সিলেটের সীমান্তবর্তী কোম্পানীগঞ্জ উপজেলায় পাহাড়ি ঢলের পানি ও টানা বৃষ্টিপাতে বন্যা কবলিত হয়েছেন উপজেলার ছয়টি ইউনিয়নের লাখো মানুষ। এমন দুর্যোগেও বানভাসি মানুষের কাছে পর্যাপ্ত ত্রাণ সহায়তা পৌঁছেনি বলে অভিযোগ উঠেছে। উপজেলার ৬টি ইউনিয়নের ১২০টি গ্রাম প্লাবিত হয়ে বেশিরভাগ গ্রামে মানুষের বাড়ি-ঘরে হাঁটু থেকে কোমর সমান পানি ছিল।
ঈদের রাত (১৭ জুন) ১টা পর থেকে পাহাড়ি ঢলের পানি লোকালয়ে প্রবেশ করতে শুরু করে ঈদের সারাদিনই পানি বৃদ্ধি পেয়ে উপজেলার ৬টি ইউনিয়নের শতাধিক বাড়ি-ঘরে হাঁটু থেকে কোমর সমান পানি উঠতে থাকলে বানভাসি মানুষজন নিরাপদ আশ্রয়ের জন্য ছুটাছুটি করেন আশ্রয়কেন্দ্রে ও স্বজনদের বাড়িতে। কিছু কিছু আশ্রয় কেন্দ্রে অতিরিক্ত বানভাসি মানুষ আসায় অনেকেই বিভিন্ন নির্মাণাধীন ভবন ও পাথর বালুবাহী ট্রাকের ত্রিপল দিয়ে তাঁবু বানিয়ে আশ্রয় নিতেও দেখা গেছে।
ঈদের দিন বন্যা পরিস্থিতির অবনতি হওয়ায় অনেক এলাকার বন্যা কবলিত মানুষ ঈদের নামাজও পড়তে পারেননি। বন্যা দুর্গত কৃষক পরিবার গুলো বিপাকে পড়েছিলেন গবাদিপশু নিয়ে। নিজেদের নিরাপদ আশ্রয় করতে পারলেও গবাদিপশুর নিরাপদ আশ্রয়ের ব্যবস্থা করতে হিমশিম খেতে হয়েছে। পাহাড়ি ঢলের থই থই পানিতে গ্রামীণ সকল সড়ক তলিয়ে যাওয়ায় সিলেট-ভোলাগঞ্জ সড়কই একমাত্র আশ্রয় ছিল গবাদিপশু গুলোর। এ সড়কের দু’পাশে ত্রিপল দিয়ে গরু, ছাগল রাখার ব্যবস্থা করতে পারলেও পশু খাদ্য ব্যবস্থা করতে সংগ্রাম করতে হয়েছে। এদিকে ঢলের পানিতে উপজেলার ছোট বড় ১০টি বাজারের ব্যবসায়ীদের লাখ লাখ টাকার মালামাল নষ্ট হয়েছে বলে খবর পাওয়া গেছে।
গত বৃহস্পতিবার (২০ জুন) দুপুর থেকে বৃষ্টিপাত না হওয়ায় ও পাহাড়ি ঢল নামার গতি কমে যাওয়া বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি হয়েছে। গত দুই দিনে উপজেলার বিভিন্ন এলাকায় চার থেকে সাড়ে চার ফুট পানি কমছে। এত পানি কমলেও এখনও উপজেলার অর্ধশতাধিক গ্রামে পানি রয়েছে। যে সব এলাকায় ঢলের পানি কমছে সে সব এলাকায় মানুষের বাড়ি-ঘরের ক্ষয়ক্ষতি ভেসে উঠছে। বাড়ি-ঘর মেরামত না করে ঘরে থাকার অনুকূল নয় পরিবেশ।
