রিকশা থেকে ট্রাকচালক, সবার কানে মোবাইল

সোমবার দুপুর ১২টা। ধানমন্ডি থেকে ঝিগাতলার দিকে রিকশায় যাত্রী নিয়ে যাচ্ছেন সোহেল রানা (২৬)। পথে কল এলে কোমরের পিছনের অংশের লুঙ্গির ভাঁজ থেকে সেলফোনটি বের করে কথা বলা শুরু করেন। পেছনে প্রাইভেট কার একাধিকবার সাইড চাইলেও তার নজরই নেই সেদিকে। একটু পরে বাম দিকের থেকে আরেকটি প্রাইভেট এসে তার রিকশায় মেরে দিলে যাত্রীরা হুড়মুড় করে রাস্তায়। ধাক্কা দেওয়া গাড়িটির চালকও সেলফোনে কথা বলছিলেন। মোটরসাইকেল চালকদের বেশিরভাগেরই হেলমেটের সঙ্গে সেলফোন আটকানো থাকে। ঢাকার রাস্তায় রিকশা, গাড়ি, মোটরসাইকেল কিংবা ট্রাক— সব চালকরাই সেলফোনে কান দিয়ে রাখায় দুর্ঘটনা বাড়ছে। জরিমানার বিধান থাকলেও নেই তেমন মনিটরিং। আর চালকদের সচেতনতা? সে নিয়ে কোনও আলাপই নেই। চালকরা অসচেতন হবেন এটাই যেন নিয়ম!

আইনে কী আছে?

২০০৭ সালে ১২ জুলাই গাড়ি চালানোর সময় মোবাইল ফোনে কথা না বলার ব্যাপারে মোটরযান আইনের ১১৫ (বি) ধারার সংশোধন করে একটি প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়। এতে গাড়ি চালানোর সময় মুঠোফোনে কথা বলা নিষিদ্ধ করা হয়। ওই আইনে যানবাহন চলার সময় চালকের এয়ারফোন ব্যবহারও নিষিদ্ধ করা হয়। এ আইন ভঙ্গ করলে সর্বোচ্চ ৫০০ টাকা জরিমানার বিধান রাখা হয়।

পরবর্তীতে সংশোধিত মোটর ভেহিক্যালস আইন কার্যকর হয় ২০১৯ এর ১ সেপ্টেম্বর থেকে। ওই আইনের ৬৩ ধারায় যেসব পরিবর্তন আনা হয়েছে সেখানে কোনও জরুরি পরিষেবা প্রদানকারী গাড়িকে রাস্তা ছাড়তে ব্যর্থ হলে জরিমানার পরিমাণ বাড়িয়ে করা হয়েছে ১০ হাজার টাকা। আগে এই জরিমানার পরিমাণ ছিল ২ হাজার টাকা। কানে মোবাইল ফোনে কথা বলার সময় গাড়ি চালালে জরিমানার পরিমাণ ৫ হাজার টাকা করা হয়। আগে এ ক্ষেত্রে জরিমানা করা হতো ১ হাজার টাকা।

কত প্রাণ ঝরে যায়

সড়ক দুর্ঘটনায় গত সেপ্টেম্বর মাসে নিহত হয়েছেন ৪৭৬ জন, আহত ৭৯৪ জন। অর্থাৎ গত মাসে দিনে গড়ে ১৫ দশমিক ৮৬ জন নিহত হয়েছেন। নিহতের ৩৫ শতাংশের বেশি মোটরসাইকেল দুর্ঘটনার শিকার। এ ছাড়া নিহত ব্যক্তিদের ৮০ শতাংশের বেশি কর্মক্ষম মানুষ। রোড সেফটি ফাউন্ডেশন সেপ্টেম্বর মাসের দুর্ঘটনার এসব তথ্য জানায়। তারা নয়টি জাতীয় দৈনিক, সাতটি অনলাইন নিউজ পোর্টাল এবং ইলেকট্রনিক গণমাধ্যমের তথ্যের ভিত্তিতে প্রতিবেদন তৈরি করেছে।

গত আগস্ট মাসে সড়ক দুর্ঘটনায় ৫১৯ জন নিহত হয়েছিলেন। সে মাসে গড়ে প্রতিদিন নিহত হন ১৬ দশমিক ৭৪ জন। সেপ্টেম্বর মাসে প্রাণহানি কিছুটা কমেছে। তবে রোড সেফটি ফাউন্ডেশন বলছে, প্রাণহানি হ্রাসের এ মাত্রা কোনও টেকসই উন্নতির সূচক নির্দেশ করছে না।

রোড সেফটি ফাউন্ডেশন বলছে, গত সেপ্টেম্বর মাসে দেশে ৪০৭টি সড়ক দুর্ঘটনা ঘটেছে। নিহত ব্যক্তিদের মধ্যে নারী ৬২ জন, শিশু ৭৭টি। ১৮২টি মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় নিহত ১৬৯ জন, যা মোট নিহতের ৩৫ দশমিক ৫০ শতাংশ। মোটরসাইকেল দুর্ঘটনার হার ৪৪ দশমিক ৭১ শতাংশ। দুর্ঘটনায় ১০৩ জন পথচারী নিহত হয়েছেন।

মোবাইলে কথা বলা কেন বন্ধ করা যাচ্ছে না প্রশ্নে রাজধানীর রাস্তায় কর্মরত এক সার্জেন্ট বলেন, ‘মোবাইল ফোন ব্যবহারের বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট আইন রয়েছে। আইনে জেল জরিমানার বিধানও আছে। কিন্তু আইন মানার প্রবণতা কারও মধ্যে লক্ষ্য করা যায় না। মূলত আইন অমান্য করে গাড়ি চালানোর কারণে দেশে দুর্ঘটনা বেড়েই চলেছে। তবে পুলিশের মামলা দেওয়ার চেয়ে মানুষের সচেতনতা বৃদ্ধিতে কাজ করা জরুরি।’

সম্প্রতি দায়িত্ব নেওয়ার পর রাস্তায় ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা তদারকির সময় নিজের অভিজ্ঞতা জানাতে গিয়ে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ ডিএমপি রমনা ট্রাফিক বিভাগের উপ-পুলিশ কমিশনার জয়নুল আবেদীন বলেন, মিন্টু রোডে মোবাইলে কথা বলা অবস্থায় একটি গাড়ি চালিয়ে যাচ্ছিলেন চালক। এ সময় চালককে থামতে বলা হলে গাড়ি থামাতে গিয়ে দুর্ঘটনা ঘটায়। চলন্ত অবস্থায় মোবাইলে কথা বলা এবং দুর্ঘটনার কারণে সেই গাড়িটির বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করা হয়। এছাড়া, কানে হেডফোন লাগিয়ে গান শোনা কিংবা মোবাইলে কথা বলা অবস্থায় গাড়ি চালালে যখনই বিষয়টি ট্রাফিক সার্জেন্টদের নজরে আসে মামলা দেওয়া হয়। এ থেকে পরিত্রাণের জন্য সবচেয়ে বড় উপায় জনসচেতনতা। এ বিষয়ে চালক এবং মালিক উভয়কেই সচেতন হতে হবে। একইসঙ্গে জনসাধারণকেও সচেতন হতে হবে।

সূত্র: বাংলা ট্রিবিউন