বিবেকানন্দের জীবন ছোট, কর্ম অসাধারণ : বিভাগীয় কমিশনার

সিলেটের বিভাগীয় কমিশনার (অতিরিক্ত সচিব) ড. মুহাম্মদ মোশাররফ হোসেন বলেছেন, ‘বিবেকানন্দের জীবন ছোট, তার কর্ম অসাধারণ। তিনি জাতীয়তাবাদকে সারাবিশ্বে ছড়িয়ে দিয়েছেন। মানুষকে ভালোবাসতে, প্রতিটি জীবকে ভালোবাসতে শিখিয়েছেন। তাঁর দর্শন ও চিন্তা সমাজে ছড়িয়ে দিতে পারলেই সমাজে শান্তি ফিরে আসবে।’

বুধবার (২২ ফেবব্রুয়ারি) সন্ধ্যায় নগরের নাইওরপুলস্থ রামকৃষ্ণ মিশন আশ্রমে চার দিনব্যাপী উৎসবের দ্বিতীয় দিনের আলোচনায় প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি এসব কথা বলেন। রামকৃষ্ণদেবের ১৮৮তম আবির্ভাব ও বার্ষিক উৎসব উপলক্ষে এ অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়।

গত মঙ্গলবার (২১ ফেব্রুয়ারি) থেকে শুরু হওয়া এ উৎসব চলবে আগামী ২৪ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত।

উপাধ্যক্ষ (অব.) সুষেন্দ্র কুমার পালের সভাপতিত্বে ‘স্বামী বিবেকানন্দ ও যুবসমাজ’ শীর্ষক এ আলোচনা অনুষ্ঠানে স্বাগত বক্তব্য দেন, রামকৃষ্ণ মিশন আশ্রম পরিচালনা কমিটির সম্পাদক, অধ্যক্ষ শ্রীমৎ স্বামী চন্দ্রনাথানন্দ মহারাজ। বিশেষ অতিথি ছিলেন, সিলেটের জেলা প্রশাসক মো. মজিবর রহমান।

মূখ্য আলোচক ছিলেন, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের অধ্যাপক ড. হিমাদ্রী শেখর রায়। আলোচক ছিলেন, সিলেট প্রেসক্লাবের সাবেক সভাপতি ও দৈনিক সিলেট মিরর সম্পাদক আহমেদ নূর, প্রকৌশলী সুধাময় দেব ও অ্যাডভোকেট বিজয় কৃষ্ণ বিশ্বাস। ধন্যবাদ বক্তব্য দেন, পান্না লাল রায়। অনুষ্ঠান পরিচালনা করেন, রিপন তালুকদার।

প্রধান অতিথির বক্তব্যে বিভাগীয় কমিশনার আরও বলেন, ‘প্রকৃত ধর্ম হলো মানুষকে ভালোবাসা। সৃষ্টিকর্তা একজন, তিনিই সব মানুষকে সৃষ্টি করেছেন। তাই, স্রষ্টার সৃষ্ট সব জীবকে ভালোবাসা গেলে সৃষ্টিকর্তাকে ভালোবাসা হয়। এটিই বলতে চেয়েছেন বিবেকানন্দ।’

তিনি বলেন, ‘বাঙালি জাতি আবেগপ্রবণ জাতি। আমরা এই জাতিকে শৃংখলার মধ্যে রাখতে চাই। এইসব মহামানবদের জীবন যত বেশি আলোচনা করা যাবে, এ থেকে আমরা উপকৃত হব।’ সম্মিলিতভাবে একটি অসাম্প্রদায়িক ও ১৯৪১ সালের মধ্যেই জাতির পিতার স্বপ্নের সোনার বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার আহ্বান জানান তিনি।

বিশেষ অতিথির বক্তব্যে সিলেটের জেলা প্রশাসক মো. মজিবর রহমান বলেন, ‘যুবক তারাই যাদের মধ্যে তেজস্বতা, পুরাতনকে ভেঙে নতুন কিছু করার মানসিকতা রয়েছে। কিন্তু, আজ আমাদের যুব সমাজের মধ্যে হতাশা বিরাজ করছে, নতুন কিছু তৈরি, জানার আগ্রহ তেমন জাগ্রত হচ্ছে না।’

তিনি বলেন, ‘বিবেকানন্দের দর্শন ও চিন্তায় আমাদের যুব সমাজকে জাগ্রত করতে হবে। তিনি ভয়, দুশ্চিন্তা ও হতাশা থেকে দূরে থাকতে বলেছেন। জীবনের প্রতি ভালোবাসা ও জীবের প্রতি ভালোবাসার মাধ্যমে পৃথিবীকে জয় করতে বলেছেন। তার এই আদর্শ যুব সমাজে ছড়িয়ে দিতে হবে।’

মূখ্য আলোচকের বক্তব্যে ড. হিমাদ্রী শেখর রায় বলেন, ‘বিবেকানন্দ প্রাচ্য সম্পর্কে প্রাশ্চাত্যের ধারণা বদলে দিয়েছিলেন।’

