গত তিন মাসে দেশের শীর্ষ ১০ ওষুধ কোম্পানির অর্ধশতাধিক ওষুধের দাম বেড়েছে। কোম্পানিগুলো হলো স্কয়ার, বেক্সিমকো, এসকেএফ, অপসোনিন, ইনসেপ্টা, এরিস্টোফার্মা, সানোফি, রেডিয়েন্ট, রেনেটো ও একমি। এসব কোম্পানি তাদের উৎপাদিত এসব ওষুধের দাম সর্বনিম্ন ৬ থেকে সর্বোচ্চ ৮২ শতাংশ পর্যন্ত বাড়িয়েছে।
এসব ওষুধের মধ্যে রয়েছে অ্যান্টিবায়োটিক, ব্যথা উপশম, বিভিন্ন ধরনের ভিটামিন, ক্যালসিয়াম, কোলেস্টেরল, ঠান্ডা, কাশি, হাঁপানি, অ্যালার্জি, গ্যাস্ট্রিক, উচ্চ রক্তচাপ, আমাশয়, জ্বর ও ডায়াবেটিসের ওষুধ। এ ছাড়া জন্মনিরোধক সামগ্রী কনডম, ডায়াবেটিক রোগীর সুগার মাপার মেশিন ও স্ট্রিপ, নেবুলাইজার মেশিন, রক্তচাপ মাপার মেশিনের দামও বেড়েছে।
ওষুধ কোম্পানির কর্মকর্তারা বলেছেন, ডলারের দাম বাড়ায় টাকার ৩০ থেকে ৩৫ শতাংশ অবমূল্যায়ন হয়েছে। ওষুধের কাঁচামাল, প্যাকেজিং ও বিদ্যুৎ সবকিছুতেই দাম বেড়েছে। কিন্তু সেভাবে ওষুধের মূল্য সমন্বয় হয়নি। সে জন্য তারা এটাকে মূল্যবৃদ্ধি না বলে উৎপাদন ব্যয়ের সঙ্গে সংগতি রেখে দামের সমন্বয় বলছেন।
ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরের মুখপাত্র ও উপ-পরিচালক আইয়ুব হোসেন বলেন, সরকার নিয়ন্ত্রিত ওষুধের মধ্যে গত জুনে ৫৩টি ওষুধের দাম সমন্বয় করেছে সরকার। এ রকম ১১৭টি জেনেরিকের বিভিন্ন ওষুধের মূল্য সরকার নিয়ন্ত্রণ করে। বাকি ওষুধগুলোর মূল্যবৃদ্ধির জন্য কোম্পানিগুলো আবেদন করে। আমরা সেটা যৌক্তিক হলে অনুমোদন দিয়ে দিই। কোম্পানিগুলো ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরের অনুমোদন নিয়েই মূল্যবৃদ্ধি করে।
এ ব্যাপারে বাংলাদেশ কেমিস্ট অ্যান্ড ড্রাগিস্ট সমিতির পরিচালক জাকির হোসেন রনি বলেন, গত বছরের জুনের দিকে প্রথম যখন ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তর তাদের নিয়ন্ত্রিত ওষুধের মধ্যে ৫৩টি ওষুধের দাম বাড়াল, এরপর থেকে ‘টপ টেন’ (শীর্ষ ১০) কোম্পানির অন্যান্য ওষুধের দামও বাড়ছে। যাদের প্রাত্যহিক ওষুধ লাগে, দাম বাড়লেও তাদের ওষুধ কিনতে হবেই। ফলে বাধ্য হয়ে রোগীরা মাঝারি মানের যেসব কোম্পানি আছে, তাদের ওষুধ কম দামে কিনবেন। মানহীন ওষুধের দিকে ঝুঁকবেন। স্কয়ারের, সর্বোচ্চ ৮২% : শীর্ষ ১০ কোম্পানির মধ্যে সবচেয়ে বেশি দাম বেড়েছে স্কয়ার কোম্পানির ওষুধ। ১৮ ধরনের ওষুধের সর্বনিম্ন ৬ থেকে সর্বোচ্চ ৮২ শতাংশ পর্যন্ত দাম বাড়িয়েছে কোম্পানিটি। