মধ্যনগরে নির্বাচন পরবর্তী সহিংসতার ঘটনায় আহত পরাজিত প্রার্থী ঢাকায় চিকিৎসা নিচ্ছেন। অন্যদিকে ভয়ে, আতঙ্কে, নিরাপত্তহীনতায় বাড়ি ছেড়েছেন তার পরিবারের লোকজন। জয়ী প্রার্থীর স্বজনদের দাপটে পরাজিত প্রার্থীর সমর্থক পুরুষেরাও বাড়ি ছেড়ে পালিয়েছেন বলে অভিযোগ ওঠেছে। শুক্রবার সন্ধ্যায় মধ্যনগরের নব নির্বাচিত চেয়ারম্যান প্রার্থী মো. আব্দুর রাজ্জাক ভুঁইয়া ও পরাজিত চেয়ারম্যান প্রার্থী সাইদুর রহমানের সমর্থকদের মধ্যে সংঘর্ষের ঘটনার পর এমন পরিস্থিতির উদ্ভব হয়েছে। সংঘর্ষের ঘটনায় শনিবার রাতে ১৭ জনের নামোল্লেখ করে অজ্ঞাত আরও ১৫ থেকে ১৬ জনকে আসামী করে মামলা হয়েছে।
জয়ী চেয়ারম্যান মো. আব্দুর রাজ্জাক ভুঁইয়া পুলিশের উর্ধ্বতন কর্মকর্তা (ডিআইজ) আব্দুল বাতেনের ভাই ও অবসরপ্রাপ্ত ব্যাংকার। সাইদুর রহমান স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা, স্থানীয় বংশীকুন্ডা দক্ষিণ ইউনিয়ন পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান। গত ৫ জুন চতুর্থ ধাপে অনুষ্ঠিত উপজেলা নির্বাচনে নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বি ছিলেন সাইদুর রহমান।
পরাজিত চেয়ারম্যান প্রার্থী সাইদুর রহমানের সমর্থক ইউনিয়ন পরিষদের সাবেক নারী সদস্য দাতিয়াপাড়া গ্রামের বাসিন্দা মরিয়ম বেগম বললেন, গ্রামে দেড়শ পরিবারের বাস। শুক্রবার সন্ধার পর থেকে কমপক্ষে ১০০ পরিবারের লোকজন পাশের সাতুর নতুন বাজারে যাচ্ছে না। এই পরিবারগুলোর বেশিরভাগ পুরুষেরা ভয়ে বাড়ি ছেড়ে পালিয়েছে। মহিলারাও আছেন আতঙ্কে। এরা সকলেই সাইদুর রহমানের সমর্থক।
গ্রামের আলমাছ মিয়ার স্ত্রী দিলারা হোসেন বললেন, ‘রাজ্জাক ভঁুইয়ার ভাগ্না আলী হোসেনসহ দুইজনে সকালে আমার ভাইপুতরে (ভাইয়ের ছেলে) কইয়া দিছে (বলে দিয়েছে) তোর মায়—বাপরে কইছ (বলবে) নিজেরা স্কুল কইরা (করে) বাইচ্ছা—কাইচ্ছা (ছেলে— মেয়ে) পড়াইতো (পড়াতে), আমরার স্কুলে (লায়েছ ভূইয়া উচ্চ বিদ্যালয়) তোরা (তোদের) আওন লাগতো নায়।’
দিলারা জানালেন, শুক্রবার সন্ধায় দুইপক্ষের সংঘর্ষে সাইদুর রহমান আহত হবার পর আত্মীয়—স্বজনগণ গিয়ে দেখতে পারেন নি। সকলের বাড়িঘর ব্যারিকেড দেওয়া ছিল। সাইদুর রহমানের পরিবার ঘর তালা দিয়ে বাড়ি ছেড়ে চলে গেছে। তার পাশের বাড়িতে ছোট ভাই আব্দুর রহমানের স্ত্রী কেবল দরজা লাগিয়ে ঘরে থাকছে বলে শুনেছেন তারা।
সাতু’র গ্রামের আব্দুল করিমও জানালেন, সাইদুর রহমানের পরিবারের লোকজন বাড়ি তালা দিয়ে এলাকা ছেড়ে চলে গেছে। তার এজেন্ট যারা ছিল, এরাও বাড়ি ছেড়ে পালিয়েছে।
সাইদুর রহমানের মেয়ের জামাই ডেইলি স্টারের সিলেটের নিজস্ব প্রতিবেদক দোহা চৌধুরী ঘটনার দিন (শুক্রবার সন্ধ্যায়) দাতিয়াপাড়ায় ছিলেন। বললেন, সাইদুর রহমানের সকল সমর্থকরা ভয়ে বাড়ি ছেড়ে চলে গেছে। তার পক্ষের আরেকজন সাবেক চেয়ারম্যান বিল্লাল হোসেনকেও বাড়ি ছেড়ে যেতে হয়েছে। শুক্রবার সন্ধ্যায় সাইদুর রহমানকে তার বাড়ির সামনেই এসে হামলা করে মারপিট করা হয়। গুরুতর আহত অবস্থায় তিনিসহ তার আহত আত্মীয় স্বজনকে প্রথমে চিকিৎসার জন্য নেওয়া যাচ্ছিল না প্রতিপক্ষের লোকজনের জন্য। তারা বাড়ি ঘেরাও করে রেখেছিল। পরে পুলিশ প্রহরায় বাড়ি থেকে