রেকর্ড বিদ্যুৎ উৎপাদনের পরও সরবরাহ স্বাভাবিক থাকছে না। সামাল দিয়ে উঠতে পারছে না বিদ্যুৎ বিভাগ। গত চার দিন ধরে ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে ঘন ঘন লোডশেডিং হচ্ছে। তীব্র তাপদাহের মধ্যে এ লোডশেডিং জনজীবনকে অতিষ্ঠ করে তুলেছে। বিশেষ করে শহরের তুলনায় গ্রামে লোডশেডিং বেশি হচ্ছে। এর মধ্যেই ‘যান্ত্রিক ত্রুটির’ কারণে দুদিন ধরে উৎপাদন বন্ধ রয়েছে রামপাল তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রে। এর প্রভাবে বাগেরহাটসহ দেশের দক্ষিণাঞ্চলে লোডশেডিংয়ের মাত্রা বৃদ্ধি পেয়েছে। কৃর্তপক্ষ জানিয়েছে, মেরামতের কাজ চলছে। দ্রুতই উৎপাদনে ফিরে যাবে রামপাল বিদ্যুৎ কেন্দ্র।
গ্যাস ও কয়লাভিত্তিক কেন্দ্রগুলো পর্যাপ্ত বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে পারছে না জানিয়ে বিদ্যুৎ বিভাগ বলছে, প্রচণ্ড তাপের কারণে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রে উৎপাদন বন্ধও রাখতে হচ্ছে সাময়িক সময়ের জন্য।
বিদ্যুৎ উৎপাদন ও চাহিদার তথ্য বিশ্লেষণে দেখা গেছে, গত তিন দিন ধরে প্রতিদিন ৫০০ থেকে ১০০০ মেগাওয়াট বিদ্যুতের ঘাটতি রয়েছে। এমন পরিস্থিতিতে বিদ্যুৎ ব্যবহারে সাশ্রয়ী হওয়ার আহ্বান জানিয়ে প্রধানমন্ত্রীর বিদুৎ ও জ্বালানিসম্পদ বিষয়ক উপদেষ্টা ড. তৌফিক-ই-ইলাহী চৌধুরী বলেছেন, ‘চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় সবাইকে এক হয়ে কাজ করতে হবে।’
তবে বিদ্যুৎ বিভাগ বলছে, তাপমাত্রা রেকর্ড পরিমাণ বৃদ্ধি পাওয়ায় বিদ্যুতের চাহিদা বেড়ে গেছে। এতে হিমশিম খেতে হচ্ছে বিদ্যুৎ সরবরাহে।
বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (পিডিবি) তথ্য অনুযায়ী, গত রবিবার সন্ধ্যায় বিদ্যুতের সর্বোচ্চ চাহিদা ছিল ১৬ হাজার মেগাওয়াট। এদিন উৎপাদন হয়েছে ১৫ হাজার মেগাওয়াট। প্রায় এক হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুতের ঘাটতির কারণে লোডশেডিং বাড়াতে হয়েছে।
এদিকে বিদ্যুৎ সরবরাহ পরিস্থিতি গত ২৩ রমজান, অর্থাৎ গত শনিবার পর্যন্ত সামাল দেয়া সম্ভব হলেও প্রচণ্ড গরমের কারণে চাহিদা বাড়তে থাকায় সংকটে পড়েছে বিদ্যুৎ বিভাগ। তীব্র তাপদাহের ফলে এয়ার কুলার (এসি) ছাড়াও মানুষের বৈদ্যুতিক যন্ত্রের ব্যবহার বেড়ে যাওয়ায় বিদ্যুতের চাহিদা অন্য সময়ের তুলনায় অতিরিক্ত পরিমাণে বেড়েছে।