শুক্রবার বিকেলে থেকে উপজেলার ইসলামপুর পশ্চিম ইউনিয়নের কাঁঠালবাড়ি গুচ্ছগ্রাম (শিমুলতলা আশ্রয়ণ প্রকল্প) এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, এ গ্রামের অনেক ঘরে ২ থেকে ৩ ফুট পর্যন্ত পানি রয়েছে। পানির ঢেউয়ে কারো কারো ঘর ভেঙে গেছে। বন্যা পরিস্থিতিতে গুচ্ছগ্রামের বেশির ভাগ মানুষ আশ্রয়কেন্দ্রে গেলেও কিছু মানুষ জীবনের ঝুঁকি নিয়ে খাটের উপর খাট দিয়ে ঘরেই থেকে গেছেন। আশ্রয় কেন্দ্রে যারা ঘরে ফিরেছেন তাঁরা বলছেন পানির ঢেউয়ে ভিটার মাটি চলে গেছে আবার কারো কারো ঘরের খুঁটি ও ঢেউটিন ভেঙে গেছে। অনেকের ঘরের ধান, চাউল সহ গুরুত্বপূর্ণ মালামাল নষ্ট হয়ে গেছে। এসব মেরামত না করে ঘরে বসবাস করা যাবে না।
বন্যা কবলিত এসব মানুষের অভিযোগ স্থানীয় জনপ্রতিনিধি থেকে শুরু করে সরকারি ও বেসরকারি পর্যাপ্ত ত্রাণ সহায়তাই পৌঁছেনি তাদের কাছে। কিছু এলাকায় ও আশ্রয়কেন্দ্রে শুকনো খাবার বিতরণ করা হয়েছে যা প্রয়োজনের তুলনায় অপ্রতুল।
কাঁঠালবাড়ি গুচ্ছগ্রামের মারফত আলী সিলেট ভয়েসকে জানান, ‘ঈদের দিন থেকে আমরা বন্যা কবলিত হয়ে চরম কষ্টে দিনযাপন করলেও আমাদের সহযোগিতা করার জন্য স্থানীয় মেম্বার, চেয়ারম্যান ও ইউএনও কেউ আসেননি। ঘরের মধ্যে হাঁটু থেকে কোমর পানি থাকায় কেউ রান্নাবান্না করতে পারেনি বলে চিড়ামুড়ি ও বিস্কুট খেয়ে দিন পার করছে।
তিনি বলেন, আমাদের গ্রামের কিছু মানুষ আশ্রয়কেন্দ্রে গেলেও অনেক মানুষই জায়গা না পেয়ে নিজ নিজ ঘরে, আত্মীয়-স্বজনের বাড়িতে ও বালুর স্টকে আশ্রয় নিয়েছে। এসব মানুষদের ত্রাণ সহায়তা দূরের কথা দেখতেও আসেননি কেউ। আমার পরিবার নিয়ে আমি বালুর স্টকে আশ্রয় নিয়েছি। এখানে এক পাশে মানুষ ও আরেক পাশে গরু নিয়ে অনেক কষ্টে দিন কাটাচ্ছি।’
উপজেলার কাঁঠালবাড়ি গ্রামের সাইফুল ইসলাম সিলেট ভয়েসকে জানান, ‘ঈদের দিন রাত ৩টার পর থেকে ঘরের মধ্যে পানি প্রবেশ করা শুরু হয়। সকাল ৯টার মধ্যে ঘরে প্রায় ৪ ফুট পানি উঠে যাওয়ার পরে সকাল ১০টার দিকে ঘর ছেড়ে ৩ সন্তান সহ বাবার বাড়িতে গিয়ে আশ্রয় নিয়েছিলাম। শুক্রবার বেলা ১২টায় ঘরে ফিরে দেখি এখনও ঘরে ১ ফুট পানি আছে এবং ঘরে থাকা ধান, চাল সব নষ্ট হয়ে গেছে।’
