সুখ-দুঃখ নিয়েই হাজার বছর ধরে জীবনের সাথে সংগ্রাম করে আজও টিকে আছে বেদে সম্প্রদায়। আধুনিক সমাজ ব্যবস্থার ধারে কাছেই নেই তাঁরা। তাদের সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যকে টিকিয়ে রেখে বেদে সমাজের প্রচলিত ব্যবসাকেই তারা আঁকড়ে ধরে বেঁচে আছে।
তবে বেদে সম্প্রদায়ের পূর্ব পুরুষের পেশাগত কারণে সামাজিকভাবে অবহেলিত ও অভিভাবকদের সচেতনতার অভাবে শিক্ষার আলো থেকে বঞ্চিত হচ্ছে বেদে শিশুরা। জীবন ও জীবিকার তাগিদে অনেক বেদে দল বেঁধে এক স্থান থেকে অন্য স্থানে ঘুরে বেড়ায়। কোথাও স্থায়ীভাবে বসবাস না করায় পরিবারের সঙ্গে যাযাবরের মতো জীবন কাটে শিশুদেরও। তাই বিদ্যালয় চোখে পড়ে না বেদে শিশুদের। শিক্ষাগ্রহণের মতো মৌলিক অধিকার থেকে বঞ্চিতই থাকে শিশুরা।
একজন কোমলমতি শিশুর হাতে যখন বই-খাতা থাকার কথা, তখন বেদে শিশুর হাতে তুলে দেওয়া হয় সাপের বাক্স। বেরিয়ে পড়তে হয় পরিবারের আহার জোটাতে। মৃত্যুঝুঁকি নিয়ে সাপ, বাঁদর খেলার মতো ভয়ঙ্কর পেশায় জড়িত বেদে সম্প্রদায়ের শিশুরা। বাবা-মায়ের দেখাদেখি ছোট থেকেই এসব পেশায় জড়িয়ে পড়ছে এ সম্প্রদায়ের শিশুরা। বেড়ে উঠছে অশিক্ষা আর কুশিক্ষায়। তাদের কাছে শিক্ষা বলতে, সাপ ও বাঁদর খেলা শেখা। বাজার ও গ্রামেগঞ্জে সাপ খেলা ও বিভিন্ন কাজে বাবা-মাকে সহযোগিতা করাই তাদের মূল কাজ।
সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, শান্তিগঞ্জ উপজেলার পাগলা বাজার সংলগ্ন টিএনটি মাঠে বাঁশের চেরা ও পলিথিনের সাহায্যে অস্থায়ী ছোট ছোট ডেরা বেঁধে খুপড়ি ঘরে ঘাঁটি গেড়ে বাস করছেন প্রায় ২৫-৩০ টি বেদে পরিবারের পুরুষ, নারী ও শিশুরা। নারী পুরুষ মিলে পলিথীন দিয়ে ঘেরা একটি টয়লেট, ভিজা মাটির উপর বিছানা করে রাতযাপন করছে এই ভ্রাম্যমাণ বেদে পরিবারগুলো। তাদের সাথে থাকা শিশুরাও এভাবেই অন্ধকারে পড়ে আছে। বঞ্চিত হচ্ছে শিক্ষার আলো থেকে।
বেদে শিশু মুহিনা বেগম (১২) জানায়, ‘কোন দিন স্কুলে যাইনি, এই এলাকার ছেলে-মেয়েদের স্কুলে যেতে দেখে আমারও স্কুলে গিয়ে লেখাপড়া করতে ইচ্ছে হয়। ভোর হওয়ার সাথে সাথে আমরা বাবা মায়ের সাথে গ্রামের পাড়া-মহল্লায় ঘুরে বেড়াই, গ্রামের শিশুদের খেলা দেখাই। লেখাপড়া করে আমরা অন্য পেশায় কাজ করতে চাই।’
বেদেনী হেলেনা বিবি (৪০) বলেন, ‘আমাদের শিশুদেরকে পড়াশোনা করানোটা কঠিন। জীবিকা অন্বেষণে শিশুরাও আমাদের সহযোগিতা করে। আর্থিক অসচ্ছলতা আর ভাসমান জীবনে শিক্ষা আমাদের শিশুদের জন্যে দুর্বোধ্য ব্যাপার। শিশুদের পড়াশোনার আগ্রহ থাকলেও পরিস্থিতির কারণে সেটা আর হয়ে ওঠে না।’
বেদে সর্দার শেখ মিয়া (৬০) জানান, সারাদিন বিভিন্ন গ্রাম ঘুরে ফিরে আসতে প্রায়ই সন্ধ্যা হয়ে যায়। আমাদের সাহায্যের জন্য শিশুদেরও নিয়ে যাই। তাদেরকে পেশাগত বিভিন্ন বিষয় শেখাই। তবে কোনো অভিভাবক চায় না তার সন্তান অশিক্ষিত থাকুক। আমাদের অল্প আয়ে সন্তানদের পডাশুনা চালানো কঠিন। আমাদের এখানে অনেক শিশু রয়েছে। তারা কেউ স্কুলে যায় না। তারা নিজের নামটাও লেখতে পারে না।
সুনামগঞ্জ সরকারি কলেজের অধ্যক্ষ রজত কান্তি সৌম বলেন, অনেক সময় অনেক বেসরকারি সংগঠন এসব পরিযায়ী শিশুদের জন্য নানা ধরণের প্রকল্প নিয়ে থাকে। সরকারও চেষ্টা করে যাচ্ছেন তাদের মাঝে শিক্ষার আলো পৌঁছে দিতে। সমস্যা হচ্ছে তাদের বসবাস একটি নির্দিষ্ট জায়গায় না হওয়ার কারণে সকল উদ্যোগ সবসময় সফল হয় না। মূলত: ভবঘুরে জীবনাচরণের জন্যই উপযুক্ত শিক্ষা থেকে এসব শিশুরা বঞ্চিত থাকেন। তাদেরকে পুনর্বাসনের আওতায় এনে সাধারণ শিশুদের মতো ‘মেইন স্ট্রিম’ শিক্ষায় অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। বেদে পল্লীর মানুষদের পেশা বদলের চিন্তা করতে হবে। আপাতত মোবাইল স্কুলের মাধ্যমে তাদের শিক্ষা নিশ্চিত করতে হবে।