বৃষ্টিপাত ও উজানের ঢলে সৃষ্ট বন্যায় সিলেটের জকিগঞ্জ ও কানাইঘাট উপজেলায় প্রায় আড়াই লাখ মানুষ পানিবন্দি থাকা অবস্থায়ও ভোটগ্রহণ অনুষ্ঠিত হচ্ছে। আগামীকাল বুধবার (৫ জুন) ষষ্ট উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে এই দুই উপজেলায় ভোটগ্রহণ অনুষ্ঠিত হবে।
এরই মধ্যে সকল প্রস্তুতি নিয়েছে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। ভোটগ্রহণের সরঞ্জামাদিও পাঠানো হচ্ছে কেন্দ্রে কেন্দ্রে।
এদিকে, বন্যায় লাখো মানুষ পানিবন্দি থাকা অবস্থায়ও ইসির এমন তৎপরতায় ক্ষোভ প্রকাশ করছেন ভোটাররা। দূর্যোগ-দুর্ভোগের মধ্যে মানুষজন ভোট দিতে কেন্দ্রে না যাওয়ার সম্ভবনাই দেখছেন ভোটাররা।
তাদের দাবি, এই দুই উপজেলার অসংখ্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এখনও পানিতে তলিয়ে রয়েছে। এসব প্রতিষ্ঠান ভোটগ্রহণ কেন্দ্র হিসেবে ব্যবহার করার কথা। তবুও নির্বাচন শেষ করতে চাচ্ছে ইসি।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বন্যা পরিস্থিতি নিয়ে প্রতিবেদন নির্বাচন কমিশনে (ইসি) পাঠানো হয়েছে। ইসির অনুমতি সাপেক্ষে ভোটগ্রহণের আয়োজন করা হয়েছে।
সিলেট জেলা প্রশাসনের তথ্যমতে, মঙ্গলবার (৩ জুন) দুপুর পর্যন্ত জকিগঞ্জ উপজেলায় ৮ ইউনিয়ন ও এক পৌরসভার ১১৩টি গ্রাম প্লাবিত রয়েছে। এসব গ্রামে বন্যা আক্রান্ত মানুষের সংখ্যা ১ লাখ ৫৬ হাজার ১৪৭জন। এই উপজেলায় মোট জনসংখ্যা রয়েছে ২ লাখ ৬৭ হাজার ৩০৯জন। সে হিসেবে অর্ধেকের চেয়ে বেশি মানুষ বন্যা আক্রান্ত। এই উপজেলায় ৫৫টি আশ্রয়কেন্দ্রে এখনও ৪০৮জন মানুষ অবস্থান করছেন।
একইভাবে মঙ্গলবার পর্যন্ত কানাইঘাট পৌরসভা ও উপজেলার ৮ ইউনিয়নের ১৯০ প্লাবিত রয়েছে। জেলা প্রশাসনের সর্বশেষ তথ্যমতে, এসব এলাকার ৮০ হাজার ৬১০ জন মানুষ বন্যা আক্রান্ত রয়েছেন। এই উপজেলায় ৩২টি আশ্রয়কেন্দ্রে এখনও ৪৭ জন মানুষ অবস্থান করছেন। এই উপজেলার মোট জনসংখ্যা ৩ লাখ ১৭ হাজার ৫৭৪ জন। আর বন্যা আক্রান্ত ৮০ হাজার ৬১০ জন। সেই হিসেবে এ চতুর্থাংশ মানুষ এখনও পানিবন্দি রয়েছেন।
ঘুর্ণিঝড় রিমালের প্রভাবে সিলেটে টানা বৃষ্টি ও উজান থেকে নেমে আসা ঢলে বন্যা দেখা দেয়। প্রথমদিকে জেলার গোয়াইনঘাট, জৈন্তাপুর, কোম্পানীগঞ্জ ও কানাইঘাটের নিম্নাঞ্চল পানিতে তলিয়ে যায়। কয়েকদিনের ব্যবধানে ভয়াবহ পরিস্থিতি সৃষ্টি হয় এসব উপজেলায়।
এরপর গত বুধবার (২৯ মে) রাতে সুরমা-কুশিয়ারা নদীর প্রতিরক্ষা বাঁধ ভেঙে ২৪ ঘন্টার ব্যবধানে তলিয়ে যায় জকিগঞ্জ উপজেলার অর্ধশত গ্রাম। এরপর একেরপর এক তলিয়ে যেতে থাকে বিভিন্ন এলাকা। নদনদীর পানি বৃদ্ধির কারণে ভয়াবহ অবস্থা দেখা দিয়েছে সিলেটের ৭টি উপজেলায়। বাদ যায়নি সিলেট নগরীরও। সিলেট সিটি করপোরেশনের সর্বশেষ তথ্যমতে, নগরীর ২৮টি ওয়ার্ড বন্যা আক্রান্ত হয়েছে।
