রাজনৈতিক অঙ্গনে এখন সবচেয়ে আলোচিত বিষয় ১০ ডিসেম্বর বিএনপির ঢাকা বিভাগীয় সমাবেশ। কেন্দ্রে এ সমাবেশ ঘিরে কয়েক স্তরের পরিকল্পনা সাজাচ্ছে দলটি। ভেবে রাখছে সব ধরনের বিকল্প। পাঁচ লক্ষাধিক লোক সমাগম করে বিএনপি শরিকদের নিয়ে ঢাকা থেকে ঘোষণা দিতে চায় যুগপৎ আন্দোলনের। এজন্য সমাবেশের স্থান নিয়ে কয়েকটি বিকল্প ভাবা হয়েছে দলের পক্ষ থেকে।
নেতাকর্মীদের সমাবেশে উপস্থিতি নিশ্চিত করতে প্রয়োজনে ১০ দিন আগে থেকে ঢাকায় ঢোকার বার্তা দেওয়া হয়েছে। বিএনপি শান্তিপূর্ণ সমাবেশ করতে চায় জানিয়ে বাধা দিলে ‘লড়াই’ হবে বলে হুঁশিয়ারিও দিয়েছেন দলের নীতিনির্ধারক পর্যায়ের নেতারা।
সমাবেশ ঘিরে বিএনপির প্রস্তুতি ও উদ্দেশ্য নিয়ে দলের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাদের সঙ্গে কথা বলে এ তথ্য পাওয়া যায়।
বিএনপির একটি সূত্র বলছে, ঢাকার বিভাগীয় গণসমাবেশ সামনে রেখে এরই মধ্যে ব্যবস্থাপনা, প্রচার, অভ্যর্থনা, শৃঙ্খলাসহ কয়েকটি উপ-কমিটি গঠন করা হয়েছে। আগামী ২৫ নভেম্বর নাগাদ এসব কমিটি চূড়ান্ত হবে। প্রস্তুতি কমিটির মূল দায়িত্বে রয়েছেন দলের ভাইস চেয়ারম্যান আব্দুল্লাহ আল নোমান এবং উপদেষ্টা হিসেবে রয়েছেন স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাস।
পাঁচ শতাধিক নেতাকর্মীর সমন্বয়ে তৈরি হচ্ছে স্বেচ্ছাসেবক টিম। সমাবেশে নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় সিসিটিভি ক্যামেরা ও ড্রোন থাকবে। সমাবেশ থেকে বিক্ষোভ, মিছিল, পথসভা, লংমার্চ, হরতাল, অবরোধসহ সিরিজ কর্মসূচি আসতে পারে। এই কর্মসূচির মাধ্যমে বিএনপি শরিকদের সঙ্গে যুগপৎ আন্দোলনের যাত্রা শুরু করবে। পাশাপাশি ক্ষমতায় এলে পুরো রাষ্ট্র ব্যবস্থাকে আধুনিকায়নের মাধ্যমে কীভাবে পরিবর্তন করা হবে এর একটি রূপরেখাও তুলে ধরা হতে পারে সমাবেশ থেকে।
সূত্র জানায়, সরকারের পক্ষ থেকে নানান প্রতিবন্ধকতা আসবে ধরে নিয়ে সারাদেশ থেকে সমাবেশের ১০ দিন আগে থেকেই ঢাকায় এসে অবস্থান করতে বলা হয়েছে নেতাকর্মীদের। এক্ষেত্রে ঢাকায় এসে গ্রেফতার এড়িয়ে আত্মীয়ের বাসা ও হোটেলে সতর্কাবস্থায় থাকা, যাদের থাকার জায়গা নেই তাদের নেতাকর্মীদের বাসা-বাড়িতে রাখার জন্য বলা হয়েছে। প্রয়োজনে দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে নেতাকর্মীদের থাকার ব্যবস্থা করা হবে। কী উপায়ে কর্মীদের ঢাকায় আনা হবে সে বিষয়ে সংশ্লিষ্ট নেতাদের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। ডিসেম্বরের ৫ তারিখ স্থায়ী কমিটির সভায় সব বিষয় চূড়ান্ত হবে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ঢাকা মহানগর বিএনপির এক নেতা বলেন, আমরা নয়াপল্টনে বিভাগীয় গণসমাবেশ করার প্রস্তুতি নিয়ে এগোচ্ছি। নয়াপল্টন না হলে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে সমাবেশ করতে চাই। কিন্তু পুলিশ টঙ্গী ইজতেমা ময়দানের ওদিকে করার কথা বলছে। আমরা চাই ঢাকা শহরে।
নয়াপল্টনে সমাবেশ করতে চাওয়ার কারণ সম্পর্কে তিনি বলেন, পরিবহন ধর্মঘট ডাকা হলে কয়েকদিন আগ থেকেই নেতাকর্মীদের ঢাকায় আসতে হবে। টানা অবস্থান নেওয়া না লাগলেও টানা তিনদিন তাদের সেখানেই থাকতে হবে। নয়াপল্টনে সমাবেশ হলে সেক্ষেত্রে তাদের থাকা-খাওয়া কিংবা কোনো বাধা এলে তা মোকাবিলা করা সহজ হবে। কারণ কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের আশপাশের অলিগলি সবই পরিচিত। গুরুত্বপূর্ণ অনেক নেতার বাসাও রয়েছে সেখানে।