অন্যদিকে রমজান শুরুর আগেই আশঙ্কা ছিল বিদ্যুৎ পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখা নিয়ে। বিশ্বব্যাপী তেল, গ্যাস ও কয়লার দাম বৃদ্ধি পাওয়ায় পর্যাপ্ত জোগান নিশ্চিত করাও সরকারের চ্যালেঞ্জ ছিল। ফলে রমজানে চাহিদার সঙ্গে সরবরাহ স্বাভাবিক রাখা নিয়ে শঙ্কা ছিল বিদ্যুৎ বিভাগের। তবে প্রায় ২৩ রমজান পার হয়ে গেলেও বিদ্যুৎ সরবরাহ পরিস্থিতি ছিল স্বাভাবিক। তবে গত তিন দিন ধরে লোডশেডিং বৃদ্ধির খবর বাড়তে থাকে।
রাজধানীর একটি অংশ এবং নারায়ণগঞ্জের বৃহত্তর অংশে বিদ্যুৎ সরবরাহকারী ঢাকা পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি (ডিপিডিসি) লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক প্রকৌশলী বিকাশ দেওয়ান বলেন, রোববার এ যাবতকালের সবচেয়ে বেশি বিদ্যুতের বরাদ্দ পেয়েছে ডিপিডিসি। প্রায় ১৯শ’ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ বরাদ্দ পাওয়া গেছে। তবে অতিরিক্ত গরমে মেশিনারিজ হিট হয়ে যাতে দুর্ঘটনা না ঘটে, সে কারণে কোথাও কোথাও কিছুটা লোডশেডিং দিতে হচ্ছে।
গ্যাস ও কয়লাভিত্তিক কেন্দ্রগুলো পর্যাপ্ত বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে পারছে বলে জানিয়ে বিকাশ দেওয়ান বলেন, ‘সামগ্রিকভাবে এখনো পরিস্থিতি ভালো। তবে যে পরিমাণ তাপমাত্রা বাড়ছে তাতে লোডশেডিং বাড়ার আশঙ্কা রয়েছে। কারণ অতিরিক্ত গরম পড়লে বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোও মাঝেমধ্যে বন্ধ রেখে চালাতে হয়।’
ডিপিডিসি ছাড়াও ঢাকার আরেকটি অংশে বিদ্যুৎ সরবরাহ করে ঢাকা ইলেকট্রিক সাপ্লাই কোম্পানি (ডেসকো)। ডেসকোর দায়িত্বশীল কর্মকর্তারাও জানিয়েছেন, চাহিদা অনুযায়ী তারা বিদ্যুৎ পাচ্ছেন। ফলে এখনো কোনো লোডশেডিং করতে হচ্ছে না।
তবে ঢাকার বাইরে বৃহত্তর রংপুর রাজশাহী অঞ্চলে বিদ্যুৎ সরবরাহকারী নর্দার্ন ইলেকট্রিক সাপ্লাই কোম্পানি (নেসকো) সূত্রে জানা গেছে, তাদের এলাকায় কিছু কিছু লোডশেডিং করতে হচ্ছে। বিতরণ ব্যবস্থার ত্রুটির কারণে নেসকো এলাকায় লোডশেডিং করতে হচ্ছে।
পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ড সূত্রে জানা যায়, শহরে কোনো লোডশেডিং করতে না হলেও তাদের বিতরণ এলাকায় অল্পবিস্তর লোডশেডিং দিতে হচ্ছে। এ ছাড়া বিভিন্ন জেলা সদরে বিদ্যুৎ সরবরাহ করে বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (পিডিবি)। পিডিবির সরবরাহকৃত এলাকাগুলোতে নিয়মিত লোডশেডিংয়ের খবর পাওয়া যাচ্ছে।