এদিকে, গত তিন-চারদিন নদ-নদীর পানি কিছুটা কমায় উজানে বন্যা পরিস্থিতি উন্নতির দিকে ছিল। তবে ফের বৃষ্টিপাত শুরু হওয়ায় ভাটি এলাকা নতুন তলিয়ে যাচ্ছে।
একই সাথে নদনদীর পানিও কয়েকটি পয়েন্টে বাড়তে শুরু করেছে। আবার কিছু পয়েন্টে কমার খবরও পাওয়া গেছে।
পানি উন্নয়ন বোর্ড জানায়, মঙ্গলবার (৪ জুন) দুপুর ১২টায় সুরমা নদীর পানি কানাইঘাট পয়েন্টে বিপৎসীমার ৬৬ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিল। এর আগে সকাল নয়টায় বিপৎসীমার ৬০সেন্টিমিটার ও সকাল ছয়টায় বিপৎসীমার ৫৩ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিল।
অন্যদিকে কুশিয়ারা নদীর পানি আমলশীদ পয়েন্টে সকাল ৬টায় ছিল বিপৎসীমার ২৮ সেন্টিমিটার উপরে। পরে সকাল ৯টায় তা কমে ২৮ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিল। দুপুর ১২টায় আরও এক পয়েন্টে কমেছে এই নদীর পানি।
এদিকে, নদনদীর পানি ওঠানামা করলেও সিলেটে বৃষ্টিপাত অব্যাহত রয়েছে। গত ২৪ ঘন্টায় সিলেটে ৫২ দশমিক ২ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করেছে আবহাওয়া অফিস। আজ মঙ্গলবার সকাল ৬টা থেকে ৯টা পর্যন্ত আরও ৬ দশমিক ৪ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে। বেলা ১টায় এ প্রতিবেদন তৈরির সময়ও বিভিন্ন স্থানে বৃষ্টিপাতের খবর পাওয়া গেছে।
সিলেটে সৃষ্ট বন্যায় জেলা প্রশাসনের প্রতিদিনের পাঠানো তথ্য ঘেঁটে দেখা গেছে, গত রোববার (২ জুন) জকিগঞ্জ উপজেলার ৯ ইউনিয়ন ও একটি পৌরসভার ১১০টি গ্রাম প্লাবিত ছিল। এদিন বন্যা আক্রান্ত মানুষের সংখ্যা ছিল ১৫১ হাজার ৮০০ জন। এদিন ৫৫ টি আশ্রয়কেন্দ্রে আশ্রয় নেওযা মানুষের সংখ্যা ছিল ৪০৮ জন।
একইদিনে কানাইঘাট পৌরসভা ও উপজেলার ৮ ইউনিয়নের ১৯০ টি গ্রাম প্লাবিত ছিল। এসব এলাকায় বন্যা আক্রান্ত মানুষের সংখ্যা ছিল ৮০ হাজার ৬০০ জন। এদিন উপজেলার ৩২টি আশ্রয়কেন্দ্রে ৭৭২জন মানুষ অবস্থান করছিলেন।
এর আগের দিন শনিবার (১ জুন) জকিগঞ্জ উপজেলার ৯ ইউনিয়ন ও একটি পৌরসভার মধ্যে বন্যায় প্লাবিত ছিল ১০টি। এদিন বন্যায় প্লাবিত গ্রামের সংখ্যা ছিল ১১০টি। আর বন্যা আক্রান্ত মানুষের সংখ্যা ছিল ১ লাখ ৪৮ হাজার ৫০০জন। এদিন ওই উপজেলায় আশ্রয়কেন্দ্রের সংখ্যা ছিল ৫৫টি। এসব আশ্রয়কেন্দ্রে আশ্রয় নেওয়া মানুষের সংখ্যা ছিল ১৯৮ জন।
ওইদিন কানাইঘাট উপজেলায় ৮ ইউনিয়ন ও একটি পৌরসভার ১৯০টি গ্রাম প্লাবিত ছিল। এসব এলাকায় বন্যঅ আক্রান্ত মানুষের সংখ্যা ছিল ৮০ হাজার ৬০০ জন। এ উপজেলায় এদিন আশ্রয়কেন্দ্রের সংখ্যা ছিল ৩২টি। এসব আশ্রয়কেন্দ্রে ১ হাজার ৪৭৬ জন মানুষ আশ্রয় নিয়েছিলেন।
