শেফালি বেগম (৩০)। তিনি সিলেটের দক্ষিণ সুরমা উপজেলার হবিনন্দী গ্রামের মৃত মানিক মিয়ার মেয়ে। গত ৬ মে তিনি পিতার বাড়িতে আত্মহত্যা করেন। আত্মহত্যায় প্ররোচনার অভিযোগ এনে ঘটনার দুইদিন পর গত ৮ মে শেফালি বেগমের স্বামী কামরুল ইসলামকে প্রধান আসামি করে সিলেটের মোগলাবাজার থানায় শেফালির ভাই পারভেজ আহমদ একটি হত্যা মামলা দায়ের করেন। (মামলা নং : ৭, তাং: ৮/৫/২০২৩ ইং)। এতে কামরুল ইসলামের মা ও তার দুই বোনকে আসামি করা হয়।
এদিকে শেফালি বেগমের আত্মহত্যার ১২দিন পর গত ২০ মে শেফালি বেগমের ভাই পারভেজ আহমদসহ ৬ জনকে আসামি করে গোলাপগঞ্জ মডেল থানায় আগুন দিয়ে খড়ের ঘর পুড়ানোর একটি মামলা করেন শেফালি বেগমের শাশুড়ি রুসনা বেগম (৫০)। (মামলা নং : ২৬, তাং: ২০/৫/২৩ ইং)। এতে আরও ২/৩ জনকে অজ্ঞাত আসামি করা হয়।
ঘটনাটি জানাজানি হলে দুই উপজেলা জুড়ে শুরু হয় আলোচনা-সমালোচনা। শেফালি বেগমের বাড়ির লোকজন বলছেন, আত্মহত্যার মত একটি ঘটনা ধামাচাপা দিতে গোলাপগঞ্জ থানায় তারা মিথ্যা আগুনের মামলা করেন।
তবে শেফালি বেগমের স্বামী কামরুল ইসলাম বলেন, ‘আগুনে খড়ের ঘর পুড়ানোর বিষয়টি শতভাগ সত্য। আমাদের কাছে অনেক প্রমাণ রয়েছে।’
কামরুল ইসলাম আরও বলেন, ‘বিষয়টি নিয়ে এখন আমি কোন কিছু বলতে চাই না। আমি প্রেস কনফারেন্স করার প্রস্তুতি নিচ্ছি। সেখানে সব ঘটনা তুলে ধরব।’ এর বাইরে আর কোন কথা বলতে রাজি হননি তিনি। এছাড়া তিনি আপাতত নিউজ না করতে অনুরোধ জানান।
মোগলাবাজার থানায় দায়েরকৃত শেফালি বেগমের ভাইয়ের করা মামলা সূত্রে জানা যায়, ২০২১ সালের ৫ এপ্রিল শেফালি বেগমের সাথে কামরুল ইসলামের বিয়ে হয়।
বিয়ের কয়েকদিন যেতে না যেতে মামলার আসামিরা তুচ্ছ বিষয় নিয়ে শেফালি বেগমকে গালিগালাজ ও মারপিট করতেন। মারামারির বিষয়টি শেফালি বেগম তার পরিবারের কাউকে না জানিয়ে নিরবে সহ্য করতে থাকেন। পরবর্তীতে বিয়ের এক বছর পর শেফালি বেগমকে তার শ্বশুরবাড়ির লোকজন মারপিট করে হাসপাতালে ভর্তি করলে শেফালির পিতার বাড়ির লোকজন অত্যাচারের বিষয়টি জানতে পারেন।
আর জানা যায়, বিষয়টি নিয়ে দু’পক্ষের মধ্যে শালিস বৈঠক অনুষ্ঠিত হলে আর কোন দিন এধরণের অত্যাচার করবেন না বলে তারা পুনরায় শেফালি বেগমকে বাড়িতে নিয়ে আসেন। কিন্তু এরপরও আসামিরা শেফালির উপর অত্যাচার থামাননি। পারিবারিক বিভিন্ন বিষয় নিয়ে শেফালি বেগমকে তারা গালিগালাজ, মানুষিক ও শারীরিক নির্যাতন করা শুরু করে। আসামিদের অত্যাচারে শেফালি বেগম মানুষিক ও শারীরিক ভাবে অসুস্থ হয়ে পড়েন। অসুস্থ হওয়ার কারণে শেফালি বেগমকে আত্মহত্যার দুই মাস পূর্বে তার স্বামী কামরুল ইসলাম তাকে তার পিতার বাড়িতে নিয়ে যান। এরপর সেখানেই রেখে আসেন। পরবর্তীতে আসামিরা শেফালি বেগমের খুঁজ খবর নেওয়া বন্ধ করে দেন।
আর জানা যায়, শেফালি বেগমের আত্মহত্যার এক সপ্তাহ আগে তার স্বামী কামরুল ইসলাম তাদের ব্যবহৃত মোবাইল নাম্বার থেকে শেফালি বেগমের ব্যবহৃত মোবাইল নাম্বারের ওয়াটসঅ্যাপ একাউন্টে ফোন করে শেফালি বেগমকে তালাক দেয় এবং অন্য মহিলাকে বিয়ে করবে বলে জানায়। সেই সাথে কামরুল ইসলাম শেফালি বেগমকে আত্মহত্যার জন্য বিভিন্ন ধরণের প্ররোচনা দিতে থাকে। বিষয়টি শেফালি বেগম মামলার অন্য আসামিদের জানালে তারাও তালাকের বিষয়টি বলে এবং অন্য মেয়েকে বিয়ের কথা বলেন। বিষয়টি শোনার পর থেকে শেফালি বেগম মানসিকভাবে বিপর্যস্থ হয়ে পড়েন। যে কারণে শেফালি বেগম পাশে অবস্থিত মামার ঘরে বেড়াতে গিয়ে সবার অগোচরে গত ৬ মে গলায় ফাঁস নেন।
