপনারা এই অঞ্চলের শিক্ষা বিস্তারে অনন্য অবদান রেখেছেন। এখনও আপনাদের কাজের সুযোগ রয়েছে। শিক্ষাক্ষেত্রে সারা দেশের তুলনায় পিছিয়ে আছি আমরা। দেশে শিক্ষার হার ৭৫ শতাংশের উপরে, অথচ সিলেটে তা মাত্র ৬৩ শতাংশ। সিলেটের শিক্ষার হার বৃদ্ধিতে আপনারা কাজ করতে পারেন।
অনুষ্ঠানে প্রধান বক্তার বক্তব্যে টি আলী স্যার ফাউন্ডেশন, বাংলাদেশের সমন্বয়ক ও সিলেট সরকারী পাইলট উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক কবির খান বলেন, ‘কেউ শিক্ষকদের সহায়তা করে না। সম্মাননা জানায় না। শিক্ষকরা সবচেয়ে অবহেলিত। কিন্তু আমরা শিক্ষকদের সম্মাননা জানানোর উদ্যোগি নিয়েছি। আমরা এই ফাউন্ডেশনের মাধ্যমে কেবল শিক্ষকদেরই সম্মাননা জানাবো।’
উপস্থিত ছাত্রদের উদ্দেশে বলেন, ‘শিক্ষকদের কখনো ভুলে যেও না। তাদের প্রতি বিনয়ী থেকো। আমাদের সবার জীবনেই কোন না কোন শিক্ষকের প্রভাব রয়েছে। তোমরাও তার ব্যতিক্রম নয়।’
সিলেট সরকারি পাইলট উচ্চ বিদ্যালয়ের সিনিয়র সহকারি শিক্ষক ফৌজিয়া খানের সঞ্চালনায় সম্মাননা প্রদান অনুষ্ঠানে অতিথি হিসেবে বক্তব্য রাখেন নছিবা খাতুন উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক ইসরাইল আলী, রসময় উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক রফিকুল আলম ও রমিজা খাতুন উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মামুন আহমদ।
অনুষ্ঠানের শুরুতে সম্মাননা পাওয়া শিক্ষকদের জীবনী নিয়ে ভিডিওচিত্র প্রদর্শন করা হয়। বক্তৃতাপর্ব শেষে গুণী শিক্ষকদের হাতে তুলে দেওয়া হয় সম্মাননা স্মারক।
এবছর টি আলী স্যার ফাউন্ডেশন সম্মাননা পদক পান- সিলেট সদর উপজেলায় মো. আব্দুর রাজ্জাক, সাদ ওবায়দুল লতিফ চৌধুরী, ফেঞ্চুগঞ্জ উপজেলায় হাজী ময়ুব আলী, বিয়ানীবাজার উপজেলায় মো. মজির উদ্দিন আনসার ও জকিগঞ্জ উপজেলায় আকরাম আলী।
এছাড়া সম্মাননা প্রদান করা হয় অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক মো. রমজান আলী, মো. আব্দুল মুক্তাদির, রজত চক্রবর্ত্তী, মিছবাহ উদ্দিন, মো. ইসলাম উদ্দিন, মো. মাহতাব উদ্দিন, প্রমোদ চন্দ্র দে কানু, মোহাম্মদ আছমত আলী, বিন্দু মাধব ভট্টাচার্য্য, ধীরেন্দ্র কুমার নাথ, ফয়জুল ইসলাম, মো. মহিউদ্দিন, মো. সামছুদ্দিন, মো. শুয়াইব আলী, মো. সিরাজুর রহমান, মো. হুসাইন আহমদ, শৈলেন্দ্র চন্দ্র দাশ ও সুভাষ রন্জন তালুকদারকে।
উল্লেখ্য, সিলেট জেলার বিয়ানীবাজার উপজেলার বৃহত্তর জলঢুপে জন্ম নেওয়া তজম্মুল আলী পেশায় ছিলেন স্কুল শিক্ষক। ভালোবেসে তাকে শিক্ষার্থীরা ডাকতেন ‘টি আলী স্যার’। তিনি ১৯৪৭ সাল থেকে ১৯৭৮ সাল পর্যন্ত দীর্ঘ ৩১ বছর হবিগঞ্জ সরকারী উচ্চ বিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করেন। ২০১৯ সালে এই শিক্ষকের নামে প্রতিষ্ঠিত হয় যুক্তরাজ্য ভিত্তিক চ্যারিটি সংস্থা টি আলী স্যার ফাউন্ডেশন। মূলত অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষকদের সম্মাননা ও আর্থিকভাবে পিছিয়ে পড়া শিক্ষকদের সহযোগিতার উদ্দেশ্য নিয়ে প্রতিষ্ঠিত হয় ফাউন্ডেশনটি।