সিলেটের জেলা প্রশাসক মো. মজিবর রহমান বলেছেন, বাপার সাথে সরকারের নীতি, আইন-কানুন, বিধিবিধানে কোনো গড়মিল বা ফারাক নেই। বাপা যে কাজটি আন্দোলন করে মানুষের মধ্যে সচেতনতা সৃষ্টি করছে, সরকার সেটা আইন প্রয়োগের মাধ্যমে বাস্তবায়ন করে সেই একই কাজ করছে। বাপার মতোই সরকারের উদ্দেশ্য হাওর-নদীকে রক্ষা করা। আজকের আলোচনায় সুরমা নদীর বিষয়ে বেশ কিছু কথা এসেছে, আমরা সেগুলো দেখবো। সুরমা নদীর পাড়ে খুব বেশি ইন্ডাস্ট্রিজ নেই, তাই খুব একটা দূষণ হচ্ছে না। সুরমাতে যে বর্জ্য যায়, সেটি প্রতিদিনের বাজার-হাট বা গৃহস্থালির ময়লা। এটা সিটি করপোরেশনের মাধ্যমে ব্যবস্থাপনা করা সম্ভব। সুরমার উৎসমুখ পানি প্রবাহের উপযোগী নয়। তাই এই নদীকে ড্রেজিংয়ের মাধ্যমে খনন করা প্রয়োজন।
মঙ্গলবার (২৭ ডিসেম্বর) দুপুরে নগরীর পূর্ব জিন্দাবাজারস্থ একটি অভিজাত হোটেলের সম্মেলন কক্ষে বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা) সিলেট আঞ্চলিক শাখা ও সুরমা রিভার ওয়াটারকিপার আয়োজিত নাগরিক আলোচনায় প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি এসব কথা বলেন।
নদীকে মানবদেহের সাথে তুলনা করে জেলা প্রশাসক বলেন, নদী জীবন্ত সত্ত্বা। আদালতের রায়ের সাথে আমরাও একমত। প্রকৃতিগতভবে মানুষকে যেভাবে টিকিয়ে রাখা হয়েছে নদীকেও ঠিক একইভাবে বাঁচিয়ে রাখা হয়েছে। আমরা চাই সিলেটসহ সারাদেশে যে নদীগুলো রয়েছে সেগুলো অক্ষুণ্ণ থাকুক। আপনাদের আন্দোলনের ধারা অব্যাহত থাকুক। কারণ এ ধরনের আন্দোলন না হলে মানুষ ভুলে যায় এটি আমাদের সকলের সম্পদ। সকলের সম্পদ মনে করে কেউ কেউ ব্যক্তিগতভাবে নদীকে ব্যবহার করার চেষ্টা করেন। আমাদের মধ্যে সেই সচেতনতা এখনো সৃষ্টি হয়নি। যারা নদী দখল করছেন তারা কিন্তু সচেতনভাবেই করছেন। বিশেষ করে বড় বড় ইন্ডাস্ট্রি ও ইজারাদারসহ যারা নদী দখল করে ভবন নির্মাণ করছেন তারা জেনে-বুঝেই করছেন। যারা এসব বোঝেন না বা এ ব্যাপারে অসচেতন, তারা কিন্তু নদীর ক্ষতি খুব বেশি করেন না। আমরা আশা করছি খুব তাড়াতাড়ি সবার মধ্যে এই সচেতনতা সৃষ্টি হবে।
মাটি ব্যবস্থাপনার নতুন আইনের কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, আইনগতভাবে পদক্ষেপও এখন বেশি নেওয়া হচ্ছে। যৌথ নদী কমিশনের ফলে আমাদের পরিবেশ অধিদপ্তরের সাথে অনেকগুলো আইন ও বিধিবিধান প্রণয়ন করা হয়েছে নদী রক্ষার জন্য। এটি এখন শুধুমাত্র প্রয়োগের বিষয়। সকলে সম্মিলিতভাবে যদি এটা প্রয়োগ করতে পারি তাহলে ফল পাওয়া যাবে। আপনারা দেখেছেন যে আইন প্রয়োগ করতে গিয়ে অনেক সময় বিপত্তির মধ্যে পড়তে হয়। আমরা নদীর পাড়ের দখলদারদের উচ্ছেদ করতে গিয়ে অপ্রীতিকর ঘটনা অনেক ঘটেছে। কাজেই মানুষের মধ্যে যে আইন অমান্য করার প্রবণতা, তা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। আমরা সম্মিলিত প্রচেষ্টার মাধ্যমে নদ-নদীকে সুরক্ষিত করতে পারবো এই প্রত্যাশা করছি।
‘নদীর অধিকার ও সিলেটের নদ-নদীর অবস্থা: প্রেক্ষিত সোনাই নদী’ শীর্ষক নাগরিক আলোচনা সভায় ‘নদীর অধিকার এবং সিলেটের নদ-নদী: প্রেক্ষিত সোনাই নদী’ শীর্ষক একটি পাওয়ার পয়েন্ট প্রেজেন্টেশনের মাধ্যমে সোনাই নদীতে কিভাবে নদীর অধিকার ক্ষুন্ন করা হয়েছে তা তুলে ধরেন এস এম আরাফাত, সদস্য সচিব, শিক্ষা, তথ্য এবং গবেষণা উপ-কমিটি, বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা)।