বের করা হয় তাকে। প্রথমে কলমাকান্দা হাসপাতালে নেওয়া হয় তাদের। শেষে ময়মনসিংহ হাসপাতালে আনা হয়। শনিবার সকালে হাসপাতালের পাশের পপুলার ডায়গনস্টিক সেন্টারে সিটি স্ক্যান করার জন্য সাইদুর রহমান ও তার ছেলে ঝিনুককে নেওয়া হয়। ওই হাসপাতালে পুলিশ এসে তাদের (সাইদুর রহমানের লোকজনদের) খোঁজাখোজি করে। এসময় তার নাম (দোহা চৌধুরী) ধরেও পুলিশের লোকজন খুঁজতে থাকে। পরে পপুলার ডায়গনস্টিক থেকেই হাসপাতালের বিদায় নেবার সকল প্রক্রিয়া সেরে ঢাকায় গিয়েছেন তারা।
তিনি জানান, মধ্যনগর থানা পুলিশ পক্ষপাতিত্ব করছে, এজন্য ওখানে তাদের কেউ (সাইদুর রহমানের পক্ষে) মামলা নিয়ে যেতে সাহস করছে না। থানায় গেলে পুলিশ গ্রেপ্তার করতে পারে এই ভয়ে। তারা আদালতে শীঘ্রই মামলা দায়ের করবেন।
বিজয়ী চেয়ারম্যান মো. রাজ্জাক ভুঁইয়া বললেন, সাইদুর রহমান নির্বাচনের আগে ও পরে কেবল মিথ্যা নাটক সাজাচ্ছেন। আমাদের লোকজনের উপর হামলা হবার পর আমার লোকজন তাকে চর থাপ্পর দিয়েছে। অথচ সে মাথা বেঁধে নিজেকে গুরুতর আহত সাজিয়েছে। পরে সে পুলিশকে জানিয়েছে, আমার লোকজন তাকে চিকিৎসায় যেতে দিচ্ছে না। পুলিশের সাহায্য নিয়ে সে চিকিৎসায় গেছে। এখন সে ও তার পরিবার বাড়ি ছেড়ে চলে গেছে। তারা বাড়ি ছেড়ে গেলে, আমি কী করবো। ময়মনসিংহ হাসপাতাল ছেড়ে ওরা শুক্রবার দুপুরেই চলে গেছে। রাত নয়টায় আমার ভাতিজা আজিম মাহমুদ মামলা করেছে। মামলার আগে দুপুরেই তারা হাসপাতাল ছেড়ে পালায় কেন, তাতেই বোঝা তারা অপরাধি। সাইদুর রহমান অহরহ সাংবাদিকদেরসহ বিভিন্ন জায়গায় মিথ্যা অভিযোগ দিচ্ছে।
ভাই ডিআইজি আব্দুল বাতেন এসব বিষয়ে কোন সহায়তা করছেন না দাবি করে রাজ্জাক ভুইয়া বলেন, তবুও নানা অভিযোগে তাঁর (ডিআইজি বাতেনের) নাম যুক্ত করা হচ্ছে। তিনি জানান, দাতিয়াপাড়া বাজারে তার ঘর ছাড়া পুলিশের দাঁড়ানোর জায়গা নেই। কিন্তু পুলিশ ওখানে (রাজ্জাক ভুঁইয়ার ঘরে) কেন দাঁড়াবে সেই অভিযোগও হচ্ছে। আমি সকালে বাড়ি থেকে নাস্তা পাঠিয়েছিলাম পুলিশের জন্য তারা খায় নি। বলেছে, আমার বাড়ি’র কিছু খাওয়া যাবে না। এসব কী ভদ্রতা হয় কী না মন্তব্য করে তিনি বলেন, সাইদুর রহমানের বাড়িতে পুলিশকে রাখার ব্যবস্থা করলেও আমি পক্ষপাতিত্ব বলবো না। তিনি জানালেন, তার আত্মীয় স্বজনের কেউ কাউকে হুমকি ধমকি দেয় নি। এলাকার পরিবেশও শান্ত রয়েছে।
মধ্যনগরের ঘটনায় শনিবার রাতে একপক্ষের (রাজ্জাক ভুঁইয়া’র পক্ষ) মামলা নেওয়া হয়েছে দাবি করে অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (মিডিয়া) রাজন কুমার দাস বললেন, দুইপক্ষে মারামারি হয়েছে। দুই মামলাই গ্রহণ করবে মধ্যনগর পুলিশ। ময়মনসিংহ হাসপাতালে পুলিশ শুক্রবার যায় নি দাবি করে তিনি বলেন, শুক্রবার সন্ধ্যা থেকে দাতিয়াপাড়ায় একজন এএসপি, থানার ওসিসহ ৩০ জন পুলিশ সদস্য ছিলেন। এখনো দশ জন আছেন। পুলিশ কারো পক্ষপাতিত্ব করছে না।
প্রসঙ্গত. শুক্রবার সন্ধ্যায় মধ্যনগরের বিজয়ী চেয়ারম্যান প্রার্থী আব্দুর রাজ্জাক ভুঁইয়া ও নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বি সাইদুর রহমানের সমর্থকদের মধ্যে সংঘর্ষের ঘটনায় ১১ জন আহত হয়। এসময় বাড়িতেও হামলা হয়েছে বলে দাবি করেন সাইদুর রহমান।