পোশাক রফতানি : বৈশ্বিক সংকটেও ঈর্ষণীয় সাফল্য

বৈশিক সংকটে যুক্তরাষ্ট্রসহ বড় রফতানিকারক দেশগুলোয় মূল্যস্ফীতির চাপ বাড়লেও এই দেশগুলো বাংলাদেশের তৈরি পোশাক কিনছে আগের চেয়ে বেশি। অর্থাৎ বিশ্বব্যাপী এখনও তৈরি পোশাক রফতানিতে বাংলাদেশের সুদিন যাচ্ছে। আগের মতোই ইউরোপের বাজারে দ্বিতীয় এবং যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে তৃতীয় অবস্থান ধরে রেখেছে বাংলাদেশ।

মার্কিন অফিশিয়াল সোর্স অফিস অব টেক্সটাইলস অ্যান্ড অ্যাপারেল (অটেক্সা) ও ইউরোপীয় পরিসংখ্যান সংস্থা ইউরোস্ট্যাটের তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে সেপ্টেম্বর— এই ৯ মাসে বাংলাদেশ থেকে পোশাক নিয়েছে আগের যেকোনও সময়ের চেয়ে বেশি।

ইউরোস্ট্যাটের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০২১ সালের একই সময়ের তুলনায় উল্লিখিত সময়কালে বাংলাদেশ থেকে ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) পোশাক আমদানি ৪৩ দশমিক ২১ শতাংশ বেড়ে ১৭ দশমিক ৫৬ বিলিয়ন মার্কিন ডলারে দাঁড়িয়েছে, যেখানে বিশ্ব থেকে তাদের আমদানি ২৭ দশমিক ৮৭ শতাংশ বেড়েছে।

আগের মতোই বাংলাদেশ ২২ দশমিক ৫৬ শতাংশ শেয়ার নিয়ে ইউরোপে পোশাক আমদানিতে দ্বিতীয় বৃহত্তম উৎস এবং চীন ২৯ দশমিক ০৪ শতাংশ শেয়ার নিয়ে শীর্ষ অবস্থানে রয়েছে। ইইউ ২০২২ সালের প্রথম ৯ মাসে চীন থেকে ২২ দশমিক ৫৯ বিলিয়ন মার্কিন ডলার মূল্যের পোশাক আমদানি করেছে, যেখানে বছরওয়ারি প্রবৃদ্ধি ছিল ২৫ দশমিক ১৯ শতাংশ।

তৃতীয় বৃহত্তম পোশাক আমদানির উৎস, তুরস্ক থেকে ইইউর আমদানি ৯ দশমিক ১৯ বিলিয়ন মার্কিন ডলারে পৌঁছে বছরওয়ারি প্রবৃদ্ধি হয়েছে ১৪ দশমিক ৮৬ শতাংশ। অন্যদিকে ভারত থেকে ইউরোপীয় ইউনিয়নের আমদানি বেড়েছে ১৫ দশমিক ৮৫ শতাংশ।

ইউরোপীয় ইউনিয়নের শীর্ষ ১০ পোশাক সরবরাহকারীর মধ্যে বাংলাদেশ সর্বোচ্চ প্রবৃদ্ধি অর্জন করেছে। উল্লেখযোগ্য প্রবৃদ্ধিসহ অন্য দেশগুলো হলো কম্বোডিয়া ৪১ দশমিক ০৮ শতাংশ, ইন্দোনেশিয়া ৩৩ দশমিক ৪৬ শতাংশ এবং পাকিস্তান ৩০ দশমিক ৭৬ শতাংশ।

এদিকে রফতানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) পরিসংখ্যানের তথ্যমতে, এই সময়ের মধ্যে (জুলাই-নভেম্বর ২০২২-২৩) ইউরোপীয় ইউনিয়নে পোশাক রফতানি বেড়ে ৭ দশমিক ৮১ বিলিয়ন থেকে ৯ দশমিক ০৭ বিলিয়ন মার্কিন ডলারে পৌঁছেছে। ইউরোপীয় ইউনিয়নে সবচেয়ে বড় বাজার, জার্মানিতে পূর্ববর্তী বছরের একই সময়ের তুলনায় রফতানি ২ দশমিক ৭১ বিলিয়ন মার্কিন ডলারে পৌঁছে প্রবৃদ্ধি হয়েছে ১ দশমিক ৮৮ শতাংশ। স্পেন ও ফ্রান্সেও রফতানি বেড়েছে যথাক্রমে ১৯ দশমিক ১৫ শতাংশ এবং ৩৮ দশমিক ৮৭ শতাংশ।

