১৫ বছর আগে মালয়েশিয়ার কুয়ালালামপুরে এসটিএস কন্সট্রাকশন কোম্পানিতে কাজের উদ্দেশে যান নেত্রকোনার আল মামুন। কাজ তার ভালোই চলছিল। কিন্তু বিপত্তি ঘটে ২০১৯ সালের এপ্রিলে। কর্মস্থলের সামনে থেকে দুর্বৃত্তরা তাকে অপহরণ করে নিয়ে যায়। এরপর দেশে থাকা মামুনের পরিবারের কাছে আট লাখ টাকা মুক্তিপণ দাবি করে অপহরণকারীরা। স্বজনরা সাড়ে তিন লাখ টাকা জোগাড় করে আত্মীয়ের মাধ্যমে মালয়েশিয়ায় পাঠান। টাকা পাওয়ার ২০ মিনিটের মধ্যে ছেড়ে দেওয়ার কথা থাকলেও গত তিন বছর ধরে মামুনের কোনও খোঁজ পাচ্ছে না তার পরিবার। তার ছেলে নাফিদুল ইসলাম ইমন জানতে চায় – বাবা বেঁচে আছে নাকি মৃত!
মামুনের পরিবারের অনুরোধ, যদি তার লাশও পাওয়া যায়, সেটা যেন সরকার দেশে এনে দাফনের ব্যবস্থা করে।
স্বজনদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ২০০৭ সালে মালয়েশিয়ার কুয়ালালামপুরে সেন্ট বালাইয়ে সিথিয়াকন বিল্ডিং কোম্পানিতে কাজ করতে যান মামুন। ২০১৯ সালের ৬ এপ্রিল তার কর্মস্থলের সামনে থেকে স্থানীয় সময় রাত সাড়ে ১০টার দিকে দুর্বৃত্তরা তুলে তাকে নিয়ে যায়। এর দুদিন পর ৮ এপ্রিল মামুনের মালয়েশিয়ার ফোন নম্বর থেকে তার স্ত্রীর ফোন করে ৮ লাখ টাকা মুক্তিপণ চাওয়া হয়। হোয়াটসঅ্যাপে মামুনের পায়ে শেকল পরানো ছবিও পাঠায় তারা।
মামুনের স্কুলপড়ুয়া ছেলে ইমন (১৫) জানায়, অপহরণের দুই দিন পর খবর আসে আমাদের কাছে। আমার বাবার নম্বর থেকেই কল করে অপহরণের বিষয়টি জানানো হয়। আমার বাবা আমাদের কল দিয়ে কান্নাকাটি করে বলেন ‘আমাকে এখান থেকে বাঁচাও, তারা আমাকে অনেক মারধর করছে, টাকা না দিলে তারা আমাকে ছাড়বে না’। মুক্তিপণ স্বরূপ চাওয়া হয় ১ লাখ রিঙ্গিত। কিন্তু আমার মায়ের অনুরোধে তারা তা কমিয়ে ১৮ হাজার রিঙ্গিতে স্থির করে।
ইমনা জানায়, কথা ছিল টাকা দেওয়ার ২০ মিনিটের ভেতরে বাবাকে ছেড়ে দেওয়া হবে। তা শুনে আমাদের নিকটাত্মীয় মালয়েশিয়া প্রবাসী আনোয়ার হোসেনকে অনুরোধ করলে তিনি আমাদের সহযোগিতা করতে রাজি হন। অপহরণের একদিন আগেই আমাদের বাসার প্রথম তলার ছাদ ঢালাই দেওয়া হয়। তাই হাতেও তেমন কোনও টাকা ছিল না। ব্যাংকে ছিল দেড় লাখ টাকা। আর বাকি টাকা নেওয়া হয় আত্নীয়স্বজনদের থেকে ধার হিসেবে, যা আজও পরিশোধ করা যায়নি। প্রথমে আনোয়ার হোসেনের মাধ্যমে সাত হাজার রিঙ্গিত অপহরণকারীদের মালয়েশিয়ার ব্যাংক অ্যাকাউন্টে দেওয়া হয়।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ১০ এপ্রিল সেই সাত হাজার রিঙ্গিত জমা দেওয়া হয় এএম আইমা এন্টারপ্রাইজ নামে খোলা একটি অ্যাকাউন্টে। আর সেদিনই মামুনের সঙ্গে শেষ কথা হয় তার পরিবারের। এরপর আর যোগাযোগ নেই। ওই ঘটনার তিন দিন পর আবার দুই হাজার ৭৫০ রিঙ্গিত আবু ইউসুফ মিয়াজির নামে একটি ব্যাংক অ্যাকাউন্টে জমা দেওয়া হয়। আর তার চার দিন পর আরও আট হাজার রিঙ্গিত জিয়াউর রহমান নামে এক ব্যক্তির ব্যাংক অ্যাকাউন্টে জমা দেওয়া হয়।
ইমন জানায়, তিন বারে মোট ১৭ হাজার ৭৫০ রিঙ্গিত দেওয়া হয়। তবুও মুক্তি মেলেনি আমার বাবার। জানি না আমার বাবার মতো এরকম আরও কতজনকে তারা অপহরণ করেছে।
এর মধ্যেই আনোয়ার হোসেন কুয়ালালামপুরের সেন্টুল থানায় একটি অভিযোগ করেন। সেই অভিযোগের ভিত্তিতে গ্রেফতার করা হয় তিনটি অ্যাকাউন্টের তিন মালিককে। তাদের থেকে জব্দ করা হয় সিসিটিভি ফুটেজ, সেখানে স্পষ্ট দেখা যায় অর্থ গ্রহীতাকে। কিন্তু কেন তাকে ধরা হয়নি সে বিষয়টা আজও পরিষ্কার হয়নি।
২০১৯ সালের ২৫ এপ্রিল পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একজন মহাপরিচালক বরাবর আল মামুনকে উদ্ধারের জন্য একটি লিখিত আবেদন করেন মামুনের স্ত্রী পারুল আক্তার। সেটি তারা মালয়েশিয়ায় অবস্থিত বাংলাদেশ হাইকমিশনে পাঠায়। কিন্তু হাইকমিশন থেকে এখন পর্যন্ত একবারই অগ্রগতি জানানো হয়। গত বছরের ৫ মার্চ হাইকমিশনে ইমেইলের মাধ্যমে ইমন জানতে চাইলে সেখান থেকে তাকে জানানো হয়, তার বাবাকে উদ্ধারে কাজ করছে হাইকমিশন।
দশম শ্রেণির ছাত্র ইমন অভিযোগ করে বলে, এরপর আমি আপডেট জানতে চাওয়ায় আমাকে ব্লক করে দেওয়া হয় হাইকমিশনের হোয়াটসঅ্যাপ নম্বরে। আমি আজও জানি না আমার বাবা জীবিত নাকি মৃত। বিভিন্ন প্রশাসনের দুয়ারে দুয়ারে ঘুরে আজ আমরা ক্লান্ত। তবুও যদি জানতে পারতাম যে কোথায় গেলে আমার বাবার সম্পর্কে জানতে পারবো তবে সেখানেই যেতাম।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে মালয়েশিয়ার বাংলাদেশ হাইকমিশনের একজন কর্মকর্তা জানান, আমি এ বিষয়ে আপডেট নেবো।