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি দাম বেড়েছে শিশুদের নাকের ড্রপ এন্টাজল (০০.৫%) ও প্রাপ্তবয়স্কদের নাকের ড্রপ এন্টাজলের (০.১%)। প্রথমটি ১১ থেকে ১৮ টাকা ও দ্বিতীয়টি ১১ থেকে ২০ টাকা হয়েছে। এই ওষুধের দাম যথাক্রমে ৬৪ ও ৮২ শতাংশ বেড়েছে।
আমাশয় রোগীদের পেটের সমস্যায় ব্যবহৃত প্রতি পিস প্রোবায়ো ক্যাপসুল ১৬ থেকে ২৫ টাকা হয়েছে। দাম বেড়েছে ৯ টাকা বা ৫৬ শতাংশ। ডায়াবেটিসের প্রতিটি কমপ্রিট (৪০ এমজি) ট্যাবলেট ৭ থেকে ৮, কাশির তুসকা প্লাস (১০০ মিলি) সিরাপ ৮০ থেকে ৮৫ ও ক্যালসিয়ামের এক কৌটা নিউরো-বি ট্যাবলেটের দাম ২৭০ থেকে ৩০০ টাকা হয়েছে।
গ্যাস্ট্রিকের ওষুধ অ্যান্টাসিড প্লাস ১০টি ট্যাবলেটের এক পাতার দাম ২০ থেকে ২৫ টাকা হয়েছে। অ্যান্টিবায়োটিক সেফ-৩ (২০০ মিগ্রা) ট্যাবলেট প্রতিটি ৩৫ থেকে ৪০ ও সেফ-৩ (৪০০ মিগ্রা) ৫০ থেকে ৬০ টাকা হয়েছে। উচ্চ রক্তচাপের ট্যাবলেট বিসকোর (২.৫ মিগ্রা) ৬ থেকে ৭ ও অ্যালার্জির প্রতিটি ফেক্সো (১২০ মিগ্রা) ট্যাবলেট ৮ থেকে ৯ টাকা হয়েছে।
অ্যান্টিবায়োটিক ট্যাবলেট সেফোটিল প্লাস (৫০০ এমজি) এক পাতা (১২টা) ৫০ থেকে ৬০ ও মোক্সাসিল (১০০ মিলি) সিরাপ ৪৭ থেকে ৭০ টাকা হয়েছে। অর্থাৎ এই দুই ধরনের ওষুধের দাম বেড়েছে যথাক্রমে ২০ শতাংশ ও ৪৯ শতাংশ। অ্যান্টিবায়োটিক ট্যাবলেট জিম্যাক্স (৫০০ মিগ্রা) প্রতিটি ৩০ থেকে ৪০ টাকা হয়েছে। এটি ব্যাকটেরিয়া দ্বারা সৃষ্ট রোগ ব্রংকাইটিস এবং নিউমোনিয়াসহ নিম্ন শ্বাসনালির সংক্রমণ প্রতিরোধে ব্যবহার করা হয়। ক্যালসিয়াম ও ভিটামিন-ডি’র ঘাটতি পূরণে ব্যবহৃত ক্যালবো-ডি ট্যাবলেটের একটি কৌটা (৩০টি) ২১০ থেকে ২৪০ টাকা হয়েছে। ঠান্ডা, সর্দি, চুলকানি ও অ্যালার্জির ট্যাবলেট ফেক্সো (১২০ মিগ্রা) ৮ থেকে ৯ টাকা হয়েছে। কাশির সিরাপ ওকফ ১০০ থেকে ১১০ টাকা হয়েছে।
দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ৭৫% বেক্সিমকোর : এই কোম্পানির চার ওষুধের দাম বেড়েছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি বেড়েছে শিশুদের জ্বরের চিকিৎসায় ব্যবহৃত নাপা ড্রপ ও নাপা সিরাপ (৬০ মিলি)। প্রথমটি ১৫ থেকে ২০ টাকা ও দ্বিতীয়টি ২০ থেকে ৩৫ টাকা হয়েছে। এই দুই ড্রপের দাম বেড়েছে যথাক্রমে ৩৩ শতাংশ ও ৭৫ শতাংশ। অ্যাটোভা (১০ মিগ্রা) ট্যাবলেটের দাম ১০ থেকে ১২ টাকা ও অ্যাটোভা (২০ মিগ্রা) ১৮ থেকে ২০ টাকা হয়েছে। এ ওষুধ দুটি কোলেস্টেরল নিয়ন্ত্রণে ব্যবহার হয় ও প্রচুর বিক্রি হয়।
তৃতীয় সর্বোচ্চ দাম দুই কোম্পানির : মূল্যবৃদ্ধির তৃতীয় নম্বরে আছে এসকেএফ ও অপসোনিন। এই দুই কোম্পানির প্রচুর বিক্রি হয় এমন চারটি ওষুধের দাম বাড়ানো হয়েছে। এর মধ্যে এসকেএফের তৈরি শিশুদের জিংক সিরাপ (১০০ মিলি) ৩৫ থেকে ৫০ টাকা হয়েছে। বেড়েছে ৪৩ শতাংশ।
অপসোনিন ফার্মা লিমিটেডের উচ্চ রক্তচাপের প্রতি পিস বিসলল-ম্যাক্স (২.৫ এমজি) ট্যাবলেট ৬ থেকে ৮ ও ১৪টির এক পাতা বিসলল (৫ এমজি) ট্যাবলেট ৮৪ থেকে ১১২ টাকা হয়েছে। এ ছাড়া গ্যাস্ট্রিকের প্রতিটি ফিনিক্স (২০ এমজি) ট্যাবলেট ৫ থেকে ৭ টাকা হয়েছে।
সর্বোচ্চ ২৫-৩৩% তিন কোম্পানির : তিন কোম্পানির ৯টি ওষুধের দাম বেড়েছে। এই ওষুধগুলো সবচেয়ে বেশি বিক্রি হয়। এর মধ্যে ইনসেপ্টার তৈরি উচ্চ রক্তচাপের প্রতি পিস ওসারটিল (৫০ এমজি) ট্যাবলেট ৮ থেকে ১০ ও গ্যাস্ট্রিকের ট্যাবলেট ওমিডন (১০ এমজি) ৩ থেকে ৪ টাকা হয়েছে। বেড়েছে ৩৩ শতাংশ।
এরিস্ট্রোফার্মার মাল্টিভিটামিন ১৫টি ট্যাবলেটের এক কৌটা ১০৫ থেকে ১৩৫ ও ৩০টি ট্যাবলেটের এক কৌটা ২১০ থেকে ২৭০ টাকা হয়েছে। টাইপ-২ ডায়াবেটিসের ট্যাবলেট ৩০টির এক বক্স লিনাগ্লিপ (৫ মিগ্রা) ৬০০ থেকে ৬৬০ টাকা হয়েছে। উচ্চ রক্তচাপের ট্যাবলেট ৩০টির এক বক্স রুভাসটিন (৫ মিগ্রা) ৩০০ থেকে ৩৬০ টাকা হয়েছে।
সানোফি কোম্পানির ডায়াবেটিক রোগীদের লেনটাস ফ্লেক্সপেন ইনসুলিন ১২২০ থেকে ১৫০০ টাকা ও লেনটাস পেনফিল রিফিল ৭৮৪ থেকে ৯৮২ টাকা হয়েছে।