ইউরোপীয় ইউনিয়নের অন্য প্রধান দেশগুলো যেমন ইতালি, অস্ট্রিয়া, নেদারল্যান্ডস ও সুইডেনে রফতানি প্রবৃদ্ধি হয়েছে যথাক্রমে ৫০ দশমিক ৯৫ শতাংশ, ৪৮ দশমিক ৮৭ শতাংশ, ৩৪ দশমিক ৩৯ শতাংশ এবং ২২ দশমিক ৯০ শতাংশ।

অন্যদিকে, উল্লিখিত সময়ের মধ্যে পোল্যান্ডে বছরওয়ারি রফতানিতে ১৯ দশমিক ৬১ শতাংশ ঋণাত্মক প্রবৃদ্ধি হয়েছে।

উল্লিখিত সময়ের মধ্যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে পোশাক রফতানি ছিল ৩ দশমিক ৪৭ বিলিয়ন মার্কিন ডলার, যার কারণে বছরওয়ারি প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৪ দশমিক ০৭ শতাংশ।

এ ছাড়া যুক্তরাজ্য ও কানাডায় আমাদের রফতানি আগের অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় যথাক্রমে ১১ দশমিক ৭১ শতাংশ এবং ৩০ দশমিক ২৫ শতাংশ বেড়েছে। একই সময়ে অপ্রচলিত বাজারে রফতানি ২ দশমিক ৪৭ বিলিয়ন থেকে বেড়ে ৩ দশমিক ১৯ বিলিয়ন মার্কিন ডলারে দাঁড়িয়েছে।

২০২২-২৩-এর জুলাই-নভেম্বর সময়ে প্রধান অপ্রচলিত বাজারগুলোর মধ্যে, জাপানে রফতানি ৫৯৭ দশমিক ৮৩ মিলিয়ন ডলারে পৌঁছে বছরওয়ারি প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৩৮ দশমিক ১১ শতাংশ। উচ্চ প্রবৃদ্ধিসহ অন্য অপ্রচলিত বাজারগুলো হলো মালয়েশিয়া ১০০ দশমিক ২১ শতাংশ, মেক্সিকো ৪৯ দশমিক ৬৮ শতাংশ, ভারত ৪৮ দশমিক ৭৮ শতাংশ, ব্রাজিল ৪৪ দশমিক ৫৩ শতাংশ এবং দক্ষিণ কোরিয়া ৩০ দশমিক ৩৫ শতাংশ।

এদিকে অটেক্সার তথ্য অনুযায়ী, উল্লিখিত সময়ে যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশ থেকে ৭ দশমিক ৫৫ বিলিয়ন ডলার মূল্যের পোশাক আমদানি করেছে। এই সময়ে বাংলাদেশ থেকে তাদের পোশাক আমদানি ৫০ দশমিক ৯৮ শতাংশ বেড়েছে। অর্থাৎ এই হারে বাংলাদেশ থেকে যুক্তরাষ্ট্রে পোশাক রফতানি বেড়েছে।

অটেক্সার তথ্য অনুযায়ী, দুই বছর ধরেই যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে তৈরি পোশাক রফতানি বেড়েছে।

