বাংলাদেশের শপিং মলগুলো ভারতীয় পোশাকে সয়লাব হলেও আজকাল ভারতীয়দের কাছে বাংলাদেশে তৈরি পোশাকের কদর বাড়ছে। রফতানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) দেশভিত্তিক পোশাক রফতানির তথ্যে এমনটিই বলা হয়েছে।
ইপিবির তথ্য অনুযায়ী, গত জুলাই মাসে ভারতে ৭ কোটি ৬৯ লাখ ৮০ হাজার ডলারের তৈরি পোশাক রফতানি হয়েছে। পরের মাস আগস্টে বাংলাদেশ থেকে ১১ কোটি ১৩ লাখ ১০ হাজার ডলারের পোশাক কিনেছেন ভারত। অর্থাৎ এক মাসের ব্যবধানে ভারতে বাংলাদেশের তৈরি পোশাক রফতানি বেড়েছে ৩ কোটি ৪৩ লাখ ৩০ হাজার ডলার।
ইপিবির তথ্য বলছে, চলতি অর্থবছরের প্রথম দুই মাসে (জুলাই ও আগস্ট) আগের অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় ভারতের বাজারে বাংলাদেশের তৈরি পোশাক রফতানি বেড়েছে দ্বিগুণেরও বেশি।
চলতি বছরের জুলাই ও আগস্ট— এই দুই মাসে ভারতে প্রায় ১৮ কোটি ৮২ লাখ ৯০ হাজার ডলারের তৈরি পোশাক রফতানি করেছেন বাংলাদেশের রফতানিকারকরা। এই অঙ্ক ২০২১ সালের একই সময়ের চেয়ে প্রায় ৯৯ শতাংশ বেশি। গত অর্থবছরের এই দুই মাসে দেশটিতে ৯ কোটি ৪৬ লাখ ৬০ হাজার ডলারের পোশাক রফতানি করেছিল বাংলাদেশ।
শুধু পোশাক রফতানিই নয়, ভারতের বাজারে অন্যান্য পণ্যের রফতানিও বেড়েছে। ইপিবির তথ্য অনুযায়ী, অতীতের সব রেকর্ড ছাড়িয়ে গত অর্থবছরে (২০২১-২২) ভারতে বাংলাদেশের রফতানি ২০০ কোটি (২ বিলিয়ন) ডলারের ঘরে পৌঁছে, যা ছিল আগের অর্থবছরের (২০২০-২১) চেয়ে ৫৫ দশমিক ৬২ শতাংশ বেশি। দেখা গেছে, চলতি অর্থবছরের প্রথম মাস জুলাইয়ে রফতানি বেড়েছে ২০ দশমিক ৫৩ শতাংশ।
উদ্যোক্তারা বলছেন, বাংলাদেশি পণ্যের গুণগত মান ভালো হওয়ায় চাহিদা বাড়ছে ভারতে। চলতি বছরের জুলাই-আগস্ট সময়ে ভারতে ওভেন পোশাক রফতানি হয়েছে ১০ কোটি ৫৯ লাখ ৭০ হাজার ডলারের। গত বছরের একই সময়ে ওভেন পোশাক রফতানি হয়েছিল ৫ কোটি ২৭ লাখ ৬০ হাজার ডলারের। অর্থাৎ প্রবৃদ্ধি হয়েছে ১০০ দশমিক ৮৫ শতাংশ। আর চলতি অর্থবছরের প্রথম দুই মাসে নিট পোশাক রফতানি থেকে এসেছে ৮ কোটি ২৩ লাখ ২০ হাজার ডলার। গত অর্থবছরে একই সময়ে রফতানি হয়েছিল ৪ কোটি ১৯ লাখ ডলার। অর্থাৎ গত বছরের তুলনায় এবার নিট পোশাক রফতানি বেড়েছে ৯৬ দশমিক ৪৮ শতাংশ।
তৈরি পোশাক খাতের উদ্যোক্তারা বলছেন, বেশ কিছু কারণে ভারতের বাজারে বাংলাদেশের তৈরি পোশাকের বড় সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে। তারা বলছেন, বাংলাদেশ ও ভারত দুই দেশই কাছাকাছি উৎস থেকে পণ্য সংগ্রহের দিকে মনোযোগ বাড়িয়েছে। এছাড়া সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে যোগাযোগের উন্নতি এ ক্ষেত্রে বড় প্রভাব ফেলেছে। অর্থাৎ, ভৌগোলিক কারণেই ভারতে বাংলাদেশের রফতানি বাড়ছে।