প্রায় সব ওষুধের দাম বেড়েছে রেডিয়েন্টের : ফার্মেসির ওষুধ বিক্রেতারা জানিয়েছেন, রেডিয়েন্ট ফার্মার প্রায় সব ওষুধের দামই বেড়েছে। এসব ওষুধের বিক্রিও বেশি। এমন কিছু ওষুধ আছে, যার বিক্রি দেশের তিন শীর্ষ ওষুধ কোম্পানির বিক্রির চেয়ে বেশি। এর মধ্যে ঘুমের ওষুধ রিভোট্রিল (০.৫ মিগ্রা) ১০টি ট্যাবলেটের এক পাতার দাম ৮০ থেকে ৯০, রিভোট্রিল (১ মিগ্রা) ৯০ থেকে ১১০ ও রিভোট্রিল (২ মিগ্রা) ১৩০ থেকে ১৪০ টাকা হয়েছে।
এই কোম্পানির আরেকটি ঘুমের ওষুধ লেক্সোটানিল (৩ মিগ্রা) এক পাতার দাম ৮০ থেকে ৯০ টাকা হয়েছে। ক্যালসিয়াম ও ভিটামিন-ডি জাতীয় ট্যাবলেট কোরালক্যাল-ডি’র এক পাতা ১১০ থেকে ১২০ ও কোরালক্যাল-ডিএক্স ১৫০ থেকে ১৬০ টাকা হয়েছে। মন্টিলুকাস্ট গ্রুপের ঠা-ার ওষুধ জাইফ্লো (১০ মিগ্রা) এক পাতা ট্যাবলেট (১০টা) ১৬০ থেকে ১৭০ টাকা হয়েছে। পেইনকিলার ন্যাপ্রোসিন (৫০০ মিগ্রা) ট্যাবলেট এক পাতা (১০টা) আগে ছিল ১৫০, এখন ১৬০ টাকা।
দাম বেড়েছে স্যালাইন ও কনডমের : এসএমসি কোম্পানির মুখে খাওয়ার স্যালাইন ওরস্যালাইন-এন প্রতি প্যাকেটের দাম ১ থেকে ৬ টাকা হয়েছে। একই কোম্পানির জন্মনিরোধক সামগ্রী সেনসেশন কনডম প্রতি প্যাকেট ২৫ থেকে ৪০, প্যানথার কনডম ১৫ থেকে ২৫ টাকা হয়েছে। অর্থাৎ এই দুই ধরনের কনডমের দাম বেড়েছে যথাক্রমে ৬০ ও ৬৬ শতাংশ।
একমি ও রেনেটারও দাম বাড়িয়েছে : একমি কোম্পানির মন্টিকুলাস্ট গ্রুপের অ্যালার্জি ও ঠা-ার ওষুধ মোনাস (১০ মিগ্রা) প্রতি ট্যাবলেটের দাম ১৬ থেকে ১৭ টাকা ৫০ পয়সা হয়েছে। রেনেটার তৈরি অ্যালার্জির প্রতি পিস ফেনাডিন (১২০ এমজি) ট্যাবলেট ৮ থেকে ৯ টাকা হয়েছে। দাম বেড়েছে ১২ শতাংশ।
বেড়েছে অন্যান্য সামগ্রীর দাম : ওষুধ বিক্রেতারা জানান, জার্মানের নামকরা কোম্পানি অ্যাকু-চেক উৎপাদিত ডায়াবেটিক রোগীর সুগার মাপার মেশিন অ্যাকু-চেকের দাম আগে ছিল ২৬৫০ টাকা, এখন হয়েছে ৩২০০ টাকা। একই কোম্পানির সুগার মাপার স্ট্রিপ অ্যাকু-কে স্ট্রিপ ১১২০ থেকে ১৩০০ টাকা হয়েছে। এগুলো ছাড়াও আমদানি করা নেবুলাইজার মেশিন, রক্তচাপ মাপার মেশিন প্রতিটির দাম কমবেশি ৫০০-৭০০ টাকা বেড়েছে।