‘সমাবেশে তৃতীয়পক্ষ সুযোগ নিলে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি চরম অবনতি হওয়ার আশঙ্কা পুলিশের। বিশেষ করে জামায়াত-শিবিরের উপস্থিতি নিয়ে আশঙ্কা প্রকাশ করা হয়েছে। দলের পক্ষ থেকে পুলিশকে আশ্বস্ত করা হয়েছে সেখানে জামায়াত-শিবির থাকবে না, এটা বিএনপির নিজস্ব কর্মসূচি।’
এই নেতা আরও বলেন, ঢাকা বিভাগে ১১টি সাংগঠনিক জেলা। এর মধ্যে ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ, গাজীপুর থেকেই চার লাখ লোকের সমাগম হবে। দেশের অন্য জেলাগুলো থেকে এক-দেড় হাজার করে নেতাকর্মী এলে পাঁচ লাখ লোকের উপস্থিতি কঠিন কিছু নয়।
ঢাকা বিভাগীয় সাংগঠনিক সম্পাদক আব্দুস সালাম আজাদ বলেন, নয়াপল্টনে বিভাগীয় গণসমাবেশ সফল করতে আমরা আমাদের সাংগঠনিক কর্মকাণ্ড চালিয়ে যাচ্ছি। নয়াপল্টনের বিকল্প হিসেবে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান, মানিক মিয়া অ্যাভিনিউয়ের কথা বলেছি।
গণসমাবেশের চ্যালেঞ্জ সম্পর্কে তিনি বলেন, আমরা আশা করি সরকার অন্য বিভাগীয় গণসমাবেশে যে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করেছে সেটা ঢাকার ক্ষেত্রে করবে না। আর যদি গণপরিবহন বন্ধ করে দেয় তাহলে মানুষ দুদিন আগে হেঁটে ঢাকায় চলে আসতে পারে।
গণসমাবেশে লোক সমাগম সম্পর্কে আব্দুস সালাম আজাদ বলেন, লোক গুণে রাজনীতি হয় না। অন্যান্য বিভাগীয় গণসমাবেশে যে লোক সমাগম হয়েছে তারচেয়ে বেশি জনসমাগমের লক্ষ্য নিয়ে কাজ করে যাচ্ছি। ১০ ডিসেম্বর সারাদেশে নতুন কর্মসূচি ঘোষণা হবে। শান্তিপূর্ণ কর্মসূচির মাধ্যমে জনগণ তার অধিকার আদায় করে নেবে।
ঢাকা মহানগর উত্তর বিএনপির সদস্য সচিব আমিনুল হক বলেন, আমরা সব দিকে সতর্ক। যেহেতু সরকার আমাদের প্রতিটি বিভাগীয় সমাবেশে বাধা দিয়েছে, প্রশাসন দিয়ে প্রতিহত করার চেষ্টা করেছে, দলীয় ক্যাডার দিয়ে আক্রমণ করেছে তাই আমরা এবার সব দিক থেকেই প্রস্তুতি রেখেছি। আমরা আমাদের কৌশল নিয়ে এগোচ্ছি।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাস বলেন, আমাদের অভিজ্ঞতার আলোকে ১০ ডিসেম্বর ঢাকার মহাসমাবেশে আমরা কয়েক লাখ মানুষের উপস্থিতি নিশ্চিত করবো। ১০ ডিসেম্বর সমাবেশ হবে শান্তিপূর্ণ। কিন্তু সরকার যদি সেই সমাবেশে বাধা দেয়, তাহলে বাধবে লড়াই। এই মহাসমাবেশ থেকে সরকার পতন না হওয়া পর্যন্ত আন্দোলন চালিয়ে যেতে কর্মসূচি ঘোষণা করবো।
১০ ডিসেম্বর নিয়ে আমানউল্লাহ আমানের বক্তব্য প্রসঙ্গে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর সম্প্রতি বলেছেন, এসব কথা আমি কিংবা আমাদের দলের নীতিনির্ধারক পর্যায়ের কোনো নেতা ঘোষণা করেননি। তাই এসব বিষয়ে গুরুত্ব দেওয়ার কিছু নেই। ওই দিন কী হবে, সে সিদ্ধান্ত আমরা স্থায়ী কমিটির বৈঠকে সিদ্ধন্ত নেবো।
গত ২৮ সেপ্টেম্বর দেশের ১০ সাংগঠনিক বিভাগে সমাবেশের ঘোষণা দেন বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। এর মধ্যে গত ৮ অক্টোবর চট্টগ্রাম, ১৫ অক্টোবর ময়মনসিংহ, ২২ অক্টোবর খুলনা, ২৯ অক্টোবর রংপুর, ৫ নভেম্বর বরিশাল, ১২ নভেম্বর ফরিদপুর ও ১৯ নভেম্বর সিলেটে সমাবেশ করেছে বিএনপি। ২৬ নভেম্বর কুমিল্লা, ৩ ডিসেম্বর রাজশাহীতে এবং ঢাকায় আগামী ১০ ডিসেম্বর সমাবেশ করবে দলটি।
এদিকে ২০ দলীয় জোটের বেশ কয়েকটি শরিক দলের নেতাদের সঙ্গে আলাপ করে জানা গেছে, তারা এখনো বিএনপির ঢাকার সমাবেশের আমন্ত্রণ পাননি।
তবে বাংলাদেশ মাইনরিটি জনতা পার্টির চেয়ারম্যান সুকৃতি কুমার মন্ডল জানিয়েছেন, বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের সঙ্গে তার কথা হয়েছে। ১০ তারিখের সমাবেশে শরিকরা আমন্ত্রণ পাবেন।
সূত্র : জাগো নিউজ