দীর্ঘদিন ধরে পাট ও পাটজাত পণ্যের রপ্তানি একই বৃত্তে ঘুরপাক খাচ্ছে। ২০১১-১২ অর্থবছরে পাট ও পাটজাত পণ্যের রপ্তানি ছিল ৯৭ কোটি মার্কিন ডলারের। গত অর্থবছরে এই রপ্তানি কমে ৯১ কোটি ডলারে দাঁড়ায়। তার মানে ১০ বছরে পাট ও পাটজাত পণ্যের রপ্তানি বাড়েনি, উল্টো ৬ শতাংশ কমেছে। খবর প্রথম আলোর ।
এমন নিরাশার পরিসংখ্যান সত্ত্বেও পাট ও পাটজাত পণ্য নিয়ে নতুন করে স্বপ্ন দেখছে সরকার। বর্তমান মন্ত্রিসভার প্রথম সভায় পাটজাত পণ্যসহ তিনটি খাতকে তৈরি পোশাকশিল্পের বিকাশে যেভাবে সহায়তা দেওয়া হয়েছিল, প্রয়োজনে তেমন সহায়তা দিতে বিশেষ উদ্যোগ নেওয়ার নির্দেশনা দেন প্রধানমন্ত্রী।
ভারতের পাটকলগুলোয় ১০৬-১০৭ ধরনের কাপড় তৈরি হয়। আর আমাদের দেশে তৈরি হয় মাত্র চার–পাঁচ ধরনের কাপড়। তা ছাড়া পণ্যের নকশা নিয়েও ভুগছেন উদ্যোক্তারা।
পাটপণ্যের রপ্তানিকারকেরা বলছেন, পরিবেশবান্ধব হওয়ায় বিশ্বজুড়ে পাটপণ্যের চাহিদা বাড়ছে। তবে কিছু সীমাবদ্ধতার জন্য সেই সুযোগ কাজে লাগাতে পারছে না বাংলাদেশ। যদিও বিশ্বমানের পাট উৎপাদনে বাংলাদেশের সুনাম রয়েছে। সম্ভাবনা কাজে লাগাতে পাটের উৎপাদন থেকে শুরু করে পাটপণ্য নিয়ে গবেষণা, নকশার উন্নয়ন, বিপণনসহ বিভিন্ন বিষয়ে একটি সমন্বিত পথনকশা দরকার। সেই পথনকশা অনুযায়ী কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়া হলেই পাটপণ্যের রপ্তানি বাড়বে।
বিশ্বজুড়ে পাটজাত পণ্য, বিশেষ করে বহুমুখী পাটপণ্যে সবচেয়ে বেশি সম্ভাবনা থাকলেও সেই রপ্তানি কম বাংলাদেশের। দীর্ঘদিন ধরেই পাট ও পাটজাত পণ্য রপ্তানির মধ্যে পাটের সুতার রপ্তানিই বেশি। দ্বিতীয় সর্বোচ্চ রপ্তানি হচ্ছে কাঁচা পাট। আর তৃতীয় হচ্ছে পাটের বস্তা।
বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (বিডা) তথ্য অনুযায়ী, বিশ্বে পাট উৎপাদনে বাংলাদেশ দ্বিতীয়। বছরে দেশে ৯০ লাখ বেল পাট উৎপাদিত হয়। আগামী পাঁচ বছরের মধ্যে পাটপণ্যের রপ্তানি ৫০০ কোটি ডলারে উন্নীত করা সম্ভব।
বর্তমানে দেশের অন্যতম শীর্ষস্থানীয় বহুমুখী পাটপণ্য রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠান ক্রিয়েশন প্রাইভেট লিমিটেড। তারা কাঁচা পাট, পাটের সুতা ও কাপড়ের বিভিন্ন উপকরণ ব্যবহার করে নান্দনিক নকশায় গৃহস্থালি ও নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য, বাসাবাড়িতে বাগান করার সরঞ্জাম, ফ্লোর কভার, প্যাকেজিং বা মোড়কীকরণ পণ্য, সাজসজ্জার উপকরণ, অফিসে ব্যবহার্য কয়েক হাজার ধরনের পণ্য প্রস্তুত ও রপ্তানি করে। প্রতিষ্ঠানটির দুটি কারখানায় কাজ করেন প্রায় তিন হাজার শ্রমিক।
