ইতিহাস, ঐতিহ্য ও গৌরবে ১৩২ বছরে মুরারিচাঁদ কলেজ

স্বগৌরবে মহীয়ান মুরারিচাঁদ কলেজের প্রধান ফটক। ছবি: সিলেট ভয়েস।

প্রকৃতিকন্যা সিলেটের প্রাণকেন্দ্রে দাঁড়িয়ে থাকা ঐতিহ্যবাহী মুরারিচাঁদ (এমসি) কলেজের ১৩২ তম জন্মদিন আজ। আজ থেকে প্রায় ১১ যুগ আগে ১৮৯২ সনের ২৭ জুন রাজা গিরিশ চন্দ্র রায় তাঁর পিতামহ মুরারিচাঁদের নামে কলেজটি প্রতিষ্ঠা করেন।

টিলা বেষ্টিত চারদিক প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ভরপুর ১২৪ একর আয়তনের এই কলেজটি বাংলাদেশ তথা ভারত উপমহাদেশের প্রাচীন একটি বিদ্যাপীঠ, যেটি (১৮৮৬ সনে) প্রথমে স্কুল রূপে প্রতিষ্ঠিত হলেও পরবর্তীতে ১৮৯১ সনে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃক এফ.এ. শ্রেণি চালুর অনুমতি পেলে ১৮৯২ সালের ২৭ জুন আনুষ্ঠানিকভাবে যাত্রা শুরু করে। পরে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে ছিল।

প্রতিষ্ঠার দিক থেকে বাংলাদেশের সপ্তম শতবর্ষী কলেজ। এভাবে হাঁটি হাঁটি পা পা করে ঐতিহ্য ও গৌরবের ১৩২ তম বছরে পা রাখল সিলেট শহরের টিলাগড় এলাকায় অবস্থিত সুবিশাল আয়তনের এই এমসি কলেজ। পাখির কলকাকলির শব্দ, সবুজে ঘেরা টিলার পাশে নির্মিত প্রতিটি ভবন নিঃসন্দেহে কলেজটির সৌন্দর্যকে স্ফুটিত করে। সবুজময় প্রকৃতি, শ্বেতপদ্মময় পুকুর, প্রাচীন সংস্কৃতির ধারক বিশালকার ভবন, লেখাপড়ার দিক থেকে শিক্ষার্থীদের পছন্দের প্রথম সারিতে থাকায় এমসি কলেজকে প্রাচ্যের ক্যামব্রিজ বলে আখ্যায়িত করা হয়। শুরুতে মাত্র ১৮ জন শিক্ষার্থী দ্বারা কলেজটি পরিচালিত হলেও বর্তমানে এর ষোলটি বিভাগে মোট ১৪ হাজারেরও বেশি শিক্ষার্থী অধ্যয়ন করছে।

উইকিপিডিয়ার তথ্যমতে, সিলেটের রায়নগরের তৎকালীন জমিদার বাবু মুরারিচাঁদ রায় ‘র সন্তানহীনা কন্যা ব্রজসুন্দরী দেবীর পালিত পুত্র রাজা গিরিশ চন্দ্র রায় তাঁর পিতামহ বাবু মুরারিচাঁদ রায়ের স্মৃতির মোহনায় তৎকালীন গোবিন্দচরণ পার্কের (বর্তমান হাসান মার্কেট) পাশে ১৮৮৬ সনে মুরারিচাঁদ উচ্চ বিদ্যালয় নামে একটি স্কুল প্রতিষ্ঠা করেন। পর্যায়ক্রমে রাজা স্কুলটিকে কলেজ পর্যায়ে উন্নীত করণের লক্ষে বিভোর হোন। ১৯০৮ সালে স্কুলটি সরকারি অনুদান লাভ করে। একই বছর রাজা গিরিশ চন্দ্র রায় মৃত্যুবরণ করায় অনেকটা থমকে দাঁড়ায় পরিবেশ।

