ব্যস্ত নগরী ঢাকায় ছুটির দিনে কোথাও পরিবার নিয়ে ঘুরতে যাবেন, জায়গা কই? এখন ঘুরতে যাওয়া মানেই নতুন নতুন রেস্টুরেন্টে খেতে যাওয়া। শুক্রবার মাহমুদ সাহেবের পরিবার ঠিক করলো, রাজধানীর হাতিরঝিলে কিছু সময় কাটিয়ে গুলশানের কোনও রেস্টুরেন্টে রাতের খাবার খেয়ে বাসায় ফিরবেন। বাধ সাধলেন সদ্য টিন-এজ পার হওয়া মেয়ে। তার কথায়, ‘বাবা ওখানে টিকটকারদের উৎপাত, ভালো লাগবে না’।
মেয়ের এই কথা শোনার পর বিকালে ঢাকার কিছুটা বাইরে ধলেশ্বরীর আশপাশে ঘুরে আসাতেই সায় দিলেন সবাই। মাহমুদ সাহেব জানান,, সেখানে পৌঁছেও চারপাশে টিকটক করা ছেলে-মেয়েদের দেখে নিজের অজান্তেই মুখে এলো, এখানেও সেই ‘টিকটকার’!
ক্রিকেট খেললে ক্রিকেটার, ফুটবল খেললে ফুটবলার কিংবা চিকিৎসা করলে ডাক্তার বলা হবে এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু টিকটক করলে ‘টিকটকার’ পরিচয়ের মধ্যে মহাত্ম্য নেই। এই পরিচয় যেন এখন নেগেটিভ একটা সম্বোধনে রূপ নিয়েছে। খোদ টিকটকাররাই বলছেন, তাদের সম্মানার্থে ‘টিকটকার’ বলা হয় না, এটা গালির মতোই ব্যবহার করা হয়।
সম্প্রতি বাংলাদেশ জাতীয় দলের এক ক্রিকেটারের টিকটক আইডি ভেরিফায়েড হয়েছে। বিষয়টি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে পোস্ট করে জানিয়েছেন তিনি নিজেই। সেই পোস্টের কমেন্টেই দেখা যায় নানা ধরনের সমালোচনা। এর বাইরেও হচ্ছে ট্রল, মিম ও সমালোচনামূলক পোস্ট। এমনকি সোশ্যাল হ্যান্ডেলে এমনটাও লেখা হচ্ছে, ‘ক্রিকেটার নাকি টিকটকার?’।
ভিডিও শেয়ারিং সাইট টিকটক নানা কারণে এই দেশে নেতিবাচক রূপ পেয়েছে। এমনকি বিভিন্ন সময় সাইটটি নিষিদ্ধেরও দাবি উঠেছে। তবে যারা খারাপ বলছেন, তাদের যদি জিজ্ঞেস করা হয় টিকটক কী? হয়তো বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই উত্তর আসবে, ‘এসব (টিকটক ভিডিও) অল্পবয়সী ছেলে-মেয়েরা করে, খারাপ জিনিস।’
টিকটককে ‘খারাপ’ বলা অন্তত ১০ জন বিভিন্ন বয়সী ব্যক্তির কাছে জানতে চাওয়া হয়, এতে কী খারাপ জিনিস থাকে? তাদের কেউই ‘কী খারাপ জিনিস’ থাকে তা সুনির্দিষ্ট করে বলতে পারেননি। তাদের মধ্যে আট জন বলেছেন, ‘স্কুল-কলেজের ছেলেরা চুলের নানা রকম ‘বখাটে কাট’ দেয়, রঙ করে। আবার এদের বেশিরভাগই নারীদেরও শ্লীলতাহানি করে। এসব ভিডিও তারা দেখেছেন কিনা জানতে চাইলে তাদের অধিকাংশই বলেন, ‘তারা দেখেননি, শুনেছেন।’
টিকটকের ওয়েব কী বলছে?