এ প্রসঙ্গে তৈরি পোশাক মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএর পরিচালক ও মুখপাত্র মহিউদ্দিন রুবেল বলেন, হতাশাব্যাঞ্জক বিশ্ব অর্থনীতি এবং ক্রমবর্ধমান মুদ্রাস্ফীতির প্রেক্ষাপটের মধ্যেও যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে বাংলাদেশ তার প্রধান তিন প্রতিদ্বন্দ্বী দেশের চেয়ে বেশি হারে পোশাক রফতানি করেছে। এ ছাড়া বাংলাদেশ থেকে ইউরোপীয় ইউনিয়নের পোশাক আমদানি ৪৩ দশমিক ২১ শতাংশ বেড়ে ১৭ দশমিক ৫৬ বিলিয়ন মার্কিন ডলারে দাঁড়িয়েছে, যেখানে বিশ্ব থেকে তাদের আমদানি ২৭ দশমিক ৮৭ শতাংশ বেড়েছে। এটি অবশ্যই আশাব্যাঞ্জক। তবে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে দেশটিতে মূল্যস্ফীতি ব্যাপকভাবে বেড়ে গেছে। এ কারণে ব্র্যান্ডগুলোর বিক্রয়কেন্দ্রে পোশাকের বিক্রি কিছুটা কমে গেছে।

অটেক্সার তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরের জানুয়ারি-সেপ্টেম্বর সময়ে বিশ্ব থেকে যুক্তরাষ্ট্রের পোশাক আমদানি ৩৪ দশমিক ৬১ শতাংশ বেড়েছে। ৮ দশমিক ৫৪ শতাংশ শেয়ার নিয়ে বাংলাদেশ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জন্য পোশাক আমদানির তৃতীয় বৃহত্তম উৎস হিসেবে অবস্থান ধরে রেখেছে।

চীন ২২ দশমিক ৪৮ শতাংশ শেয়ার নিয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জন্য সর্ববৃহত্তম পোশাক সরবরাহকারী। এরপর ১৮ দশমিক ৫১ শতাংশ শেয়ার নিয়ে দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে ভিয়েতনাম। ২০২২ সালের প্রথম ১০ মাসে চীন থেকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আমদানি ২৮ দশমিক ৯৪ শতাংশ বেড়েছে এবং ১৭ দশমিক ৭২ বিলিয়ন মার্কিন ডলারে পৌঁছেছে। একই সময়ে ভিয়েতনাম থেকে আমদানি ১৪ দশমিক ৫৯ বিলিয়ন মার্কিন ডলারে দাঁড়িয়েছে, বছরওয়ারি ৩৪ দশমিক ৬৯ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হয়েছে।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অন্য শীর্ষ পোশাক সরবরাহকারীদের উল্লেখযোগ্য প্রবৃদ্ধি হয়েছে। উচ্চ প্রবৃদ্ধিসহ অন্য শীর্ষ দেশগুলো হলো ইন্দোনেশিয়া ৫৪ দশমিক ৬৬ শতাংশ, ভারত ৫৩ দশমিক ৩৯ শতাংশ, কম্বোডিয়া ৪৬ দশমিক ৫৮ শতাংশ, পাকিস্তান ৪০ দশমিক ১১ শতাংশ এবং দক্ষিণ কোরিয়া ৩৯ দশমিক ৬১ শতাংশ।

প্রসঙ্গত, যুক্তরাষ্ট্র বরাবরই বাংলাদেশের তৈরি পোশাকের বড় বাজার। প্রায় ১০ বছর আগে সাভারের রানা প্লাজা ধসের পর বাংলাদেশের পোশাক কারখানার কর্মপরিবেশ নিয়ে প্রশ্ন উঠলে বাজারটিতে রফতানি কমে যায়। তারপর কারখানার কর্মপরিবেশ উন্নয়নে ব্যাপক সংস্কারকাজ করেন উদ্যোক্তারা। ফলে ধীরে ধীরে ঘুরে দাঁড়াতে শুরু করে বাংলাদেশের পোশাক রফতানি।

অন্যদিকে চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যকার বাণিজ্যযুদ্ধের কারণে ২০১৯ সালে দেশটির অনেক প্রতিষ্ঠান বিকল্প উৎস হিসেবে বাংলাদেশকে বেছে নেয়। তবে করোনার কারণে রফতানি আবার নিম্নমুখী হতে থাকে। গত বছরের মে মাস থেকে বাজারটিতে বাংলাদেশের পোশাক রফতানি আবার বাড়াতে শুরু করে।

বিভিন্ন সূত্রের তথ্য অনুযায়ী, যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে দীর্ঘদিন ধরে বাংলাদেশ তৃতীয় শীর্ষ তৈরি পোশাক রফতানিকারক।