তিনি বলেন, ‘বিবেকানন্দ যুব সমাজের জন্য অনুপ্রেরণার উৎস। আজ যুবকদের মধ্যে হতাশা তৈরি হচ্ছে বলে তারা আত্মহত্যা করছে। ইচ্ছাশক্তি হারিয়ে ফেলছে বলে তারা এটা করছে। যুবকদের এ ধরনের কাজ থেকে বিরত থাকতে বলেছেন বিবেকানন্দ। তিনি যুবককে ভাবতে বলেছেন। তিনি বলেছেন- মানুষের ইচ্ছাশক্তির উপর আর কিছু নেই।’

স্বামী বিবেকানন্দের দর্শন জানা ও লালন করার আহ্বান জানিয়ে অধ্যাপক হিমাদ্রী শেখর রায় বলেন, ‘অহংকার ত্যাগ করতে হবে, বিনয়ী হতে হবে। উচ্চমানের চিন্তা রাখতে হবে। খারাপ চিন্তা মাথায় সুযোগ দেওয়া যাবে না। ঘৃণা নয়, ভালোবাসা দিয়ে বিশ্বকে জয় করতে হবে।’

আলোচকের বক্তব্যে সিলেট প্রেসক্লাবের সাবেক সভাপতি আহমেদ নূর বলেন, ‘বিবেকানন্দ একজন সমাজতান্ত্রিক লোক ছিলেন। সত্যিকার অর্থে তাঁর মা তাকে মানুষ করে গড়ে তুলেছিলেন। পরবর্তীতে তিনি সবাইকে প্রকৃত মানুষ হওয়ার আহ্বান করেছেন।’

তিনি বলেন, ‘মানুষ যা চিন্তা করে তারুণের শক্তি দিয়ে তা বাস্তবায়ন করা সম্ভব। শক্তি না থাকলে মৃত্যু অনিবার্য। এ জন্য তিনি মনের শক্তি বাড়ানোর তাগিদ দিয়েছেন।’ ভারতবর্ষকে জানতে হলে আগে বিবেকানন্দকে জানার আহ্বান জানান তিনি।

আলোচকের বক্তব্যে প্রকৌশলী সুধাময় দেব বলেন, ‘বিবেকানন্দকে জানতে হলে তার দর্শনকে জানতে হবে এবং সে অনুযায়ী নিজেকে তৈরি করতে হবে।’

তিনি বলেন, ‘বিবেকানন্দ চেয়েছেন তোমরা আদর্শ মানুষ হও। যুবকদের প্রতি এই আহ্বান ছিল তার। দৈহিক, মানসিক ও আধ্যাত্মিক উন্নতির মাধ্যমে সর্বক্ষেত্রে উন্নতি সাধন করা সম্ভব। তাই, খেলাধুলা ও ধর্ম শিক্ষার কথা তিনি বলেছেন। তিনি ভারতবর্ষে জেগে ওঠার ডাক দিয়েছিলেন, ভারত জেগে উঠেছিল। আজও তার এই ডাক প্রাসঙ্গিক।’
তিনি আরও বলেন, শিল্পবিপ্লবের পর এখন শিক্ষা বিপ্লব চলছে। শিক্ষার তিনটি মূল্যবোধ হলো- সত্যবাদিতা, জিতেন্দ্রীয় তথা আত্মনিয়ন্ত্রণ এবং পরোপকার। এই তিন গুণ ছাড়া প্রকৃত মানুষ হওয়া যায় না। বিবেকানন্দ এই বাণীই প্রচার করেছেন।’

আলোচকের বক্তব্যে বিজয় কৃষ্ণ বিশ্বাস বলেন, ‘স্বামী বিবেকানন্দ আজও প্রাসঙ্গিক। যুব শক্তিতে বলিয়ান হয়ে সমাজের ভেদাভেদ দূর করতে জাগরণ প্রয়োজন। হিংসা-হানাহানি দূর করে পুষ্পিত কানন গড়ে তুলতে হবে।’
আলোচনা অনুষ্ঠান শেষে বিশেষ সঙ্গীতানুষ্ঠান আয়োজন করা হয়। রানা কুমার সিনহা, বিজন রায়, প্রতীক এন্দ, অনিমেষ বিজয় চৌধুরী রাজু, সমরেন্দ্র বিশ্বাস ও অশোক আচার্য্য এতে অংশ নেন।