টিকটক তাদের ওয়েবসাইটের মিশন কী— জানাতে লিখেছে, টিকটক ছোট আকারের মোবাইল ভিডিও শেয়ারের জন্য শীর্ষস্থানে রয়েছে। তাদের লক্ষ্য হলো—সৃজনশীলতাকে অনুপ্রাণিত করা এবং আনন্দ দেওয়া। যুক্তরাষ্ট্রের লস অ্যাঞ্জেলেস, নিউ ইয়র্ক, যুক্তরাজ্যের লন্ডন, ফ্রান্সের প্যারিস, জার্মানির বার্লিন, আরব আমিরাতে দুবাই, ভারতের মুম্বাই, সিঙ্গাপুর, ইন্দোনেশিয়ার জাকার্তা, দক্ষিণ কোরিয়ার সিউল এবং জাপানের টোকিওসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে টিকটকের অফিস রয়েছে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, মূলত এই ছোট আকারের ভিডিওর মধ্যে আপনি চাইলে ইতিবাচক বার্তাও দিতে পারেন, আবার চাইলে সেটি নিছক সস্তা বিনোদনের মাধ্যমে ফলোয়ার তৈরির চেষ্টাও করতে পারেন। এটা সম্পূর্ণভাবে নির্ভর করে ব্যবহারকারীর ওপর।
বড় বড় প্রতিষ্ঠানও টিকটক ব্যবহার করে
টিকটকে রুচিশীল কনটেন্টের অভাব, এটি তরুণদের বিপথে নিয়ে যাচ্ছে—এমন অপবাদ প্রায়শই শোনা যায়। আবার এও সত্য যে, জনপ্রিয় এই প্ল্যাটফর্মটিতে তরুণদের কাছে পৌঁছানোর মাধ্যম হিসেবে টিকটককে গুরুত্ব দিচ্ছে বিশ্বের বড় বড় প্রতিষ্ঠান। ইন্টারন্যাশনাল ফেডারেশন অব রেড ক্রস এবং রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটিজের সঙ্গে অংশীদারিত্বে টিকটক সম্প্রতি ১০০টিরও বেশি জায়গায় ‘জলবায়ু পরিবর্তন’ বিষয়ে সচেতনতা ছড়িয়ে দিতে একটি প্রচারণা শুরু করে।
প্রতিষ্ঠানটি বলছে, ‘বিশেষ প্রভাব, ফিল্টার এবং স্টিকারসহ, টিকটক ব্যবহারকারীরা জলবায়ু পরিবর্তন সম্পর্কে বিভিন্ন প্রচারণায় অংশ নিচ্ছেন। তারা আবহাওয়া পরিবর্তনের বিভিন্ন প্রভাবের দিক নিয়েও দৃষ্টি আকর্ষণ করে ভিডিও তৈরি করছেন, পৃথিবীকে রক্ষার আহ্বান জানাচ্ছেন। এমন ভালো কন্টেন্ট তৈরির উদাহরণও অনেক আছে।
‘টিকটকার’ পরিচয় নেতিবাচক হলো কীভাবে?