জানতে চাইলে ক্রিয়েশনের এমডি মো. রাশেদুল করিম বলেন, এক টন কাঁচা পাট বা ছালার পরিবর্তে বহুমুখী পাটপণ্যের দাম ৫০ গুণ বেশি হয়ে থাকে। সম্ভাবনা থাকায় এ খাতে নতুন উদ্যোক্তা আসছেন। তবে চাহিদা অনুযায়ী কাঁচামাল পাওয়া যাচ্ছে না। ভারতের পাটকলগুলোয় ১০৬-১০৭ ধরনের কাপড় তৈরি হয়। আমাদের দেশে তৈরি হয় মাত্র চার-পাঁচ ধরনের কাপড়। তা ছাড়া পণ্যের নকশা নিয়েও ভুগছেন উদ্যোক্তারা।
পাটের বহুমুখী পণ্যের নকশা উন্নয়নে গবেষণার জন্য সরকারি উদ্যোগ নেওয়ার প্রয়োজন বলে মন্তব্য করেন রাশেদুল করিম। তিনি বলেন, টেকনিক্যাল টেক্সটাইল, তৈরি পোশাক, গার্ডেনিং বা বাগান, অটোমোবাইল ও প্যাকেজিংয়ে পাটপণ্যের সম্ভাবনা রয়েছে। তবে আমরা এখনো প্যাকেজিং পণ্যই বেশি করছি। এখান থেকে বহুমুখী পাটপণ্যের রপ্তানি বাড়াতে হলে উদ্যোক্তাদের নকশা সরবরাহ করতে হবে। পাশাপাশি পাটকলগুলোকে আধুনিকায়নে সরকারকে সহায়তা দিতে হবে।
বহুমুখী পাটপণ্যের বাজার ও বাংলাদেশের সম্ভাবনা নিয়ে বিডার প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বিশ্বজুড়ে শুধু পাটের ব্যাগের বার্ষিক চাহিদা ৫০ হাজার কোটি পিস। পাটপণ্যের উৎপাদন খরচ বিশ্বের যেসব দেশে সবচেয়ে কম, বাংলাদেশ তার মধ্যে অন্যতম।
বিডার প্রতিবেদন অনুযায়ী, পাটের তৈরি গৃহসজ্জার পণ্যের চাহিদার পাশাপাশি পাটের তৈরি শপিং ব্যাগ, জিওটেক্সটাইল ও ফ্লোর কভারের চাহিদাও বাড়ছে। এ ছাড়া পাটকাঠির তৈরি চারকোলের চাহিদাও রয়েছে চীনসহ বিভিন্ন দেশে। পণ্যটি রপ্তানি করেই ৩০০ থেকে ৩৫০ কোটি ডলার আয় করা সম্ভব। ২০২৫ সালে চারকোলের বৈশ্বিক বাজারের আকার দাঁড়াবে ৩৩ হাজার ৫০০ কোটি ডলারে। এ ছাড়া পাটভিত্তিক জিওটেক্সটাইলের বৈশ্বিক বাজারের আকার বেড়ে চলতি বছর ২০ কোটি ডলারে দাঁড়াবে।
বহুমুখী পাটপণ্য রপ্তানি করে আরেক প্রতিষ্ঠান সোনালি আঁশ ইন্ডাস্ট্রিজ। তাদের দুটি কারখানায় কাজ করেন প্রায় দুই হাজার কর্মী। গত বছর তাদের রপ্তানি ছিল ৭০ থেকে ৮০ কোটি টাকার।
সোনালি আঁশ ইন্ডাস্ট্রিজের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ মাহবুবুর রহমান পাটোয়ারী বলেন, পাটপণ্য রপ্তানির সম্ভাবনার সুযোগ নিতে হলে প্রথমেই সরকারকে পাটবীজ থেকে শুরু করে উৎপাদন, অর্থায়ন, পাটকলের আধুনিকায়ন, নতুন পাটপণ্যের নকশাসহ সার্বিক বিষয়ে একটি সমন্বিত পরিকল্পনা নিতে হবে। তাহলেই সাফল্য আসবে।