চলতি বছরের প্রথম সাত মাসে দেশে নারী ও শিশু নির্যাতনের অভিযোগে দায়ের হওয়া মামলার প্রায় অর্ধেক ধর্ষণের। পাঁচ বছর ধরে ধর্ষণের মামলার হার বেড়েই চলছে। আইনের যথাযথ প্রয়োগের অভাব, বিচার প্রক্রিয়ার দুর্বলতা, দীর্ঘসূত্রিতা এবং দোষীদের বিচার না হওয়ার সংস্কৃতির কারণেই ধর্ষণের ঘটনা বাড়ছে।
পুলিশ সদর দপ্তরের হিসাব বলছে, এ বছরের জুলাই পর্যন্ত নারী ও শিশু নির্যাতনের অভিযোগে ৭ হাজার ৩৫০টি মামলা হয়েছে। এর মধ্যে ধর্ষণের মামলা ৩ হাজার ৫২৩টি।
যদিও নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন, ২০০০, এর ৯। (১) বলা হয়েছে ‘যদি কোন পুরুষ কোন নারী বা শিশুকে ধর্ষণ করেন, তাহা হইলে তিনি ১[মৃত্যুদণ্ডে বা যাবজ্জীবন সশ্রম কারাদণ্ডে] দণ্ডনীয় হইবেন এবং ইহার অতিরিক্ত অর্থদণ্ডেও দণ্ডনীয় হইবেন।’ মৃত্যুদণ্ডের বিধান রাখার পরও দেশে কেন ধর্ষণের মত ঘটনাগুলো রোধ করা যাচ্ছে না; এমন প্রশ্ন ঘুরেফিরে আসছে। তবে এর কারণ হচ্ছে অপরাধ প্রমাণ করতে না পারা, বিচারের দীর্ঘসূত্রিতা, আইনি জটিলতা ও প্রভাবশালী ব্যক্তির দ্বারা বিচার প্রক্রিয়ায় বাঁধা।
যদি আমরা চলতি বছরে আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) তথ্য দেখি তাহলে দেখা যায়, সারাদেশে ধর্ষণ ও দলবেঁধে ধর্ষণের শিকার হয়েছেন ২০১৮ সালে ৭৩২ জন, ২০১৯ সালে ১ হাজার ৪১৩ জন ও ২০২০ সালে ১ হাজার ৬২৭ জন, ২০২১ সালে ১ হাজার ৩২১ জন এবং ২০২২ সালের জুলাই পর্যন্ত ৫৪৬ জন।
বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ কেন্দ্রীয় লিগ্যাল এইড উপ-পরিষদের প্রকাশিত তথ্যমতে, ২০১৯ সালে দেশে এক হাজার ৩৭০ জন, ২০২০ সালে এক হাজার ৩৪৬ জন, ২০২১ সালে এক হাজার ২৩৫ জন নারী ও কন্যাশিশু ধর্ষণের শিকার হয়েছেন।
তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, গত কয়েক বছরের মধ্যে প্রায় প্রতি বছরই গড়ে ১ হাজার ২৬০টি ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে। এছাড়া চলতি বছরের প্রথম সাত মাসে দেশে নারী ও শিশু নির্যাতনের অভিযোগে দায়ের হওয়া মামলার প্রায় অর্ধেকই ধর্ষণের।
জাতীয় জরুরি সেবা ৯৯৯-এর তথ্যানুযায়ী, নারী ও শিশু নির্যাতনের অভিযোগের সংখ্যা ব্যাপক হারে বাড়ছে। এ বছরের জুলাই পর্যন্ত নারী ও শিশু নির্যাতনের অভিযোগে ১১ হাজার ৯৫৯টি ফোনকল এসেছে। এর মধ্যে ধর্ষণের ৬১৯টি, ধর্ষণ চেষ্টা ৩১৪টি, যৌন নির্যাতন ২৬৮টি, ধর্ষণের হুমকি ৩১টি এবং উত্ত্যক্ত ও যৌন হয়রানির ১ হাজার ৯টি। একই অভিযোগে গত বছর অর্থাৎ ২০২১ সালে ১২ হাজার ১৬৯টি, ২০২০ সালে ৬ হাজার ৩৩১টি, ২০১৯ সালে ৩ হাজার ১১৫টি এবং ২০১৮ সালে ২ হাজার ২৯২টি ফোনকল আসে। জরুরী সেবার কলের সংখ্যায়ও প্রমাণিত হচ্ছে আমাদের দেশের নারী নির্যাতনের সংখ্যা কি ভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে।
২০২১ সালে করোনা মহামারির মধ্যেও ধর্ষণসহ নারী ও শিশু নির্যাতন উদ্বেগজনক :
৩১ জুলাই ২০২১ সালে মানবাধিকার সংস্কৃতি ফাউন্ডেশনের এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয় ‘করোনাভাইরাস মহামারির মধ্যেও দেশে নারী ও শিশুর প্রতি ধর্ষণ, হত্যা ও পারিবারিক সহিংসতার ঘটনা উদ্বেগজনকভাবে অব্যাহত ছিল। ২০২১ সালের জুলাই মাসে ৩৩২টি নারী ও শিশু নির্যাতনের ঘটনা ঘটেছে, যা আগের মাসে ছিল ৩২২টি। মানবাধিকার সংস্কৃতি ফাউন্ডেশনের (এমএসএফ) মানবাধিকার পরিস্থিতি মনিটরিং-বিষয়ক জুলাই মাসের প্রতিবেদনে এই তথ্য এসেছে।
