বিশ্ববরেণ্য অর্থনীতিবিদ, বাংলাদেশের সাবেক অর্থ ও পরিকল্পনা মন্ত্রী এবং খ্যাতিমান রাজনীতিবিদ এম সাইফুর রহমানের ১৫তম মৃত্যুবার্ষিকী আজ (৫ সেপ্টেম্বর)। ২০০৯ সালের এইদিনে ঢাকা-সিলেট মহাসড়কে এক মর্মান্তিক সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত হন এই কিংবদন্তী রাজনীতিবিদ।
বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি)’র জাতীয় স্থায়ী কমিটির সাবেক সদস্য ও একুশে পদকপ্রাপ্ত এম সাইফুর রহমান অর্থমন্ত্রী হিসেবে দেশের ইতিহাসে প্রথম সর্বোচ্চ ১২বার বাজেট পেশ করার রেকর্ড গড়েন।
‘সিলেটপ্রেমী’ হিসেবে খ্যাত সাইফুর রহমান তার জীবনের শেষ জুম্মার নামাজ সিলেট নগরীর বন্দরবাজার জামে মসজিদে আদায় করেন এবং সেদিন উক্তি করেছিলেন, ‘যত দিন বেঁচে থাকব সিলেটকে নিয়েই বাঁচতে চাই-সিলেটই আমার শেষ ঠিকানা।’
বাংলাদেশের উন্নয়নের বরপুত্র এম সাইফুর রহমানের মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে বিএনপি ও তার পরিবারের পক্ষ থেকে সিলেটে এবং মৌলভীবাজারে বিভিন্ন কর্মসূচির আয়োজন করা হয়েছে।
১৯৩২ সালের ৬ অক্টোবর তৎকালীন সিলেট জেলার মৌলভীবাজার মহকুমার সদর উপজেলার বাহারমর্দন গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন এম সাইফুর রহমান। তাঁর পিতা আব্দুল বাছিত এবং মাতা তালেবুননেসা। তিন ভাইয়ের মধ্যে তিনি ছিলেন সবার বড়।
সিলেটের ঐতিহ্যবাহী মুরারিচাঁদ (এমসি) কলেজ থেকে ১৯৫১ সালে আইএ (উচ্চ মাধ্যমিক) পাস করে ১৯৫৩ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিকম ডিগ্রি অর্জন করেন তিনি। বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নকালে তিনি রাজনীতিতে অংশগ্রহণ করেন এবং সলিমুল্লাহ মুসলিম হক ছাত্র ইউনিয়নের সহ-সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন।
পরবর্তীতে ১৯৫৩ থেকে ১৯৫৮ সাল পর্যন্ত যুক্তরাজ্যের বিখ্যাত দি ইনস্টিটিউট অব চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্টস অব ইংল্যান্ড অ্যান্ড ওয়েলস (আইসিএইডাব্লিউ) হতে চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্সি (সিএ) বিষয়ে উচ্চতর ডিগ্রি অর্জন করেন তিনি।
১৯৬২ সালে যুক্তরাজ্যে অ্যাডভান্সড ম্যানেজমেন্ট বিষয়ে বিশেষ প্রশিক্ষণের মাধ্যমে আর্থিক ও মুদ্রানীতি এবং উন্নয়ন অর্থনীতিতে বিশেষায়িত শিক্ষা গ্রহণ করেন কিংবদন্তি সাইফুর রহমান।
শিক্ষাজীবন শেষে ১৯৫৯ সালে ব্রিটিশ অক্সিজেন কোম্পানিতে যোগ দেন যার কর্মস্থল ছিল পাকিস্তানের করাচিতে। তবে সে চাকরি ছেড়ে ঢাকায় এসে ১৯৬২ সালে দুই সহকর্মীকে নিয়ে ‘রহমান রহমান হক অ্যান্ড কোম্পানি’ নামে একটি অডিট ফার্ম প্রতিষ্ঠা করেছিলেন যা এখনো দেশের অন্যতম চার্টার্ড অ্যাকাউন্টিং প্রতিষ্ঠান হিসেবে সুপ্রতিষ্ঠিত।
তৎকালীন পাকিস্তান জাতীয় বেতন কমিশনে প্রাইভেট সেক্টর হতে ১৯৬৯ সালে একমাত্র সদস্য মনোনীত হয়েছিলেন সাইফুর রহমান। স্বাধীনতার পর স্বাধীন বাংলাদেশে ১৯৭৩ ও ১৯৭৫ সালে বাংলাদেশ জাতীয় বেতন কমিশনের সদস্যও ছিলেন তিনি।