বিদ্যুৎ বিভাগ বলছে, এ বছর বিদ্যুৎ সরবরাহে সরকার সর্বোচ্চ সতর্ক আছে। বিদ্যুৎ উৎপাদন ও সরবরাহে নানা উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। স্পট মার্কেটে লিকুইড ন্যাচারাল গ্যাসের (এলএনজি) দাম তুলনামূলক কম হওয়ায় সেখান আমদানি বাড়ানো হয়েছে। বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোতে গড়ে এক হাজার মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাসের সরবরাহ নিশ্চিত করা হচ্ছে। নিজেদের সক্ষমতার সঙ্গে ভারতে আদানি গ্রুপের ঝাড়খণ্ড বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে গড়ে সাড়ে ৬শ থেকে ৭শ মেগাওয়াট আমদানি বাড়তি সুবিধা যোগ করেছে বলে মনে করছে বিদ্যুৎ বিভাগ। তবে যত গরম বাড়বে বিদ্যুৎ সরবরাহ পরিস্থিতি ততটা নাজুক হতে থাকবে।
বিদ্যুৎ বিভাগের একাধিক কর্মকর্তা বলেন, অতিরিক্ত গরমে বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো বেশি চললে গরমে দুর্ঘটনার আশঙ্কা থাকে। ফলে কোন কোন বিদ্যুৎকেন্দ্র বন্ধ রাখতে হয়। এ ছাড়া অতিরিক্ত গরম পড়লে সাবস্টেশন, ট্রান্সফরমার, বিদ্যুৎ সঞ্চালন ব্যবস্থায়ও নানা ত্রুটি দেখা দেয়।
তিন দিন ধরে বন্ধ রামপাল
‘যান্ত্রিক ত্রুটির’ ফলে বাগেরহাটের রামপাল তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রের উৎপাদন তিন দিন ধরে বন্ধ রয়েছে। গত শনিবার রাত থেকে এই তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রের উৎপাদন বন্ধ হয়ে যায়। বিদ্যুৎ সরবরাহে এর প্রভাব পড়েছে। এর ফলে বাগেরহাটসহ দেশের দক্ষিণাঞ্চলে লোডশেডিংয়ের মাত্রা বৃদ্ধি পেয়েছে। এর আগে চলতি বছরের ১৪ জানুয়ারি কয়লা সংকটে তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রটি বন্ধ হয়েছিল।
বাংলাদেশ ইন্ডিয়া পার্টনারশিপ পাওয়ার কোম্পানি লিমিটেডের (বিআইএফপিসিএল) উপমহাব্যবস্থাপক আনোয়ারুল আজিম এ তথ্য নিশ্চিত করে বলেন, কারিগরি ত্রুটির কারণে গত ১৫ এপ্রিল রাত থেকে রামপাল তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রের উৎপাদন বন্ধ রয়েছে। ত্রুটি মেরামতের কাজ চলছে। তিনি বলেন, আশা করছি, দ্রুত সময়ের মধ্যে এর উৎপাদন শুরু হবে।
গত বছরের ১১ জুলাই রামপাল তাপ বিদ্যুৎ কেন্দ্রের বয়লার স্টিম ব্লোয়িং স্থাপন করা হয়। এক মাস পরে ১৪ আগস্ট টারবাইন-এ স্টিম ডাম্পিং এবং একদিন পর ১৫ আগস্ট জাতীয় গ্রিডের সঙ্গে পরীক্ষামূলকভাবে বিদ্যুৎ সরবরাহ (ট্রান্সমিশন) শুরু করা হয়। পরে ১৭ ডিসেম্বর থেকে জাতীয় গ্রিডে বাণিজ্যিকভাবে যুক্ত হয় রামপালের বিদ্যুৎ। পরে ২০২৩ সালের ১৪ জানুয়ারি কয়লা সংকটে বন্ধ হয়ে যায় বিদ্যুৎ বিভাগের গুরুত্বপূর্ণ এই প্রতিষ্ঠানটি। এর প্রায় এক মাস পর ১৫ ফেব্রুয়ারি রাত ১২টার দিকে আবারও বিদ্যুৎ উৎপাদন শুরু হয়।