সিলেট এমএজি ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ছাত্র ছিলেন তিনি। নিজ কর্মদক্ষতা আর যোগ্যতায় আসীন হন এ হাসপাতালের পরিচালক। আর নিজের প্রিয় ক্যাম্পাস আর হাসপাতাল কম্পাউন্ডের জঞ্জাল সরিয়ে রোগী আর সেবাগ্রহিতাদের ভরসাস্থলে পরিণত করার মিশন শুরু করেন। কর্মক্ষেত্রে বরাবর সফলতা পাওয়া ব্রিগ্রেডিয়ার জেনারেল মাহবুবুর রহমান ভূঁইয়া সিলেট এমএজি ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে আসেন পরিবর্তন। হাসপাতাল এলাকায় অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ, রোগীদের নিরবচ্ছিন্ন সেবা প্রদান, রোগীদের খাবারের মান উন্নয়ন, দালাল সিন্ডিকেট ভেঙে দেন তিনি। বদলে যাওয়া সিলেট এমএজি ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের এই পরিচালক শেষ কর্মদিবস পার করলেন। তিনি ফিরে যাচ্ছেন সেনাবাহিনীতে। ২৭ সেপ্টেম্বর থেকে তিনি স্বাভাবিক নিয়মে যাচ্ছেন অবসরে।
ব্রিগ্রেডিয়ার জেনারেল মাহবুবুর রহমান ভূইয়া, এসজিপি ২০২২ সালের ৩ ফেব্রুয়ারি সিলেট এমএজি ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক হিসেবে যোগ দেন। তিনি সততা, দক্ষতা, সাহসিকতা এবং সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে রোগী সেবার মানোন্নয়নে এবং সার্বিক স্বাস্থ্য ব্যবস্থা উন্নয়নের জন্য নিরলসভাবে কাজ করে যান। পরিচালক হিসেবে যোগদানের পর থেকে হাসপাতালের আমূল পরিবর্তন এবং উন্নতি হয়। তার অক্লান্ত পরিশ্রম এবং নেতৃত্বে হাসপাতালের দৃশ্যপট পাল্টে যায়। তার দায়িত্ব্কালে সিলেট এমএজি ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের অবকাঠামোগত উন্নয়ন, বিভিন্ন ওয়ার্ড ও বিভাগের সংস্কার কার্যক্রম, রোগী সেবার সক্ষমতা বৃদ্ধি, হাসপাতালের দালাল সিন্ডিকেটের মুলোৎপাটন ও অবৈধ দোকান/পার্কিং উচ্ছেন, পরিস্কার-পরিচ্ছন্নতার মানোন্নয়ন, সকল কর্মকর্তা-কর্মচারীদের শতভাগ হাজিরা নিশ্চিতকরণ, হাসপাতালের রাজস্ব পূর্বের চেয়ে দ্বিগুন বৃদ্ধিকরণ, রোগীর খাবারের মান বৃদ্ধি করা হয়। এছাড়া হাসপাতালের ক্লিনিক্যাল, নার্সিং সার্ভিস, সাপোর্ট সার্ভিস, জেনারেল অ্যাডমিনিস্ট্রেশন এবং ইউটিলিটি সার্ভিসসহ প্রতিটি ক্ষেত্রেই উন্নয়ন ঘটিয়ে সেবা কার্যক্রমে দৃশ্যমান পরিবর্তন আনেন।
হাসপাতালের সকল প্যাথলজিক্যাল ও রেডিওলজিক্যাল পরীক্ষা-নিরীক্ষা সমূহ ২৪ ঘন্টা চালুকরণ ও রোগীদের পরীক্ষা বিভাগীয় প্রধান ও পরিচালকের অনুমতি ব্যতীত বাইরে না পাঠানোর নির্দেশনা এবং মনিটরিং/পর্যবেক্ষণ এর মাধ্যমে রোগীর স্বাস্থ্যসেবার উন্নয়নে ভূমিকা পালন করছেন। সিলেট বিভাগের একমাত্র টারশিয়ারী লেভেল হাসপাতালে রোগীদের চিকিৎসার প্রয়োজনে সূদুর প্রসারী পরিকল্পনার ফলে হাসপাতালে আইসিইউ-এর বেড বৃদ্ধিসহ জনবল, অবকাঠামো, আনুষাঙ্গিক