১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পটপরিবর্তনের পর জিয়াউর রহমান সরকার গঠন করলে ১৯৭৬ সালে তিনি এ সরকারের বাণিজ্য উপদেষ্ঠা হিসেবে দায়িত্বভার গ্রহণ করেন। ১৯৭৭ সালে তিনি জাতীয়তাবাদী গণতান্ত্রিক দলে যোগ দেন যা পরবর্তীতে রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের নেতৃত্বে ১৯৭৮ সালে এই দলটি বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলে (বিএনপি) রূপান্তরিত হয়।
তিনি ১৯৭৯ সালে বিএনপি মনোনীত প্রার্থী হিসেবে মৌলভীবাজার সদর আসন থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। ১৯৭৯ থেকে ১৯৮২ সাল পর্যন্ত প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের মন্ত্রিসভায় বাণিজ্য ও অর্থমন্ত্রী এবং ১৯৯১ থেকে ১৯৯৬ সাল পর্যন্ত বেগম খালেদা জিয়ার সরকারে টেকনোক্র্যাট কোটায় অর্থমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।
তিনি ১৯৯৬ সালে এবং পুনরায় ২০০১ সালে জাতীয় সংসদের সদস্য নির্বাচিত হন। তিনি ২০০১ থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত বেগম খালেদা জিয়ার মন্ত্রিসভায় অর্থ ও পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে নিয়োজিত ছিলেন।
১৯৯৪ সালে স্পেনের রাজধানী মাদ্রিদে অনুষ্ঠিত বিশ্বব্যাংক এবং আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের সুবর্ণ জয়ন্তী সম্মেলনের গভর্নর নির্বাচিত হয়েছিলেন অর্থনীতিবিদ এম সাইফুর রহমান। এর আগে, ১৯৮০-১৯৮২ ও ১৯৯১-১৯৯৬ পরপর দুই মেয়াদে বিশ্বব্যাংক, এডিবি, আইডিবি, আইএফএডিতে বাংলাদেশের গভর্নর ছিলেন তিনি। ১৯৯৪-১৯৯৫ মেয়াদে এশিয়ান উন্নয়ন ব্যাংকের ভাইস চেয়ারম্যানও ছিলেন সাবেক এই সফল অর্থমন্ত্রী এম সাইফুর রহমান।
তিনিই অর্থনৈতিক সংস্কারের মাধ্যমে বাংলাদেশের অর্থনীতিকে তলাবিহীন ঝুড়ি থেকে উত্তোরণ করেন। সচল করেন অর্থনীতির চাকা দেশে ভ্যাট প্রথার প্রবর্তকও এই বিশ্ববরেণ্য অর্থনীতিবিদ।
মৃত্যুবার্ষিকীতে যত আয়োজন
এম সাইফুর রহমানের ১৫তম মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে নানা কর্মসূচি ঘোষণা করেছে এম সাইফুর রহমান স্মৃতি পরিষদও বিএনপি।
স্মৃতি পরিষদের আয়োজনে তার গ্রামের বাড়িতে সকালে কোরান খতম, মরহুমের কবরে পুষ্পস্তবক অর্পণ, বাদ জোহর মিলাদ, দোয়া ও তোবারক বিতরণ করা হবে। পরে বিকেল ৪টায় পৌর জনমিলন কেন্দ্রে এম সাইফুর রহমান স্মৃতি পরিষদের উদ্যোগে স্মরণসভা ও দোয়া মাহফিলের আয়োজন করা হয়েছে।
দিবসটি উপলক্ষে বাদ যোহর সিলেটের হযরত শাহজালাল (রা.) দরগাহ প্রাঙ্গণে দোয়া মাহফিলের আয়োজন করেছে সিলেট বিএনপি ও অঙ্গ-সহযোগী সংগঠন।
এসকল আয়োজনে সবাইকে উপস্থিত থাকার জন্য অনুরোধ জানিয়েছেন তার পরিবার, সিলেট জেলা বিএনপির সভাপতি আব্দুল কাইয়ুম চৌধুরী ও সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট এমরান আহমদ চৌধুরী।