এদিকে, বন্যা পরিস্থিতির মধ্যে নির্বাচন আয়োজনের কারণে ভোটারদের উপস্থিতি নিয়ে শঙ্কা দেখা দিয়েছে।
ভোটাররা জানান, বন্যায় পরিস্থিতি ভয়াবহ। মানুষজন দুর্ভোগ-আতঙ্কে দিন কাটাচ্ছে। এ পরিস্থিতিতে ভোটকেন্দ্রে যাওয়ার মতো পরিস্থিতি মানুষের নেই।
নির্বাচনের সহকারী রিটার্ণিং কর্মকর্তা ও জকিগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) আফসানা তাসলিম বলেন, পানি উন্নয়ন বোর্ডের রিপোর্ট ও আবহাওয়ার তথ্য ইসিতে পাঠানো হয়েছে। পূর্বাভাস অনুযায়ী সামনে বন্যা পরিস্থিতির আরও অবনতি হওয়ার আশঙ্কা আছে। তাই ভোটগ্রহণের বিষয়টি নির্দিষ্ট তারিখেই শেষ করার উদ্দেশ্যে কাজ চলছে।
সিলেটের সিনিয়র জেলা নির্বাচন কর্মকর্তা মোহাম্মদ জিল্লুর রহমান জানান, জকিগঞ্জ উপজেলার ৫টি কেন্দ্র এবং কানাইঘাট উপজেলার ৪টি কেন্দ্র বন্যার পানিতে প্লাবিত হওয়ায় বিকল্প কেন্দ্রের তালিকা নির্বাচন কমিশনে পাঠানো হয়েছে। বিকল্প কেন্দ্রগুলোকে কমিশন অনুমোদন দিলে প্লাবিত কেন্দ্রগুলোর বদলে নতুনগুলোতে ভোট নেওয়া হবে।
নির্বাচনের রিটার্ণিং কর্মকর্তা ও সিলেটের অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট ইমরুল হাসান বলেন, দুই উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা ও সহকারী রিটার্ণিং কর্মকর্তা এবং সংশ্লিষ্ট কমিটির বন্যা পরিস্থিতি নিয়ে প্রতিবেদন নির্বাচন কমিশনে পাঠানো হয়েছে। ইসি অনুমতি দেওয়ায় ভোটগ্রহণের সকল প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছে। আগামীকাল ভোটগ্রহণ হবে।
তিনি বলেন, দুই উপজেলায় কয়েকটি কেন্দ্র পানিতে তলিয়ে থাকায় সেগুলো পরিবর্তন করে নতুন কেন্দ্র নির্বাচন করা হয়েছে। এসব কেন্দ্রে ভোটগ্রহণ হবে।
তিনি আরও বলেন, বন্যার সার্বিক পরিস্থিতি আমরা ইসিকে জানিয়েছি। ইসি সব জেনে অনুমতি দেওয়ায় আগামীকাল ভোটগ্রহণ অনুষ্টিত হচ্ছে। এ লক্ষ্যে সকল প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছে। সকাল থেকে ভোটকেন্দ্রে ভোটগ্রহণের সরঞ্জাম পাঠানো শুরু হয়েছে।
উল্লেখ্য, জকিগঞ্জ ও কানাইঘাট উপজেলায় ২৩ জন প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। এরমধ্যে জকিগঞ্জে চেয়ারম্যান পদে চারজন, ভাইস চেয়ারম্যান পদে চারজন এবং মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান পদে দুজন প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। এ ছাড়া কানাইঘাট উপজেলায় চেয়ারম্যান পদে সাতজন, ভাইস চেয়ারম্যন পদে চারজন এবং মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান পদে দুজন নির্বাচন করছেন।