সভায় প্রধান আলোচকের বক্তব্য দেন বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা) সাধারণ সম্পাদক ও ওয়াটারকিপার বাংলাদেশের প্রধান সমন্বয়ক শরীফ জামিল। বিশেষ অতিথির বক্তব্য দেন সিলেট বিভাগীয় পানি উন্নয়ন অধিদফতরে অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী এস এম শহিদুল ইসলাম ও সিলেটের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (ক্রাইম অ্যান্ড অবস) শেখ মোহাম্মদ সেলিম।
বাপার সাধারণ সম্পাদক ও ওয়াটারকিপার বাংলাদেশের প্রধান সমন্বয়ক শরীফ জামিল বলেন, নদীর অধিকার এখন প্রকৃতির অধিকার হয়ে গেছে। আমাদের দেশে নদীর অধিকার হরণ করা হচ্ছে। নদীর অবাধ প্রবাহে বাধা প্রদান করা হচ্ছে। নদীর নিজস্ব ভূমিরূপে হস্তক্ষেপ করাসহ নানা কাজ করে নদীর অধিকার খর্ব করা হচ্ছে। তাই নদী নষ্ট হওয়ার কারণে মানবিক বিপর্যয় তৈরি হচ্ছে। নদীকে জীবন্ত সত্ত্বা ঘোষণা করার পরও মানুষ নদীর ওপর অত্যচার করছে। আইন অনুযায়ী এসবের জন্য ফৌজদারী মামলাও করা যায়। কিন্তু মামলাও আমলে নেওয়া হয় না কারণ বিভিন্ন জায়গায় যারা নদী শাসন করছেন তারা সরকারে উচ্চপর্যায়ের এমপি-মন্ত্রী। দেশের বড় বড় শিল্পপতি।
বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা) সিলেট আঞ্চলিক শাখার সভাপতি জামিল আহমদ চৌধুরীর সভাপতিত্বে ও সাধারণ সম্পাদক, সুরমা রিভার ওয়াটারকিপার আবদুল করিম কিমের সঞ্চালনায় মুক্ত আলোচনায় অংশ নেন, সিলেট জেলা আইনজীবী সমিতির সাবেক সভাপতি, বাপা সিলেটের সহ-সভাপতি অ্যাডভোকেট এমাদ উল্লাহ শহিদুল ইসলাম, পরিবেশ ও ঐতিহ্য সংরক্ষণ ট্রাস্ট সিলেটের সভাপতি ডা. মোস্তফা শাহজামান চৌধুরী বাহার, সিলেট জেলা প্রেসক্লাবের সাধারণ সম্পাদক, বাপা সিলেটের কোষাধ্যক্ষ ছামির মাহমুদ, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক, বাপা সিলেটের সদস্য ড. দিলারা রহমান, সহকারী অধ্যাপক অধ্যাপক মো. এমদাদুল হক, সিলেট মহানগর আওয়ামী লীগের তথ্য ও প্রযুক্তি সম্পাদক অ্যাডভোকেট গোলাম সোবহান চৌধুরী দিপন, উদীচী সিলেটের সভাপতি কবি এনায়েত হোসেন মানিক, তথ্যচিত্র নির্মাতা নিরঞ্জন দে যাদু, সারী নদী বাঁচাও আন্দোলনের সভাপতি ও বাপা সিলেটের যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক আব্দুল হাই আল হাদি, সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ও বাপা সিলেটের যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট সুদীপ্ত অর্জুন ও গৌরাঙ্গ পাত্র, হাওর ও পরিবেশ উন্নয়ন সংস্থার সভাপতি কাশমির রেজা, অ্যাডভোকেট দেবব্রত চৌধুরী লিটন, সাংবাদিক পীর জুবায়ের, সাংস্কৃতিক কর্মী নিশাত সাদিয়া প্রমুখ।
অনুষ্ঠানে অন্যান্যের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন, সিলেট জেলা প্রেসক্লাবের সভাপতি আল আজাদ, সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের সাবেক সাধারণ সম্পাদক এনামুল মুনির, ফকির মেলা ফাউন্ডেশনের ফকির জাকির হোসেন সোহেল, উন্নয়নকর্মী হাসান এ চৌধুরী, সুরমা রিভার ওয়াটারকিপারের সদস্য মুজাহিদ হোসেন মুনিম, সাংবাদিক শাকিলা ববি প্রমুখ।