শিমুলতলা গুচ্ছগ্রামের মতিন মিয়া সিলেট ভয়েসকে জানান, ‘১৭ তারিখ সোমবার ভোর রাত থেকে পানি বৃদ্ধি শুরু হয়। ঘর থেকে বের হওয়ার নৌকা না পেয়ে পানি কমে যাবে যাবে চিন্তা করে সকাল ১১টা পর্যন্ত ঘরে থাকার চেষ্টা করতে করতে বুক সমান পানি হয়ে যায়। পরে স্ত্রী-সন্তান নিয়ে জীবন রক্ষা করতে ঘরের চালে আশ্রয় নিলে এলাকার একজনের নৌকা করে থানা বাজার সরকারি স্কুলের আশ্রয়কেন্দ্রে উঠেছিলাম। ৪ দিন পর আশ্রয় থেকে বাড়ি ফিরে দেখি আমার টিনের ঘরের অধিকাংশ জায়গা ভেঙে গেছে। এই ঘর মেরামত করার মতো টাকা পয়সা আমার নেই। আশ্রয়কেন্দ্র থেকে পরিবার আসলে কিভাবে থাকবে তা বুঝে উঠতে পারছি না।’
বুড়দেও গ্রামের সমাজসেবক সাদ্দাম হোসেন বলেন, ‘আমার ঘরটি উঁচু থাকায় অনেক মানুষকে আশ্রয় দিয়েছি। আশ্রয়কেন্দ্রে জায়গা সংকলন না থাকায় আমার বাড়ির সামনের সড়কে অনেক পরিবার পাথরবাহী ট্রাকে আশ্রয় নিয়েছেন। অনেকেই আবার গবাদিপশু নিয়ে রাস্তায় নির্ঘুম রাত কাটিয়েছেন। সরকারিভাবে এসব বন্যা কবলিত মানুষদের কোন সহায়তা করতে আমি দেখিনি।’
উপজেলা প্রশাসন সূত্রে জানা যায়, ‘উপজেলার ৩৮টি আশ্রয় কেন্দ্রে এখনও সাত হাজারের অধিক মানুষ রয়েছে। আশ্রয় কেন্দ্রগুলোতে শুঁকনো খাবার ও চাল বিতরণ করা হয়েছে। বন্যা কবলিত কিছু কিছু এলাকায় ত্রাণ বিতরণ হয়েছে, বাকী এলাকাগুলোতে ত্রাণ বিতরণের ব্যবস্থা করা হচ্ছে।’
কোম্পানীগঞ্জ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) গোলাম দস্তগীর আহমদ সিলেট ভয়েসকে বলেন, ‘কোম্পানীগঞ্জ থানার নিচতলা সহ কয়েকটি ভবনে দুই থেকে চার ফুট পর্যন্ত পানি ছিল। এ পরিস্থিতিতেও আইনশৃঙ্খলা স্বাভাবিক রাখার পাশাপাশি থানা পুলিশের পক্ষ প্রতিদিন বিভিন্ন আশ্রয়কেন্দ্রে রান্না করা খাবার বিতরণ করা হচ্ছে।’
কোম্পানীগঞ্জ উপজেলা চেয়ারম্যান মজির উদ্দিন সিলেট ভয়েসকে বলেন, ‘উপজেলার ৬টি ইউনিয়নের মধ্যে মাত্র কয়েকটি গ্রামে ব্যতীত সকল গ্রামেই মানুষের বাড়ি-ঘরে পানি উঠে হাজার হাজার মানুষ পানি বন্দি অবস্থায় চরম দুর্ভোগে জীবনযাপন করছেন। বন্যা দুর্গত মানুষদের সরকারি ও ব্যক্তিগত পক্ষ থেকে সহায়তা করা হচ্ছে। তবে সকল এলাকায় এখনও ত্রাণ সহায়তা পৌঁছানো সম্ভব হয়নি। সরকারের পক্ষ থেকে কোম্পানীগঞ্জের জন্য যে ত্রাণ সহায়তা বরাদ্দ হয়েছে তা স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও ট্যাগ অফিসারদের মাধ্যমে দ্রুত সময়ের মধ্যে বণ্টনের ব্যবস্থা করা হচ্ছে।’