বাংলাদেশে টিকটক আসার পরে একের পর এক অপরাধে জড়িয়ে পড়ার ঘটনা সামনে আসতে থাকে। টিকটকের মাধ্যমে অর্থনৈতিকভাবে দুর্বল পরিবারের মেয়েদের দিয়ে ভিডিও বানানোর মাধ্যমে ফলোয়ার বাড়ানো, এমনকি তাদের বিদেশে পাচারের অভিযোগও আসে।
এমন বিষয়ে সবচেয়ে বড় খবরটি আসে গতবছর মাঝামাঝি সময়ে। সেসময় ভারতে কয়েকজন মিলে এক বাংলাদেশি এক তরুণীকে যৌন নির্যাতনের ভিডিও অনলাইনে ভাইরাল হয়। এরপর বিষয়টির অনুসন্ধানে বেরিয়ে আসে নানা তথ্য। ওই তরুণীকে নির্যাতনের ঘটনায় রিফাদুল ইসলাম হৃদয় ওরফে টিকটক হৃদয় নামে ঢাকার মগবাজার এলাকার এক বাসিন্দাকে শনাক্ত করে পুলিশ। এই রিফাদুলই মেয়েটিকে মধ্যপ্রাচ্যে পাঠানোর কথা বলে তার বছরখানেক আগে ভারতে নিয়ে যান বলে তার পরিবার জানায়। ওই ঘটনায় উঠে আসে একটি চক্রের বেশ কয়েকজনের নাম।
এ ঘটনার প্রায় এক বছর পর গত মে মাসে আরেক লোমহর্ষক ঘটনা সামনে আসে। টিকটক ভিডিও তৈরি করতে গিয়ে স্বল্প দিনের পরিচয়ে বিয়ে হয় এক দম্পতির। পরে ওই গৃহবধূকে টিকটক ভিডিও বানানোর জন্য ভারতে নিয়ে যাওয়ার কথা বলে ১৩ মে লালমনিরহাটে নিয়ে যান তার স্বামী সোহেল মিয়া। ভুক্তভোগীর বরাতে পুলিশ জানায়, সোহেল সেখানে নারী পাচারকারী কয়েকজনের হাতে তার স্ত্রীকে তুলে দিয়ে কৌশলে সরে যান। এসময় পাচারকারী মোকছেদুল ইসলাম ধর্ষণ করেন ভুক্তভোগীকে। ভারত থেকে কোনোক্রমে পালিয়ে দুই দিন পর দহগ্রামে ফিরে এলে এইসময় পাচারকারী আশরাফুল ইসলাম ওই নারীকে আটকে রেখে ধর্ষণ করে। এ ঘটনায় পরে তিনজনকে গ্রেফতার করে পুলিশ।
অন্যদিকে চলতি বছর ২ জুন টিকটিক ভিডিও বানিয়ে ইউটিউবে ছেড়ে স্কুল, কলেজ পড়ুয়া তরুণ-তরুণীদের বিপথগামী করার অপরাধে ৯ জনকে আটক করে রাজশাহী নগর গোয়েন্দা পুলিশ। এদের মধ্যে তরুণী তিন জন। সন্ধ্যা থেকে বিশেষ অভিযান পরিচালনা করে নগরীর পদ্মা গার্ডেন, ভদ্রা পার্ক, জিয়া পার্ক ও বিমান চত্বর এলাকা থেকে তাদের আটক করা হয়।
পুলিশ কমিশনার আবু কালাম সিদ্দিক সেসময় গণমাধ্যমকে বলেন, টিকটকাররা দরিদ্র পরিবারের মেয়েদের প্রলোভন দেখিয়ে ভিডিও বানিয়ে ইউটিউবে ছেড়ে দিচ্ছে। তাদের শক্তিশালী গ্রুপ রয়েছে, যারা ভিডিও বানানোর এক পর্যায়ে মেয়েদের দেশের বাইরেও পাঠানোর চেষ্টা করছে। রাজধানী ঢাকায় এধরনের অপরাধে জড়িয়ে পড়ার একাধিক সংবাদ ছড়িয়ে গেলে টিকটক নেতিবাচক অ্যাপ হিসেবেই পরিচিতি পায়। যারা এই টিকটক করে তারা ‘টিকটকার’ বলা হয়; যা শুনলে একপ্রকারের তাচ্ছিল্য ও বিরক্তির জন্ম দেয়।