শেফালি বেগমের পরিবার ও মামলার বাদি পারভেজ আহমদ বলেন, কামরুল ও তার পরিবারের লোকজনই শেফালিকে আত্মহত্যার দিকে ঠেলে দিয়েছেন। তারা আমাদেরকে চাপে রাখতেই আগুনে পুড়ানোর মিথ্যা মামলা দায়ের করেছেন।
এদিকে গোলাপগঞ্জ মডেল থানায় দায়েরকৃত শেফালি বেগমের শাশুড়ির করা মামলা সূত্রে জানা যায়, দুইবার গর্ভের সন্তান নষ্ট হওয়ায় তার পূত্রবধু শেফালি বেগম মানসিকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়েন। পরে চিকিৎসায় কিছুটা সুস্থ হলে শেফালি বেগমকে তার মা বাড়িতে নিয়ে যান। কয়েকদিন পর জানতে পারেন তার পুত্রবধূ মারা গেছেন। এরপর থেকে তার ছেলের শ্বশুরবাড়ির লোকজন তাদের হুমকি ও ভয়ভীতি প্রদর্শন করছেন। এরপর পারভেজ আহমদ ১২ মে দেশীয় অস্ত্রশস্ত্রসহ লোকজন নিয়ে হামলা চালান ও বসতঘরের পাশে খড়ের ঘরে আগুন লাগিয়ে দেন।
তবে এরই মাঝে যে আত্মহত্যার প্ররোচনার অভিযোগে তিনি ও তার পুত্র-কন্যাদের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে সেটা চেপে যান রুসনা বেগম। তার পুত্রবধু শেফালি বেগম যে আত্মহত্যা করেছেন সেটাও তিনি মামলার অভিযোগে উল্লেখ করেননি।
মামলার বাদি রুসনা বেগম বলেন, ‘আসামিদের আগুন লাগাতে আমি দেখিনি। তবে আমার মেয়ে দেখেছে।’
রুসনা বেগমের মেয়ের কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘ঘটনার সময় আমি ঘরে ছিলাম। হঠাৎ আমাদের ঘরের আঙ্গিনায় বেশ কিছু লোকের চিৎকার শুনতে পাই। চিৎকার শুনে ঘরের আঙ্গিনায় নজর দিলে দেখতে পাই ৭/৮জন লোক গালাগালি করতেছে। গালাগালির এক পর্যায়ে তারা আমাদের বসত ঘরের পাশে খড়ের ঘরে আগুন লাগিয়ে দৌঁড়ে চলে যায়। আগুন দেখে আমি উচ্চস্বরে চিৎকার করিলে আমাদের নিকটবর্তী প্রতিবেশিরা এসে আগুন নিয়ন্ত্রণ করেন।’
আগুন নেভাতে আসা কেউ মামলার আসামিদের চিনতে পারছেন কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমাদের প্রতিবেশিরা কেউ পারভেজ আহমদসহ অন্য আসামিদের দেখার আগেই তারা চলে যায়।’
কিন্তু মামলার এজাহারে উল্লেখ করা হয়েছে, ‘প্রতিবেশিরা চিৎকার শুনে আসার সময় ৮/৯জন লোককে দৌড়ে গিয়ে একটি মাইক্রোবাসে করে পালিয়ে যেতে দেখেছেন তারা।’
গোলাপগঞ্জ মডেল থানার উপপরিদর্শক পার্থ সারথী দাস বলেন, আসলে এ মামলার ঘটনার সাথে অন্য একটি মামলার সম্পর্ক আছে বিষয়টি প্রথমে জানতে পারিনি। এ মামলার বাদির বিরুদ্ধে আসামিরা যে আগে আত্মহত্যার প্ররোচনার অভিযোগে একটি মামলা করেছিলেন তদন্তে গিয়ে বিষয়টি জানতে পারি।
তিনি বলেন, স্বামীর বাড়ি লোকজন বলতেছে শেফালি বেগম মানসিকভাবে অসুস্থ ছিলেন। তারা এজন্য বিভিন্ন ডাক্তার দেখিয়েছেন। আর শেফালি বেগমের পিতার বাড়ির লোকজন বলছেন, স্বামীর বাড়ির লোকজনের অত্যাচারে শেফালি বেগম মানুষিক ভাবে অসুস্থ হয়ে পড়ে। শেফালি বেগম আগে সুস্থ ছিলেন।
তিনি আর বলেন, ‘মামলাটি এখন প্রাথমিক পর্যায়ে রয়েছে এখনও তদন্ত চলছে। তদন্তে প্রকৃত সত্য বেরিয়ে আসবে বলে আমি আশাবাদী।’