গার্মেন্ট খাতের উদ্যোক্তারা জানান, ভারতের অনেক ব্যবসায়ী এখন বাংলাদেশের কারখানায় পোশাক তৈরি করে নিজেদের দেশে নিয়ে গিয়ে বিক্রি করছেন। এতে তাদের একদিকে যেমন লিড টাইম কম লাগছে, অপরদিকে খরচও কম হচ্ছে। এছাড়া ভারতে নিম্ন ও মধ্যবিত্ত শ্রেণি দ্রুত বিকশিত হচ্ছে। সেই সঙ্গে দেশটিতে বাড়ছে ব্র্যান্ড-সচেতনতা। এ কারণে সেখানে স্থানীয় ব্র্যান্ডগুলোও শক্ত অবস্থান তৈরি করছে। পাশাপাশি আন্তর্জাতিক ব্র্যান্ডগুলোও যখন দেশটিতে নতুন নতুন বিক্রয়কেন্দ্র খুলতে শুরু করেছে— ঠিক এমন সময় বৈশ্বিক অর্থনৈতিক সংকট বাড়ছে। অর্থাৎ এই সংকট থেকে উত্তরণে প্রায় দেড়শ’ কোটি লোকের চাহিদা মেটাতে হলে ভারতকে বাংলাদেশ থেকেই পোশাক কিনতে হবে। কারণ,ভারতে পোশাক তৈরিতে যে খরচ হয়, বাংলাদেশ থেকে আমদানি করলে তার থেকে অনেক কম পড়ে। সে কারণে সব হিসাব-নিকাশ করেই তারা এখন বাংলাদেশ থেকে বেশি বেশি পোশাক কিনছে।
এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশের তৈরি পোশাক শিল্প মালিকদের সংগঠন বিকেএমিএ’র নির্বাহী সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘তুলনামূলক কোয়ালিটি ভালো, এবং দামও কম থাকায় ভারতীয়রা আমাদের তৈরি পোশাকের প্রতি ঝুঁকছে।’ তিনি বলেন, ‘আমরা যদি ভারতের বাজার ভালোভাবে ধরতে পারি, তাহলে আমাদের আর পেছনে ফিরে তাকাতে হবে না। কেননা, ভারত আমাদের পাশের দেশ, পরিবহন খরচ খুবই কম পড়বে। আমাদের মুনাফাও বেশি হবে।’ তিনি জানান, আমাদের কারখানার মালিকদের অনেকেরই ভারতীয় অর্ডার বাড়ছে। আমরাও পোশাক তৈরির জন্য প্রস্তুত।
ইপিবি’র তথ্যে দেখা যায়, গত অর্থবছরে ভারতে ১৯৯ কোটি ১৩ লাখ ৯০ হাজার ডলারের পণ্য রফতানি হয়েছে। এরমধ্যে পোশাক রফতানি হয়েছে ৭১ কোটি ৫৪ লাখ ১০ হাজার ডলার।
জানা গেছে, ২০১১ সালের শেষের দিকে বাংলাদেশের বেশ কিছু কারখানার কাছ থেকে পোশাক নিয়ে টাকা দেয়নি ভারতীয় কোম্পানি লিলিপুট। সে জন্য ওই সময় থেকে বেশ কয়েক বছর ভারতে পোশাক রফতানিতে ভাটা পড়ে। কিন্তু গত কয়েক বছরে ভারতের বিভিন্ন শহরে পোশাকের নামিদামি বিদেশি অনেক ব্র্যান্ড বিক্রয়কেন্দ্র খোলায় পোশাক রফতানি বৃদ্ধি পায়।
যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক আন্তর্জাতিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান ম্যাকেঞ্জি অ্যান্ড কোম্পানির এক প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, ২০২২ সালে ভারতের কাপড়ের বাজার হবে ৫ হাজার ৯০০ কোটি ডলারের।
রফতানি উন্নয়ন ব্যুরোর তথ্য অনুযায়ী, ২০২০-২১ অর্থবছরে ভারতে ১২৭ কোটি ৯৬ লাখ ডলারের পণ্য রফতানি করা হয়। ২০১৯-২০ অর্থবছরে রফতানি হয় ১০৯ কোটি ৬১ লাখ ৬০ হাজার ডলার। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ভারতে ১২৫ কোটি ডলারের পণ্য রফতানি করেছিল বাংলাদেশ।
প্রসঙ্গত, বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে প্রথম বাণিজ্য চুক্তি সই হয়েছিল ১৯৭২ সালে এবং এটি ২০১৫ সালে স্বয়ংক্রিয়ভাবে নবায়ন হয়েছে। এদিকে বাংলাদেশের স্থিতিশীল অর্থনৈতিক উন্নয়ন ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলোর জন্য নতুন সুযোগ সৃষ্টি করছে।