পরবর্তীতে ১৯১২ সালে তৎকালীন আসাম প্রদেশের চিফ কমিশনার স্যার আর্চডেল আর্ল ‘র সময়ে কলেজটি সরকারি কলেজ হিসেবে অধিভুক্ত হয়। ফলে ক্যাম্পাসের আয়তন বর্ধিত করণের লক্ষ্যে গোবিন্দচরন পার্কে (হাসান মার্কেট) বাঁশ ও নলখাগড়া জাতীয় গাছ দ্বারা গৃহ নির্মাণের পাশাপাশি উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ে বিজ্ঞান বিভাগ চালু করা হয়। পরবর্তীতে ১৯১৬ সালের দিকে খাঁন বাহাদুর সৈয়দ আব্দুল মজিদ (কাপ্তান মিয়া) এর সহযোগিতায় উচ্চ শিক্ষার জন্য ডিগ্রি কোর্স চালুর মাধ্যমে শিক্ষাক্ষেত্রে আরেক ধাপ অগ্রসর হয় এমসি কলেজ। তখন পর্যন্ত জড়াজীর্ণ কাচা মাটির ঘরেই লেখাপড়ার কার্যক্রম চলতে থাকে।

উল্লেখ্য, ১৯১২ সনের দিকে কলেজটি সরকারি করণ হলেও কলেজের কর্যক্রম ততটা অগ্রগতি হয়নি। ফলে আসামের শিক্ষামন্ত্রী খাঁন বাহাদুর সৈয়দ আব্দুল মজিদের নির্দেশ মোতাবেক সিলেটের জনগণের স্বতঃফুর্ত আন্দোলনে কলেজটি ১৯২১ সালে প্রথম শ্রেণির কলেজে উন্নীত হয়। একই বছর খাঁন বাহাদুর সৈয়দ আব্দুল মজিদ ‘র নেতৃত্ব ও তত্ত্বাবধানে ক্যাম্পাস স্থানান্তরিত করে গোবিন্দচরন পার্ক থেকে বর্তমান ক্যাম্পাস টিলাগড়ে আনা হয়।

বস্তুত, কাপ্তান মিয়ার অনুগ্রহ ও তত্ত্বাবধানে কলেজটি আশাতীত উন্নতি লাভ করার ফলে খাঁন বাহাদুর সৈয়দ আব্দুল মজিদ কাপ্তান মিয়াকে এমসি কলেজের ত্রানকর্তা হিসাবে আখ্যায়িত করা হয়। পর্যায়ক্রমে ভিন্ন ভিন্ন সনে বিভিন্ন বিষয়ে ডিগ্রি ও ডিগ্রি সম্মান কোর্স চালু করণের মাধ্যমে কলেজটি দিনদিন সামনের দিকে অগ্রসর হতে থাকে। ফলে অসাধারণ শিক্ষাপদ্ধতির জন্য ১৯২৬ সালে ডিগ্রি (বিজ্ঞান) চালুর পাশাপাশি ১৯২৭ খ্রিস্টাব্দে রসায়ন বিজ্ঞান ও পদার্থ বিজ্ঞান বিষয়ে (সম্মান) কোর্স চালু হওয়ার পর বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিক্ষায় গৌরবময় ফলাফলের জন্য ভারত উপমহাদেশেত মধ্যে অন্যতম সেরা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান হিসেবে খ্যাতি অর্জন করে এমসি কলেজ।

তাছাড়া সৌন্দর্যের নির্যাসে ভরপুর কারুকার্যময় অসাধারণ নির্মাণশৈলী ও ঐতিহ্যমণ্ডিত এই কলেজের বিশালাকার নয়টি ভবনের পাশাপাশি রয়েছে প্রায় ষাট হাজার পুস্তক সংবলিত বৃহৎ গ্রন্থাগার যেখানে প্রতিনিয়ত ভিড় করে অসংখ্য শিক্ষার্থী।

নজরকাঁড়া মনোরম দৃশ্য সংবলিত সবুজে আচ্ছাদিত এই কলেজের নির্মাণশৈলী যেকোনো কাউকে মুহূর্তেই মুগ্ধ করবে। পুরোনো প্রতিটি ভবন নির্মাণে ব্যবহৃত সামগ্রী, কারুকার্য ও নান্দনিক নকশায় ফুটে উঠেছে তৎকালীন বাংলা এবং আসামের মিশ্রিত রূপ।প্রকৃতিঘেরা সবুজের সমারোহ দৃষ্টিকাঁড়ানান্দনিক এই ক্যাম্পাস লাল-সাদা পদ্মফুল ও পূর্ণ জলকনায় আচ্ছাদিত পুকুরটিকে বুকে আগলে রেখে সাচ্ছন্দচিত্তে প্রতিনিয়ত বয়ে চলেছে।