এছাড়া টিকটকের ভিডিও বানানোকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন কিশোর গ্যাং তৈরি ও বিভিন্ন সময় টিকটক করতে গিয়ে দুর্ঘটনার ঘটনাও সামনে এসেছে।
টিকটকে টাকা নেই, তাহলে কেন ‘কালক্ষেপণ’
মনে করা হয়, টিকটক সেলিব্রিটি হয়ে গেলে আপনি খুব সহজেই বড়লোক হয়ে যাবেন। কিন্তু আসলে কি তাই? আসলে টিকটক ব্যবহারকারীরা অ্যাপের মাধ্যমে শুধু তাদের ফলোয়ার বাড়াতে পারে। বেশিরভাগ ব্যবহারকারী, যাদের ফলোয়ার সংখ্যা অনেক, তারা তাদের শ্রোতাদের অন্যান্য প্ল্যাটফর্ম বা ওয়েবসাইট পরিদর্শন করতে বলবেন। টিকটক প্রতিটি অ্যাকাউন্ট দাতাদের তাদের প্রোফাইলে ইনস্টাগ্রাম এবং ইউটিউব লিঙ্ক শেয়ার করার অনুমতি দেয়, যার ফলে তারা একপ্রকার মিউচ্যুয়াল ফলোয়ার পেয়ে থাকে। আপনি ফলো করেন না তাদের ভিডিও সেখানে দেখতে পারবেন। যার জন্য অ্যাপটি এতোই আসক্তিপূর্ণ হয়ে ওঠে যে আপনার একের পর এক ভিডিও দেখে যেতে মন চাইবে। এই অ্যাপের মাধ্যমে যাদের ছোট অনুসারী (কম ফলোয়ার) আছে তারা ‘ভাইরাল’ হতে পারে এবং রাতারাতি অনলাইন সেলিব্রিটি হয়ে উঠতে পারে। এটা সম্ভবত আরেকটি কারণ যে, টিকটক একটি আকর্ষণীয় প্ল্যাটফর্ম।
অপরাধের জায়গাগুলোতে সতর্ক অবস্থান নিতে পারলে ভালো মাধ্যম হিসেবে পাওয়া যেতে পারে টিকটককে উল্লেখ করে সাইবার সিকিউরিটি বিশেষজ্ঞ তানভীর হাসান জোহা বলেন, টিকটক একটি বিনোদনের মাধ্যম। আমাদের একটি বিষয় বুঝতে হবে, আমাদের ডিজিটাল মেন্টাল হেলথটা গুরুত্বপূর্ণ। কারণ ডিজিটাল মেন্টাল হেলথ অস্থিতিশীলতা যে একটা রোগ। এটা নির্ণয় না করতে পারলে আমরা কখনোই সোশ্যাল বা ডিজিটাল মাধ্যমটাকে সঠিকভাবে ব্যবহার করতে পারবো না।
তিনি দুই জন ‘ভাইরাল’ ব্যক্তির নাম উল্লেখ করেন, যাদের একজন নানা অঙ্গভঙ্গির ভিডিও কিংবা বিভিন্ন রকম গান বিকৃত করে গাওয়ার জন্য ইতোমধ্যে ব্যাপক ‘জনপ্রিয়তা’ পেয়েছেন এবং নিজেকে একজন ‘হিরো’ বলেও দাবি করেন। অন্যজন প্রবাসে থেকে বিভিন্ন সময়ে গালাগালি ও বিভিন্ন অঙ্গভঙ্গির ভিডিও প্রকাশ করেন। এই সাইবার সিকিউরিটি বিশেষজ্ঞ বলেন, ‘এদের অযাচিত কনটেন্ট লাখ লাখ ভিউ ও কমেন্ট দিয়ে উৎসাহিত করা হয়, সেখান থেকে বোঝা যায়, আমাদের মানসিক ভারসাম্যতা কতটুকু রয়েছে। রাষ্ট্রপক্ষের ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে মানসিক স্থিতিশীলতার ওপর জোর দেওয়া উচিত, সেই সঙ্গে ডিজিটাল মাধ্যমের অপরাধীদেরও চিহ্নিত করা দরকার।’
সূত্র: বাংলা ট্রিবিউন