চিকিৎসাসামগ্রীর ব্যবস্থা করেন। ২০২২ ও ২০২৩ সালে সিলেটে ভারী বর্ষণের ফলে আকস্মিক বন্যায় সম্পূর্ণ হাসপাতালের নীচতলা পানিতে তলিয়ে যায়। এমন পরিস্থিতিতে পরিচালকের দূরদর্শী সিদ্ধান্তের ফলে হাসপাতালের ভারী যন্ত্রপাতি যেমন এমআরআই মেশিন, সিটি স্ক্যান মেশিন, কোবাল্ট-৬০ সহ নীচতলার সকল যন্ত্রপাতি সারাদিন পানিতে ডুবে থাকার পরও কোন মেশিন নষ্ট হয়নি। হাসপাতালের সকল বিভাগ পানিতে তলিয়ে থাকাসহ দুইদিন বিদ্যুৎবিহীন থাকা সত্ত্বেও তিনি নিজে বন্যার ৭২ ঘন্টা হাসপাতালে অবস্থান করেন। বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্ন অবস্থায় আইসিইউ ও স্ক্যানুতে ভেন্টিলেটর সমূহ কাজ না করার পরও একজন রোগীও মারা যায়নি।
তিনি সিলেট সিএমএইচ-এ ভর্তিরত জটিল রোগীদের জরুরী প্রয়োজনে প্রতিনিয়ত বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক প্রেরণ করে সামরিক রোগীদের সুচিকিৎসা নিশ্চিতে সহায়তা করেন। প্রয়োজনে সামরিক রোগী ও পরিবারকে ওসমানী হাসপাতালে ভর্তি রেখে চিকিৎসার ব্যবস্থা করে সামরিক পরিমন্ডলে বেশ প্রসংশিত হয়েছেন। এছাড়াও সিলেট সেনানিবাসে অটিজম শিশুদের জন্য নবনির্মিত প্রতিষ্ঠান ‘প্রয়াস’ এ শিশু নিউরো বিশেষজ্ঞ, সাইকোলজিষ্ট, শিশু সাইকিয়াট্রিস্ট প্রেরণ করে প্রতিনিয়ত ‘প্রয়াস’ পরিচালনায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন।
পাশাপাশি অত্র হাসপাতালের সকল বিভাগের কার্যক্রমে গতিশীলতা আনয়ন, সকল যন্ত্রপাতি শতভাগ সচল রেখে সিংহভাগ পরীক্ষা-নিরীক্ষা ২৪ ঘন্টা হাসপাতালে করানোর ব্যবস্থাকরণ, হাসপাতালের জন্য অন্যতম প্রধান সমস্যা দর্শনার্থী নিয়ন্ত্রণে এটেনডেন্ট পাস কার্ড চালুকরণ, সরকারি হাসপাতাল গুলোকে ডিজিটালাইজড করার পাইলট প্রজেক্ট হিসেবে ওসমানী হাসপাতালকে অটোমেশন কার্যক্রমের ১ম ধাপে সম্পূর্ণ বহির্বিভাগকে অটোমেশনের আওতায় নিয়ে আসা, হসপিটাল এইচএসএস স্কোরিং এ সারাদেশের সকল মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল সমূহের মধ্যে ধারাবাহিকভাবে ১ম স্থানে উন্নীত করার কারণে হাসপাতালের সেবার মান বৃদ্ধি পেয়েছে ও জনমনে আস্থা ফিরেছে।
ব্রিগ্রেডিয়ার জেনারেল মাহবুবুর রহমান ভূঁইয়া ১৯৯৪ সালের ৫ জুলাই আর্মি মেডিকেল কোরে ক্যাপ্টেন পদে কমিশন লাভ করেন। সিলেট এমএজি ওসমানী মেডিকেল কলেজ হতে এমবিবিএস পাশ করার পর তিনি সেনাবাহিনীতে কমিশন লাভ করেন। পরবর্তীতে তিনি বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব প্রফেশনালস থেকে হসপিটাল ম্যানেজমেন্ট -এ এমপিএইচ ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ^বিদ্যালয় থেকে প্রিভেনটিভ এবং সোশ্যাল মেডিসিন বিষয়ে এমফিল ডিগ্রী অর্জন করেন। এছাড়াও তিনি স্টেট ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশ হতে হেলথ কেয়ার ম্যানেজমেন্ট এ এমবিএ ডিগ্রি লাভ করেন। তিনি ৩০ বছরের চাকুরী জীবনে একটি ফিল্ড মেডিকেল ইউনিট (৫১ ফিল্ড অ্যাম্বুলেন্স) সহ দুইটি (কুমিল্লা ও ঘাটাইল) সম্মিলিত সামরিক হাসপাতাল (সিএমএইচ) কমান্ড করেন। এছাড়াও তিনি জাতিসংঘ মিশনে ২০১২ সালে লাইবেরিয়া ও ২০২১ সালে সেন্ট্রাল আফ্রিকান রিপাবলিক-এ লেভেল-২ হাসপাতালে ডেপুটি কন্টিনজেন্ট কমান্ডার ও কন্টিনজেন্ট কমান্ডার হিসেবে দায়িত্ব পালন কওে ফোর্স কমান্ডারের প্রশংসাপত্র অর্জন করেন। তিনি কোভিড-১৯ মহামারীকালে সিএমএইচ ঢাকায় ডেপুটি কমান্ড্যান্ট হিসেবে সার্বিক ব্যবস্থাপনায় অনুকরণীয় অবদানের জন্য বাংলাদেশ সেনাবাহিনী কর্তৃক সেনা গৌরব পদক (এসজিপি) প্রাপ্ত হন।
সিএমএইচ ঢাকায় ২০১৯ সালে সংযুক্ত মাথা যমজ রোকেয়া এবং রাবেয়াকে আলাদা করতে ‘অপারেশন ফ্রিডম’ এর প্রধান সমন্বয়কারী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। এই জঠিল অপারেশনে দেশী-বিদেশী প্রায় ১১০ জন চিকিৎসক, নার্স, সেবাকর্মীর নিরলস প্রচেষ্টায় প্রায় ৩৬ ঘন্টার নিরবিচ্ছিন্ন অপারেশন এর মাধ্যমে রোকেয়া এবং রাবেয়াকে সফলভাবে আলাদা করা হয় এবং এক বছরের বেশি সময় সিএমএইচ ঢাকায় সেবা দিয়ে তাদের সুস্থ্য করে তোলা হয়।
২০০৩ সালের ইরাক যুদ্ধে কুয়েত সেনাবাহিনীর হয়ে দায়িত্বশীলতার সাথে কাজের প্রশংসা স্বরুপ কুয়েত সেনাবাহিনী কর্তৃক অসামান্য প্রশংসাপত্র প্রদান করা হয়। ২০১৩-২০১৪ সালে সিএমএইচ ঢাকায় সেন্ট্রাল মেডিক্যাল স্টোরের অধিনায়কের দায়িত্ব পালনকালে সিএমএইচ এর আধুনিকীকরণ ও জনবল বৃদ্ধিতে ভূমিকা পালন করেন।
ব্রিগ্রেডিয়ার জেনারেল মাহবুবুর রহমান ভূঁইয়া, এসজিপি সিএমএইচ ঢাকায় ডেপুটি কমান্ড্যান্ট থাকাকালে নির্বাহী সম্পাদক হিসেবে কম্বাইন্ড মিলিটারি হসপিটাল ঢাকা জার্নাল (সিএমএইচজে) প্রকাশ করেন। একইভাবে দীর্ঘ ১০ বছর পর ২০২১ সাল থেকে ধারাবাহিকভাবে সিলেট এমএজি ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বর্ষপঞ্জি প্রকাশ করে স্বাস্থ্যমন্ত্রণালয়সহ সকল মহলের প্রশংসা অর্জন করেন। তিনি শুধুমাত্র একজন সফল হাসপাতাল প্রশাসকই নন তিনি একজন প্রাবন্ধিক, উপস্থাপক ও গবেষক। দেশী ও আন্তর্জাতিক জার্নালে তার বেশকিছু আর্টিক্যাল প্রকাশিত হয়েছে।
ব্রিগ্রেডিয়ার জেনারেল মাহবুবুর রহমান ভূঁইয়া, এসজিপি তিনি আগামী ২৭ সেপ্টেম্বর নিয়ম অনুযায়ী তিনি অবসরে যাচ্ছেন। তিনি দুই কন্যা ও এক পুত্র সন্তানের জনক। তার স্ত্রী একজন আর্দশ গৃহিনী। তাঁর একমাত্র ছেলে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে লেফটেন্যান্ট পদবীতে কর্মরত। তাঁর জেষ্ঠ্য কন্যা পরিবেশ বিদ্যায় মাস্টার্স করেছে এবং একটি আন্তর্জাতিক সংস্থায় কর্মরত। তাঁর কনিষ্ঠ কন্যা আদমজী ক্যান্টনমেন্ট কলেজ ঢাকায় অধ্যয়নরত।