বুধবার সকাল ১১টায় সঙ্গীতাঞ্জলির মধ্য দিয়ে দ্বিতীয় দিনের কর্মসূচি শুরু হয়। রামকৃষ্ণ কথামৃত পাঠ চক্র, দক্ষিণ সুরমা এ অনুষ্ঠান পরিবেশন করে। দুপুর সাড়ে ১২টায় হবিগঞ্জের বাহুবলের কবি রত্ন শ্রী মণি নাথ কৃষ্ণাল পদাবতীকীর্তন পরিবেশন করেন। বিকেল ৪টায় বিবেকানন্দ বিদ্যার্থী ভবনের প্রাক্তন শিক্ষার্থীরা ভজন সঙ্গীত পরিবেশন করেন। বিকেল ৫টায় সিলেটের অনিমেষ বিজয় চৌধুরী উপস্থাপন করেন গীতি আলেখ্য।

সন্ধ্যায় আলোচনা সভা শেষে রাত ৮টায় চার দিনব্যাপী অনুষ্ঠান মঙ্গলবার (২১ ফেব্রুয়ারি) ভোর ৫টায় মঙ্গলরতি ও স্তোত্রপাঠের মাধ্যমে শুরু হয়। সকাল ৭টায় রামকৃষ্ণ লীলা প্রসঙ্গ, গীতা ও চন্ডীপাঠ, ৮টায় ঠাকুরের বিশেষ পূজা, হোম, সাড়ে ৯টায় যন্ত্র সঙ্গীত পরিবেশন করেন হেমেন্দ্র সূত্রধর।

সকাল সাড়ে ১০টায় সঙ্গীতাঞ্জলি পরিবেশন করে নগরের করেরপাড়ার আলোকিত কথামৃত পাঠচক্র, দুপুর ১২টায় লীলাকীর্তন পরিবেশন করেন দেবল দাস। বেলা দুইটায় বাউল গান পরিবেশন করেন গোয়ালাবাজারের পঙ্কজ দেব, বিকেল সাড়ে ৩টায় শিশুকিশোরদের সঙ্গীত ও আবৃত্তি পর্ব এবং সাড়ে ৪টায় ছিল সুবিনয় রায়ের সঙ্গীতালেখ্য।

সন্ধ্যায় আলোচনা সভা ও শিক্ষাবৃত্তি বিতরণ করা হয়। এতে প্রধান অতিথি ছিলেন সিলেট সিটি করপোরেশনের মেয়র আরিফুল হক চৌধুরী।

তিনি বলেন, ‘রামকৃষ্ণ মিশনের কার্যক্রম অত্যন্ত প্রশংসনীয়। বিশেষ করে ধর্ম-বর্ণের বিভেদ সৃষ্টি না করে সব ধর্মের মানুষের জন্য যে সব সেবা চালু করা হয়েছে তা অতুলনীয়। এ ধরনের উদ্যোগ একটি সুখী-সমৃদ্ধ ও শান্তিময় সমাজ প্রতিষ্ঠায় অগ্রণী ভূমিকা রাখবে।’

মদন মোহন কলেজের প্রাক্তন অধ্যক্ষ, অধ্যাপক বিজিত কুমার দে’র সভাপতিত্বে এ অনুষ্ঠানে স্বাগত বক্তব্য দেন, রামকৃষ্ণ মিশন আশ্রম পরিচালনা কমিটির সম্পাদক, অধ্যক্ষ শ্রীমৎ স্বামী চন্দ্রনাথানন্দ মহারাজ।

সম্মানিত অতিথি ছিলেন, মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা বোর্ড, সিলেটের চেয়ারম্যান অধ্যাপক রমা বিজয় সরকার। বিশেষ অতিথি ছিলেন, সিলেট জেলা প্রেসক্লাবের সাবেক সভাপতি আল আজাদ। ‘রামকৃষ্ণ মিশনের সেবাধর্ম’- শীর্ষক আলোচনায় আলোচক ছিলেন, ডা. কল্লোল বিজয় কর ও বাংলাদেশের ব্যাংকের যুগ্ম পরিচালক (অবসরপ্রাপ্ত) বিকাশ রঞ্জন বিশ্বাস।

রামকৃষ্ণ মিশনের সদস্য অরূপ বিজয় চৌধুরীর পরিচালনায় অনুষ্ঠানের শুরুতে বৈদিক সুক্ত পাঠ করেন, বিবেকানন্দ বিদ্যার্থী ভবনের শিক্ষার্থীরা। অনুষ্ঠানের শেষ পর্যায়ে ধন্যবাদ জ্ঞাপন করেন, অ্যাডভোকেট সনতু দাস। পরে, বিশেষ সঙ্গীতানুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। পরিবেশন করেন, হিমাংশু বিশ্বাস ও হিমাংশু গোস্বামী।

এর আগে অনুষ্ঠানের শুরুতে শিক্ষার্থীদের হাতে মিশনের পক্ষ থেকে শিক্ষাবৃত্তি প্রদান করা হয়। সিলেটের ১০টি উচ্চ বিদ্যালয়ের ৪০ জন, এমসি কলেজের ১০ জন এবং বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের আরও ১৫ জনসহ মোট ৬৫ জনকে ৫ হাজার টাকা করে শিক্ষাবৃত্তি তুলে দেওয়া হয়।