প্রতিবেদনে আরো বলা হয়, করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবের মধ্যেও দেশে নারী-শিশুর প্রতি ধর্ষণ, হত্যা ও পারিবারিক সহিংসতার ঘটনা বিগত মাসগুলোর মতোই অব্যাহত রয়েছে, যা অত্যন্ত উদ্বেগজনক। জুলাই মাসে ধর্ষণের ৬২টি, গণ-ধর্ষণ ২৫টি, ধর্ষণ ও হত্যার ৪টি ঘটনা ঘটে, যার মধ্যে ৬ জন প্রতিবন্ধীসহ ৪৭ জন শিশু ও কিশোরী রয়েছে। ধর্ষণের শিকার ৬২ জনের মধ্যে ৩৭ শিশু ও কিশোরী রয়েছে। অন্যদিকে গণ-ধর্ষণের শিকার ১৬ জন এবং ধর্ষণ-হত্যার ঘটনায় দুই শিশু ও কিশোরী রয়েছে। ধর্ষণ-চেষ্টার শিকার ২৬ জনের মধ্যে ১৭ জনই শিশু ও কিশোরী। যৌন হয়রানি ১৫টি ও শারীরিক নির্যাতনের ৩৯টি ঘটনা ঘটেছে। এ সময় ২৭ জন শিশু-কিশোরীসহ মোট ৬৬ জন নারী আত্মহত্যা করেছেন।
করোনা মহামারির সময় মানুষ তার বাঁচা-মরা নিয়ে শঙ্কিত ছিল। তারপরও নিজের পশুত্ব দ্বারা নারী নির্যাতন ও ধর্ষণের মত ঘটনা তারা নিয়মিত ঘটিয়েছেন। তাহলে বুঝা যাচ্ছে দেশের প্রচলিত আইন দিয়েই শুধু নারী নির্যাতন, ধর্ষণ বন্ধ করা সম্ভব হয়ে উঠছে না। এক্ষেত্রে জেগে উঠতে হবে দেশের নারীদের।
গুলাবি গ্যাং :
মাত্র ১২ বছর বয়সে সাম্পাত দেবীকে স্কুল ছাড়িয়ে বিয়ে দিয়ে দেওয়া হয়। কিন্তু লেখাপড়া শেখার স্পৃহা তার যায়নি। গ্রামের ছেলেদের কাছ থেকে সে পড়াশোনা শিখতো। তারপর ১৬ বয়সে সে প্রথম অনাচারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করলো। তার গ্রামের এক পুরুষ প্রায় নিয়মিত তার বউকে পেটাতো। তাকে ঠেকানোর জন্য তিনি পরিবারের কাছে অনেক অনুরোধ করেন, কিন্তু কেউই পাত্তা দেয়নি। এমন বাস্তবতায় একদিন তিনি নিজেই এগিয়ে গেলেন। মানুষটিকে মুখের ওপর জিজ্ঞেস করলেন কেন সে প্রতিদিন তার বউকে পেটায়। রেগে গিয়ে মানুষটি তাকে গালাগাল শুরু করলো। গ্রামের অন্য কজন নারীর সাহায্যে সেদিন মাঠের মধ্যে লোকটিকে পেটালেন সাম্পাত দেবী। সেটাই ছিল শুরু। এরপর তিনি গ্রামের অন্য বেশ কজন নারীকে নিয়ে একটি দল গঠন করলেন, যারা বউকে মারধর করার ঘটনার ওপর নজরদারি শুরু করলো। তাদের হাতে থাকতো বাঁশের লাঠি।
২০০৫ সালে গুলাবি গ্যাং গঠনের পর ২০০৬ সালে নাগাদ এই সংগঠনের সদস্য সংখ্যা দাঁড়ায় প্রায় এক হাজার। সেবছরই পুলিশের দুর্নীতি এবং বাড়াবাড়ির প্রতিবাদ করতে গুলাবি গ্যাং স্থানীয় পুলিশ স্টেশন ঘেরাও করে। ২০১০ সালে আবারও গুলাবি গ্যাং খবরে আসলো। স্থানীয় এক প্রভাবশালী রাজনীতিক অল্প বয়সী একটি মেয়েকে ধর্ষণ করে এবং তারপর তার বিরুদ্ধে চুরির অভিযোগ আনে। প্রতিবাদে গুলাবি গ্যাংয়ের সদস্যরা স্থানীয় জেলখানার সামনে টানা ১১ দিন ধরে অবস্থান নেয়। তাদের দাবি ছিল মেয়েটিকে মুক্তি দিয়ে আসল অপরাধী পুরুষোত্তম দিবেদিকে ধরে বিচার করতে হবে। পরে ঐ রাজনীতিকের বিচার হয় এবং ১০ বছরের কারাদণ্ড হয়।
এভাবেই নারী নির্যাতনের প্রতিবাদ করে যাচ্ছে গুলাবি গ্যাং এর সদস্যরা। ভারতের জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পত্রিকাতে খবরের পাশাপাশি গুলাবি গ্যাং নিয়ে ২০১৪ সালের ৭ মার্চ ছবি মুক্তি পায়।
আমাদের দেশেও নারী নির্যাতন প্রতিরোধে একজন সাম্পাত দেবী’র প্রয়োজন; যার হাত ধরে তৈরি হবে একটি গ্যাং। যারা প্রতিবাদ করবে বিচার না হওয়া পর্যন্ত। বিচারের জন্য প্রতিবাদ অব্যাহত রাখবে এবং গড়ে তুলবে প্রতিরোধ। নির্যাতনকারী পুরুষ যতই শক্তিশালী হোক না কেন দেশের প্রচলিত আইন ও গ্যাং এর ভয়ে শঙ্কিত থাকবে এবং নতুন করে কেউ এভাবে নারী নির্যাতন ও ধর্ষণ করার সাহস পাবে না।
শাহাবুদ্দিন শুভ
প্রধান সম্পাদক, সিলেটপিডিয়া
www.sylhetpedia.com